বিশেষ ফিচার I ফ্যাশন টিউন
কণ্ঠশিল্পীদের লুক তাদের অনুরাগীরা রাতারাতি লুফে নেয়। তবে ফ্যাশনে কিংবা স্টাইলে সবার প্রভাব এক রকম হয় না। যখন যার জয়জয়কার, তখন তার প্রভাবই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
সুরের রয়েছে তীব্র সম্মোহনী শক্তি। জীবনধারায় এর প্রভাব ব্যাপক।
ফ্যাশনে সংগীতের প্রভাব নিয়ে আলাপে সবার আগে মাইকেল জ্যাকসনের কথা বলতে হয়। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, সংগীত ও নিজস্ব যাপনের সমন্বয়ে তার স্টেটমেন্ট গড়ে উঠেছিল। শু থেকে শুরু করে হেয়ারস্টাইল- সবকিছুতেই সারা জীবন স্বকীয়তার চর্চা করে গেছেন তার মিউজিক ও কোরিওগ্রাফির মতোই। প্রায় দুই দশক ধরে তার স্টেটমেন্টে বুঁদ হয়ে ছিল পুরো পৃথিবী।
‘মাথার ভেতর ছিল এলভিস প্রিসলি…’ অঞ্জন দত্তর জনপ্রিয় গানের লাইন। ফ্যাশনেও পৌঁছে গিয়েছিলেন এলভিস। জনপ্রিয় এই তারকা ফ্যাশন জগতে আজও অম্লান। সাহসী এই গায়কের চুল স্বকীয়তায় দারুণ। ব্যাক ব্রাশ তখন থেকে হেয়ারস্টাইলের ট্রেন্ডে ঢুকে পড়ে। ষাটের দশকে তিনি ফ্লোরাল প্রিন্টের শার্টে রুপালি পর্দায় হাজির হয়েছিলেন। এখনো চলছে ট্রেন্ডি রঙিন ফুলের প্রিন্ট। হাওয়াই শার্টে শুরু, এখন ফুলেল ছাপা দেখা যায় ক্যাজুয়াল ডিজাইনেও। রঙ ও আকারে এসেছে বিভিন্নতা। শার্টের পাশাপাশি টাই, মোজাতেও স্থান করে নিয়েছে ফুল।
বিটলস সদস্যদের হেয়ার কাটে প্রভাবিত হয়েছেন সংগীতপিপাসু তরুণেরা। অন্যদিকে জন লেননের রাউন্ড গ্লাস তো চিরনতুন। কয়েক বছর আগেই ফ্যাশনে ফিরে এসে বেশ জেঁকে বসেছে।
ডায়ানা রোসের কথা মনে পড়ে? গ্লিটার, সিকোয়েন্স, স্পার্কলিং জুয়েলারির মতো চকমকি ফ্যাশন নিয়ে এসেছিলেন এই গায়িকা। ষাটের সেই পার্টি ড্রেসে নয় শুধু, নব্বইয়ে শাড়ি আর কামিজেও জ্বলজ্বল করেছে। রাতের জন্য ওয়্যারড্রোব ডিজাইনে এই ২০২০ সালেও স্টানিং লুক এনে দেয় এসব গয়না।
কিম কার্দাশিয়ান, জেনিফার লোপেজ এবং বিয়ন্সের কথা জানেন সবাই। আমেরিকান মিউজিশিয়ান চের-এর কথা এখন আর মনে পড়ে কজনের? সি থ্রু ফ্যাশনে হট কেক। সেই সত্তর দশকের কনসার্টে দর্শক মাতিয়েছিলেন চের।
বাপ্পী লাহিড়ীর পরা স্বর্ণালংকার অবাক করেছে, তবে এর আগে প্রথম র্যাপ গ্রুপ রান ডিএমসির শিল্পীরা গলায় পরেছিলেন গোল্ড চেইন। শিকলের নকশায় তৈরি করা সেসব জাংক জুয়েলারি এখনো ইউনিসেক্স ধারায় জনপ্রিয়।
পপের রানি ম্যাডোনা। গানের স্টেজকে করে তুলেছিলেন ফ্যাশন রানওয়ে। ফিশ নেট, ফিঙ্গার লেস গ্লাভস এবং ইনার গার্মেন্টসকে আউট ড্রেস হিসেবে ব্যবহার করা এই বম্বশেল শুধু পোশাকে নয়, ফ্যাশনজগৎকে শাসন করেছেন চুলের রঙেও। এখনো কেশবতীদের দীর্ঘশ্বাস এই হেয়ারস্টাইল ঘিরে। রেড লিপস্টিকের বোল্ডনেস হার মানায় সবকিছুকে। ম্যাডোনার লাল ঠোঁটের মুগ্ধতা এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রভাব রেখেছে। এখনো তাই ফ্যাশন-সচেতনদের পাউচে ঝলমলে রেড লিপস্টিক থাকেই।
স্পাইস গার্লের ফ্যাশনের ঝাঁজ অনুভব করা যায় আজও। এক দল মেয়ের আলাদা স্টাইলে অবাক পৃথিবী। সেখান থেকেই জনপ্রিয়তার তালিকায় পৌঁছে গেছে লং লেদার কোট, ফিটেড শর্ট স্কার্ট-টপস। সাহসী স্পাইস গার্লের চুলে লালের শেড তো সেই থেকেই জনপ্রিয়। চেরি রেডের জ্বলজ্বলে সৌন্দর্যে হারিয়েছে শত মন।
হালের লেডি গাগাকে ট্রেন্ড সেটার বলা যাবে না; বরং বলতে হবে এই গায়িকা ফ্যাশনের সীমানা ভেঙেছেন বারবার। পোশাকের গ্লাস সিলিং তার মতো করে উড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য আর কারও মধ্যে এখনো দেখা যায়নি।
এ তো গেল আন্তর্জাতিক তারকাদের কথা। বিশ্বায়নের এই যুগে যদিও সবাই গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা, তবু নিজের দেশের গল্প সব সময়ই বিশেষ।
বাংলাদেশের সংগীতজগতে কয়েকজন কিংবদন্তি রয়েছেন, যারা প্রভাবিত করেছেন ফ্যাশনকে। তাদের মধ্যে রুনা লায়লার আংটি জ্বলজ্বল করছে অনেকের মনে। ‘শিল্পী আমি শিল্পী’ গানে ফিঙ্গার রিংয়ের ঝলক ভোলা যায় না। জুয়েলারি ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে এই দৃশ্যায়নের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এভারগ্রিন শব্দটি ফেরদৌস ওয়াহিদের জন্য যথার্থ। সানগ্লাসের প্রতি আগ্রহ তৈরিতে তার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
তরুণ তারকারা সব সময়ই সাড়া জাগিয়েছেন বাংলাদেশের ফ্যাশনে। আজম খানের স্টাইল তার সময়ে মুগ্ধ করেছিল সংগীতপিপাসুদের। ঢেউখেলানো চুলের সঙ্গে ফিটিং কোট আর বেলবটম ছিল এই শিল্পীর স্টেটমেন্ট। এটিও পরিণত হয়েছিল ফ্যাশনে। বেলবটম ফিরে না এলেও চেক-স্ট্রাইপের কোটের এই রেট্রো কয়েক বছর আগে আবার দেখা গেছে।
এরপরে ভিন্নতর লুক নিয়ে হাজির মাইলস। হামিন আহমেদ আর শাফিন আহমেদের হ্যাট, কটি, বুট ও গিটারে রুমাল। তরুণসমাজ খুঁজে পেল বাংলা গানের স্টাইল আইকন। মাইলস ‘নিঃস্ব করেছ আমায়’ শোনাতে শোনাতে দেশের ফ্যাশন জগৎকে পূর্ণতা দিয়েছে বেশ খানিকটা।
এলআরবি নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু এলেন, জয় করলেন। কালো রঙ যে আলো ছড়ায়, সেটা তিনিই সম্ভবত ভালো জানতেন। অল ব্ল্যাকে দিনরাত পারফর্ম করে গেছেন গিটারের জাদুকর। এর সঙ্গে ডেনিম, ব্যান্ডানাও তার হাত ধরে ফ্যাশন-সচেতনদের তালিকার ওপরের দিকে উঠে আসে।
পাঞ্জাবি, জিনস, গামছা আর কেডস কিংবা বুটের অপ্রচলিত কম্বিনেশনে ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেব, তুমি আমার’ গানে নগরবাউল জেমস তরুণ প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিলেন। প্রথা ভাঙার এই শিল্পীর কাছে তরুণেরা শিখেছেন ফিউশন। দেশীয় আর পাশ্চাত্যের মিশেলে পোশাকের নতুন ধারার শুরু তখন থেকেই।
ঢেউখেলানো চুলে আর্কের হাসান মাতিয়েছেন দর্শকদের মন। এক রঙা শার্টের বোতাম খুলে তিনি ভেঙেছেন ফ্যাশনের চেনা ধারণা। এই স্টাইল অনুসরণ করতেন তরুণেরা।
নব্বইয়ের দশকের আরও একজন ছিলেন। বিপ্লব। তার ঢিলেঢালা নকশার পোশাকে ছিল নিজস্বতা। নিজের সিগনেচার স্টাইলে হাজির হতেন মঞ্চে। সঙ্গে থাকত ডেনিম, বুট অথবা কেডস। গলায় কখনো মালা, কখনো হাতে বালা। জুয়েলারির জেন্ডার ভাগ করেননি তিনি।
মিউজিশিয়ানদের প্রভাব ফ্যাশনের গতিকে বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করেছে এ দেশে। যখন যার গানে মেতেছে জনগণ, তখন তার প্রতি মুগ্ধতার কারণে দেশীয় ব্র্যান্ডের জৌলুশ বেড়েছে। এই ২০২০-এ আলাদা করে কারও স্টাইলে নিয়ন্ত্রিত হয় না ফ্যাশন। তবে খানিকটা প্রভাবিত হয়। অর্ণবের গানের লাইন ‘হোক কলরব’ আজ বহু টি-শার্টে স্থান করে নিয়েছে।
যুগে যুগে যেমন সুরের রেশ থেকে যায় মানুষের মনে, তেমনি স্টাইল পরিণত হয় ফ্যাশনে। হয়ে ওঠে চিরনতুন।
ছবি: ইন্টারনেট