skip to Main Content

ফিচার I উপমহাদেশে নারীবাদ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলে নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বেশ কয়েকজন নারীর সক্রিয়তা লক্ষণীয়। তবে তা সংগঠিত কোনো আন্দোলনের চেহারা নেয়নি। এই নিয়ে লিখছেন অতনু সিংহ

পশ্চিমে বেশ পুরোনো হলেও আধুনিকতার ইতিহাসের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে নারীবাদের ইতিহাস। সেখানে আলোকায়ন, যুক্তিবাদ, শিল্পবিপ্লব, বুর্জোয়াদের উদ্ভব, গণতন্ত্র, সামাজিক সমানাধিকার ও পলিটিক্যাল সোসাইটি গড়ে ওঠার মতো বিষয়গুলোর মধ্য দিয়েই নারীবাদী আন্দোলনের ধারা তৈরি হয়েছে। এমনকি মার্ক্সবাদী বা সোশ্যালিস্ট রাজনীতির ভেতর থেকে শ্রেণিপ্রশ্নকে সামনে রেখেও সংজ্ঞায়িত হয়েছে নারীবাদ। পরবর্তীকালে আরও নানাভাবে দার্শনিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীবাদের ব্যাপ্তি ঘটেছে পশ্চিমে। কিন্তু উপমহাদেশে নারীবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠা বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছু হয়নি বললেই চলে। নারী অধিকার বা সমানাধিকার ও নারীশিক্ষার প্রশ্নে গোটা উপমহাদেশে বেগম রোকেয়ার মতো বেশ ক’জন মহীয়সী নারী সমাজসংস্কারক এগিয়ে এসেছিলেন ঠিকই, পাশ্চাত্যের নানা প্রকারের নারীবাদ তাদের প্রভাবিতও করেছে, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে রাজনৈতিকভাবে যেসব আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে নারীমুক্তির প্রশ্নে এমন কোনো সংগঠিত আন্দোলন হয়নি, যা উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য। বরং নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে ইনডিভিজুয়াল নারী লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীরা উপমহাদেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পেরেছেন। যেমন বেগম রোকেয়া, কামিনী রায়, সাবিত্রীবাই ফুলে, মহাশ্বেতা দেবী, অরুন্ধতী রায়, মালালা ইউসুফজাই প্রমুখ।
যদিও এর বাইরে একাডেমিক জায়গা থেকে অগণন নারীবাদী ছিলেন এবং আছেন। কিন্তু তত্ত্বের বাইরে তাঁদের কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্যোগ দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেনি। এ ছাড়া শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে গোটা উপমহাদেশে নারীবাদী উদ্যোগ কম নয়। কিন্তু তা নেহাতই নারীবাদী চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এই সব নারীবাদী আলাপ বাস্তব ক্ষেত্রে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, তা এক বড়সড় প্রশ্ন বটে। তাই তাদের প্রসঙ্গ এই লেখায় খুব গুরুত্বের সঙ্গে ঠাঁই পাচ্ছে না। বরং উপমহাদেশের নারীবাদের আলাপে ফুলন দেবী, তারামন বিবি, ইলা মিত্র, গীতা মুখোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচীদের নামও সংগত কারণেই উঠে আসবে। নারীমুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে এরা প্রত্যেকেই রোল মডেল। কিন্তু খেয়াল রাখা দরকার, এদের অধিকাংশই যে রাজনৈতিক-সামাজিক বর্গে কাজ করেছেন নানা ফর্মে, সেখানে নারীর অধিকারের আলাপ প্রাসঙ্গিক হলেও, সামগ্রিক অর্থে নারীমুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি আড়ালেই থেকে গেছে।
কিন্তু নারী ও নারীমুক্তির প্রশ্ন উপমহাদেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উপমহাদেশের ব্যাপক একটা অঞ্চলের (বিশেষত পূর্বাঞ্চল) প্রাচীন ইতিহাস মাতৃতান্ত্রিক। এখানে কৃষি, উৎপাদনব্যবস্থা ও অর্থনীতির চালিকাশক্তির জায়গায় নারী একসময় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এই অঞ্চলের বেশ কিছু মিথ, লোকগাথা, উপগাথায় নারীই ক্ষমতার ভরকেন্দ্র। অথচ নারীকে সমাজের উৎপাদনব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত করে পিতৃতন্ত্রের উত্থানের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক রদবদলের ঘটনা ঘটে যায়। প্রতিষ্ঠা পায় পুরোহিততন্ত্র, বর্ণবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ। যার পরিণতিতে এখানে ঔপনিবেশিক কালপর্ব থেকে শুরু করে আজ অবধি নারীকে তার হৃত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়তে হয়েছে, কখনো তা নারী শিক্ষার অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টার মাধ্যমে, কখনো বাইরে কাজের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের মাধ্যমে, কখনোবা কর্মক্ষেত্রে নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের মাধ্যমে। এবং লক্ষণীয়, এসব বিষয় পুরুষ নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থার মুখাপেক্ষী হয়ে থেকেছে। কিন্তু যে অর্থে নারীমুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের লড়াইকে বোঝানো হয়, তেমন সংগঠিত নারীবাদী আন্দোলন সেভাবে চোখে পড়েনি।
এর কারণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটলেও, এখানে পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে উপনিবেশবাদের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক নীতির কারণে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির পূর্ণ বিকাশ হয়নি একদিকে, অন্যদিকে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়নি আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে প্যাটিয়ার্কি বিরাজমান থাকলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার কারণে সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমমূল্য, পারিশ্রমিক, মাতৃত্বসম্পর্কিত অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর হকগুলো কায়েম হয়েছে। কিন্তু এই প্রাথমিক দাবিদাওয়া বা অধিকার-সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে উপমহাদেশের নারীদের লড়াই চলছে, তাই সামগ্রিকভাবে নারীমুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের আলাপ তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে কখনো উঁকিঝুঁকি মারলেও, বাস্তবে তার রাজনৈতিক চেহারা খুব একটা চোখে পড়ে না, যেটা ইউরোপ-আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকায় একটা রাজনৈতিক ধারা হিসেবে ক্রমশ নিজের আকার-আকৃতি সুদৃঢ় করছে ইতিহাসের পাতা থেকে মুখ বের করে আজকের বাস্তবতায়।
বেগম রোকেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। প্রাতঃস্মরণীয় এই মহীয়সীকে তার লেখায় এবং সামাজিক উদ্যোগে নারীর সমানাধিকারের বিষয় নিয়ে এগোতে হয়েছে। মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী ও শরিয়তি ব্যবস্থা এবং ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে প্রবল বিক্রমে খাড়ায়ে থাকা পিতৃতন্ত্র যেভাবে মেয়েদের অবরোধবাসিনী করে রেখেছিল, সেখান থেকে বের করে এনে নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে সচেতন করার কাজ সাহিত্যে ও সামাজিক কর্মসূচিতে জারি রেখেছিলেন রোকেয়া। প্রথমত জগতের আলো-বাতাসের সংস্পর্শে মেয়েদের নিয়ে এসেছিলেন। দ্বিতীয়ত তাদের বৌদ্ধিক চেতনা বিকশিত করেছিলেন। এরপর, ভারতবর্ষের মহারাষ্ট্রে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালপর্বে সাবিত্রীবাই ফুলের কথাই ধরা যাক। জাতপাত বিরোধিতা, নারীদের বাইরে আনা, নারীশিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগে গ্রহণ করার মতো নানাবিধ কাজ করেছেন নিজের ইনডিভিজুয়াল জায়গা থেকেই। কামিনী রায়ও এ ক্ষেত্রে আলাদা কিছু নন। মহাশ্বেতা দেবী প্রান্তিক মানুষের লড়াইয়ে এবং আদিবাসী মেয়েদের জীবনসংগ্রামে সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন ব্যক্তি আকারেই। অন্যদিকে নিজের কাজের মধ্য দিয়ে নারীশিক্ষার ব্যাপারে মালালা তার জীবনকে দৃষ্টান্ত করে তুলেছেন। আর সমাজ-রাষ্ট্র-শ্রেণি ইত্যাদি বিষয়ে নিরন্তর প্রশ্ন, কাউন্টার লজিক ও বাহাস জারি রেখে আজকের এই গোলকায়নের যুগে নারীর অধিকারসংক্রান্ত আলাপের স্পেস তৈরি করছেন অরুন্ধতী রায়।
এবার আসা যাক ইলা মিত্র, গীতা মুখোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচীর মতো নারীনেত্রীদের কথায়। এরা কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করেছেন। শ্রেণির নিরিখে লৈঙ্গিক ক্ষমতার বিষয়গুলোর ব্যাপারে তাদের আলাপ করতেও দেখা গেছে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ, নারীবাদের ইতিহাসে দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার গঠনতন্ত্রে পরিচালিত হওয়া কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধেই পুরুষের আধিপত্যের অভিযোগ উঠেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের কমিউনিস্ট নারীবাদীরা পার্টির মধ্যে আন্তসংগ্রামের যে সুযোগ পেয়েছেন, উপমহাদেশের কমিউনিস্ট নেত্রীরা আর্থসামাজিক কারণেই তা পাননি। তারপরেও শ্রেণি-রাজনীতির ভেতরে থেকেই সমাজের অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্য দিয়ে নারীর অধিকারের ব্যাপারে আলাপ করতে দেখা গেছে তাদের।
ফুলন দেবীর ব্যাপারটা আলাদা। প্রত্যক্ষভাবে পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি সামাজিক যে দ্রোহ তৈরি করেছিলেন, তা নৈরাজ্যের আঙ্গিকে হলেও পিতৃতান্ত্রিক ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিপ্রতীপে নারীর বিদ্রোহের বিরাট একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অভিমুখ স্পষ্ট ছিল না। তাই সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে নিজের বিনির্মাণ ঘটিয়ে দাবিদাওয়ামূলক রাজনীতির পরিসরে আসতে হয়েছে তাকে। অন্যদিকে তারামন বিবির কথা যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার উঠে আসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শ্রেণি, বর্গ ও লৈঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপের এক পরিসর তৈরি হয়েছিল। বায়ান্নর ভাষাসংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অধিকার, রাষ্ট্রের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক এবং প্রান্তিক সমাজের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো আলোচ্য হয়ে ওঠে বাংলাদেশকেন্দ্রিক সমাজবিজ্ঞানের অধ্যয়নে। কিন্তু তারামন বিবিদের রাজনৈতিক দ্রোহ একটি কালপর্বে বড় আকার নিলেও শ্রেণি ও লিঙ্গের প্রশ্নগুলো যাতে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির নিগূঢ়ে সম্পৃক্ত না হতে পারে, তার জন্য তারামন বিবিদের ইতিহাসের পাতা থেকে সরেও যেতে হয়। এ-ও হয়তো পুরুষতন্ত্রের নির্মম পরিহাস।
ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের আগে থেকে কিছুদিন অবধি উপমহাদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সমাজে নারীকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় দেখা গেলেও ক্রমে পিতৃতন্ত্রের যে উত্থান উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে, তা আধুনিক সমাজের অন্তর্চেতনাতেও ক্রিয়াশীল। আর গ্লোবাল লগ্নিপুঁজি নারী স্বাধীনতার মন্ত্রকে সামনে রেখে এই অঞ্চলে হাজির করেছে পণ্যবাদী এক মার্কেট ফেমিনিজমকে। এখন এই অঞ্চলের পিতৃতন্ত্রের মূল পরিকাঠামো এবং রাজনীতিও গোলকায়নের বাজার রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই অঞ্চলে সন্তান উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি জরায়ুর ওপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছে।
পাশাপাশি এই অঞ্চলের কৃষি জগতের নানা বীজ দখল করে নিয়ে প্রকৃতি ও গণসভ্যতার মধ্যে অর্গানিক যে বিযুক্তি তৈরি করেছে, তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে কৃষিজীবী নারীদের ওপরেই। গোটা বিশ্বে যে ইকোফেমিনিজমের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে, সেই চর্চার মূল জায়গা হয়ে উঠতে পারে উপমহাদেশ, বিশেষত এই বঙ্গদেশ। কারণ, এখানে যেমন একদিকে প্রথমে নারীকে এবং তারপর সামগ্রিকভাবে গণসমাজকে উৎপাদনব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত করে দখল নেওয়া হচ্ছে জল-জমি-জঙ্গলের, তা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে প্রকৃতিনিবিড় নারী রাজনীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, পুরুষ ও প্রকৃতির যুগল এবং অর্ধনারীশ্বরের দার্শনিক চিন্তা এই বঙ্গদেশের। মোট কথা, আজকের গোলকায়নের যুগে প্রকৃতি, নারী ও কৃষির মেলবন্ধনে তৈরি হতে পারে এমন এক সম্ভাবনা, যা উপমহাদেশে নারীবাদের ইতিহাসে নয়া মাত্রা তৈরি করতে পারে।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top