skip to Main Content

ফুড বেনিফিট I কমলালেবুর জয়গান

গুণপনার শেষ নেই কমলালেবুর। ব্যাধি ঠেকাতে তো বটেই, ত্বক আর চুলে এর উপকারিতা অসামান্য

সুস্বাদু আর রসালো- কমলালেবু সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে এই দুটো বিশেষণ চলে আসে। এরপর আসে টক, মিষ্টি, অল্প তিতা স্বাদের কথা। ফলশাস্ত্রে এটি সুস্বাস্থ্য আর আনন্দের প্রতীক। এমনকি কমলা রঙটাও খুশিই প্রতিনিধিত্ব করে। খাওয়া যায়, গায়ে মাখা যায়, চুলে দেয়া যায়- আরও কত কী গুণ আছে কমলালেবুর, তা বলে শেষ করা যাবে না।
কমলালেবুর জন্ম ভারতবর্ষ ও চীনে। দ্রাবিড় শব্দ নারান্দম> সংস্কৃত নাগরঙ্গ> ফার্সি নারাঙ> আরবি নারাঞ্জ> ফরাসি অহেঞ্জ (ফরাসিরা র কে হ বলে)> ইংরেজি অরেঞ্জ। একাদশ শতকের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে নাগরঙ্গ ফলের নাম পাওয়া যায়, এবং জানা যায় এটি রপ্তানি হতো দেশের বাইরেও। ষোড়শ শতকে বাংলা ঘুরে যাওয়া পর্তুগিজ ডুয়ার্স বারবোসাও লিখেছেন, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বসবাসরত পর্তুগিজরা সাইট্রাস জাতীয় ফল দিয়ে তৈরি করতো মিষ্টান্ন। এদের হাত ধরে এই ফলের বিদেশযাত্রা।
স্বাস্থ্যকর

প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় কমলালেবু থাকলে কিডনির পাথর হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। হেস্পিরিডিন আর পেক্টিন- কমলার এই দুই উপাদান রক্তে থাকা খারাপ কোলেস্টেরল কমায়। এ ছাড়া শরীরে চর্বি জমতেও বাধা দেয়। কমলায় ক্যালরি কম থাকায় প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সহজেই যোগ করা যায়। এটা রক্তে শর্করার সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। রক্তসঞ্চালন ব্যবস্থা নিরুপদ্রব রাখতেও এর ভূমিকা রয়েছে। প্রতিদিন এক গ্লাস কমলার জুস আর্থরাইটিসের ব্যথা থেকে রেহাই দিতে পারে। এর হেস্পিরিডিন ও ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কমলার ঘন আঁশ খাবার হজম করতে সাহায্য করে। এটা ডাইজেস্টিভ এনজাইম বা হজম-সহায়ক তরল নিঃসরণ করে, যা পরিপাকতন্ত্রের সহায়ক। কমলা ও লেবুজাতীয় অন্যান্য ফলে থাকা ডি-লিনোনেন নামের যৌগ কোলন, লাঙ, স্কিন, ব্রেস্ট ক্যানসারের মতো মারণব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করে। ভিটামিন সি কোষের ক্ষয় রোধ করে, ধমনির বেঁকে যাওয়া প্রতিরোধ করে। ফাইবার, হেস্পিরিডিন আর ফোলেট হৃদ্যন্ত্র সুস্থ রাখে। প্রতিদিন একটা কমলা হৃদ্যন্ত্রের সুস্থতার জন্য উপকারী। এর ফলিক অ্যাসিড মস্তিষ্ক বিকাশে সহায়ক। ভিটামিন সি রক্তের শ্বেতকণিকা বাড়িয়ে ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে। ক্যালরি কম আর ফাইবার বা আঁশ বেশি থাকার কারণে কমলা অল্প খেলেই পেট ভরা লাগে- ফলাফল ওজন হ্রাস। এই ফলে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। কেননা এটি অপ্রত্যাশিত অক্সিডেন্ট বহনকারী ফ্রি র্যাডিকেলকে গঠিত হতে দেয় না। ফলে রোগ ও ব্যথা প্রতিহত হয়। ফ্ল্যাভোনোইডস ও পলিফেনোলস ভাইরাল ইনফেকশনের সঙ্গে লড়তে কমলা সাহায্য করে। এর ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড় শক্ত করে। কমলার আঁশ আবার আলসার প্রতিরোধেও উপকারী। দৃষ্টিশক্তি বাড়াতেও কমলা উপকারী। মানবদেহের প্রতিদিনের ফোলেট চাহিদার ১০% পূরণ হতে পারে এই ফল থেকে। কমলার খোসা দিয়ে তৈরি চা সদ্য মায়েদের জন্য বিশেষ উপকারী। এর থেকে পুষ্টি যেমন পাওয়া যায়, তেমনি মাস্টিটিস থেকেও পরিত্রাণ মেলে। কমলার খোসা মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে। স্নায়বিক দৌর্বল্য, মানসিক চাপ ও নিদ্রাহীনতা দূর করে। কমলার সামান্য অ্যাফ্রোডিজিয়াক গুণ রয়েছে, এর ফলে লিবিডো বৃদ্ধি পায়। অরেঞ্জ এসেনশিয়াল অয়েল শরীরের এন্ডোক্রাইন ও এক্সোক্রাইনের মতো নিঃসরক গ্রন্থি থেকে পরিমিত নিঃসরণ ঘটায়, যা ল্যাকটেশন, মেনস্ট্রুয়েশন, বাইল হরমোন, ডাইজেস্টিভ জুস ও এনজাইম বৃদ্ধি করে।
ত্বকের সুরক্ষায়
কমলার জুস ও খোসা ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকে বয়সের রেখা পড়তে দেয় না। ওই ফ্রি র্যাডিকেলগুলোর সঙ্গে লড়াই করে। কমলার খোসায় ফলের থেকেও বেশি ভিটামিন সি রয়েছে। সূর্যের আলোয় খোসা শুকিয়ে গুঁড়া করে স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটা চোখের আশপাশের কালো দাগসহ ত্বকের যেকোনো দাগ দূর করতে বেশ কার্যকর। কমলার সাইট্রিক অ্যাসিড ব্রণের চিকিৎসায় বেশ ফলপ্রদ। কমলা খেলে এর ডায়েটারি ফাইবার শরীর থেকে ক্ষতিকর বর্জ্য ও বিষাক্ত উপাদানগুলো বের করে দেয়। খোসা থেঁতলে বেশ ভালো মাস্ক তৈরি করা যায়, যা মুখে লাগালে দ্রুত ব্রণ থেকে মুক্তি মেলে। প্রাকৃতিক ব্লিচিং এজেন্ট হিসেবে এটি মুখের যেকোনো দাগ হালকা করে দেয়, অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও ত্বকের কোষকে রক্ষা করে। মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করলে ব্ল্যাকহেডও দূর হয়। সব ধরনের ত্বকে মানানসই। কমলার খোসা ত্বকের মরা কোষগুলো সরিয়ে এনে দেয় ঔজ্জ্বল্য।
চুলের সুরক্ষায়
কমলার মধ্যে এমন কিছু গুণ রয়েছে, যেগুলোয় চুল মজবুত হয়। কমলালেবুর রস কন্ডিশনার হিসেবে অসাধারণ। অল্প একটু পানি, একটা কমলার রস আর এক চামচ মধু মিশিয়ে চুল শ্যাম্পু করার পর ৫-১০ মিনিট লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেললেই হলো। ভিটামিন সি আর বায়ো-ফ্ল্যাভোনোইডস মাথার তালুতে রক্তসঞ্চালনে সাহায্য করে, ফলে চুলের বৃদ্ধি দ্রুততর হয়। ফলিক অ্যাসিড ও ইনসনিটল- দুই ধরনের ভিটামিন বি চুল পড়া রোধ করে। কমলার খোসার রস মাথায় দিলে খুশকি দূর হয়।
ক্ষতিকর দিক
অতিরিক্ত কমলা খেলে কমলার আঁশ হজম প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে পারে। ফলাফল পেট ব্যথা, মারাত্মক পর্যায়ে গেলে ডায়রিয়া। বেশি কমলা খেলে উল্টো ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে। আর এক দিনে ২ হাজার মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন সি সুস্থ শরীর নিতে পারে না; ফলাফল- ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, বমি, বুকে জ্বালাপোড়া, শিরটান, মাথাব্যথা, নিদ্রাহীনতা, কিডনিতে পাথর! ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ যাদের নিয়মিত আহার, তাদের কমলা আর কলা- দুটোই সাবধানে খেতে বলা হয়। কারণ, এই দুটো ফলে পটাশিয়াম এত বেশি যে, সেটা কিডনিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
পুনশ্চ: কমলা কিন্তু আদপেই প্রাকৃতিক ফল নয়। চায়নিজ গ্রেপফ্রুট বা পোমেলোর (চৈনিক জাম্বুরা) সঙ্গে ট্যাঞ্জারিনের হাইব্রিড হলো অরেঞ্জ! আর পুরো পৃথিবীতে ৬০০ ধরনের কমলালেবু দেখা যায়। আর আমরা যে জংলা ভ্যারিয়েশন দেখি কমলার, বা যেটাকে দেশি কমলা বলি, সেটা আদপেই অরেঞ্জ নয়- ট্যাঞ্জারিন!

আল মারুফ রাসেল
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top