skip to Main Content

ফুড বেনিফিট I দামের বাদাম

দেহমনে সুস্থতা দেয় বাদাম। এর পুষ্টিগুণের তুলনা নেই। কিন্তু সহজলভ্য। আর বেশি যে খেতে হয়, তা নয়

‘ঈশ্বর আমাদের বাদাম দিয়েছেন, কিন্তু তিনি সেটা ভেঙে দেন না’- বলেছেন জার্মান সাহিত্যিক ফ্রান্জ কাফ্কা। কাঠবাদামখেকোরা বলতে পারবেন, এই ভেঙে খাওয়ার সংগ্রামটা কত জরুরি। তিন দফা খোলস ছাড়ানোর পর বেরোয় কাঠবাদাম। আর যাদের চীনাবাদাম ছিলতেই ভীষণ আলসেমি, তাদের কাছে এটা তো বিভীষিকা! তবে বাদাম ছেলায় যতই আলসেমি থাক না কেন, খাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু কারোরই আলসেমি নেই!

জনপ্রিয়তার বিচারে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বাদাম হলো আমন্ড। এশিয়ার এই বাদাম ফারাওরা খেতেন রুটির ভেতরে দিয়ে, পরবর্তীকালে সিল্ক রুটের ব্যবসায়ীরা খেতেন ক্ষুধা নিবারণের জন্য। বাদামের প্রধান গুণ- অল্প খেলেই মনে হয়, পেট ভরে গেল। ফলে এটা যেমন স্বাস্থ্যকর, তেমনি পকেটের পক্ষেও সুবিধাজনক। আমাদের এদিকে বেশ ভালো জাতের কাঠবাদাম হয়, যাকে ইন্ডিয়ান আমন্ড বা জংলি কাঠবাদাম বলা হয়। এতে অন্যান্য আমন্ডের তুলনায় বেশি ফাইবার, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিকণা থাকে, যা হৃদ্যন্ত্রের জন্য বেশ উপকারী। জংলি কাঠবাদাম ছাড়াও স্প্যানিশ মারকোনা আমন্ডের সুনাম রয়েছে মিষ্টি ও অভিজাত স্বাদের জন্য। এরপর আসে ক্যাশোনাট বা কাজুবাদাম। পূর্ব আফ্রিকার পর্তুগিজ কলোনি থেকে ভারতে এসে খুব দ্রুত জায়গা করে নেয় মোগল রসুইয়ে। এই বাদামে স্টার্চের পরিমাণ বেশি; ফ্যাট জাতীয় উপাদানের চেয়ে। তবে কাঠবাদাম আর কাজুবাদাম- দুটো দিয়েই অসাধারণ বাটার হয়। হ্যাজেলনাটের উৎপত্তি নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা থাকলেও প্রাচীনকাল থেকেই পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় এর চাষ হয়ে আসছে। এখন সবচেয়ে বেশি হ্যাজেলনাট উৎপাদন করে তুরস্ক। চকলেট আর কফিতে এই বাদামটাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীখ্যাত ব্রেডস্প্রেড নাটেলাতে এই বাদামের উপস্থিতি রয়েছে। তিতকুটে স্বাদের মেহগনি-রঙা খোসা ছাড়ালেই মিষ্টি হ্যাজেলনাট বেরিয়ে আসে, যা একই সঙ্গে যেকোনো মাংস বা সুইট ডিশকে কমপ্লিমেন্ট করে। আমাদের চেনাজানা ‘চীনা’ বাদামের অতীত চীনের কোথাও নয়, ব্রাজিলে। ভাস্কো দা গামার পথের অনুসারী হয়ে জেসুইট পাদ্রিদের সঙ্গে চীনাবাদামের আগমন ঘটে ভারতবর্ষে, আর পরবর্তী দুই শতকে ভারতের প্রধান এক কৃষিপণ্যে পরিণত হয় চীনাবাদাম। পৃথিবীতে যত চীনাবাদাম খাওয়া হয় বাদাম হিসেবে, তার চেয়ে সাত-আট গুণ তেল বা বাটার হয়ে চলেছে। এ ছাড়া থাই বা ওরিয়েন্টাল কিছু ডিশে চীনাবাদাম গুঁড়া গার্নিশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রিচ, ক্রিমি, বাটারি- পেকান সম্পর্কে বলতে গেলে এই তিনটি শব্দ আসবেই। আমেরিকার নেটিভ এই বাদাম ইদানীং বেশ চড়া দামে বিকোচ্ছে। কারণ কয়লাভিত্তিক এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে সৃষ্ট দূষণে আমেরিকার পেকান বাগানগুলো এখন ধ্বংসের কাছাকাছি। ফলে উৎপাদন কম। পাইন নাট মূলত পাইনগাছের কোন থেকে সংগ্রহ করা হয় আর পৃথিবীব্যাপী এর একাধিক উপপ্রজাতি রয়েছে। অসাধারণ স্বাদের জন্য পেস্তো থেকে কুকিজ- সবকিছুতেই ব্যবহার করা যায় এই বাদাম। পিস্তাচিও বা পেস্তাবাদামের জন্ম মধ্যপ্রাচ্যে। ক্যালসিয়ামে ভরপুর এই বাদামের ভেতরের সবুজ রঙের পেছনে রয়েছে ক্লোরফিলের হাত। মধ্যপ্রাচ্যের মিষ্টিতে বেশ কমন এই পেস্তা বাদাম। ওয়ালনাট সাধারণত দুই ধরনের- পার্সিয়ান আর আমেরিকান। এতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের আধিক্য লক্ষণীয়। ওয়ালনাট সাধারণত বেকিংয়ে ব্যবহৃত হলেও স্যালাড বা ঝাল কোনো ডিশের গার্নিশিং হিসেবেও খারাপ নয়।
ভিটামিন, মিনারেল, পুষ্টিকণা ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বাদামের শক্তির আধার। এটি রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে, অবসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, পিত্তের পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমায়, মোটা হওয়া থেকে রক্ষা করে, কোলন ও পাকস্থলীর ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়, প্রজননশক্তি বাড়ায়। বাদামে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, নিয়াসিন, রিবোফ্লোভিন, থিয়ামিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিডের মতো ভিটামিনের পাশাপাশি পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, সেলেনিয়াম ও জিঙ্ক রয়েছে। চীনাবাদাম স্নায়ুর রোগ থেকে রক্ষা করে ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। রক্তে ভালো কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়। কমায় খারাপ কোলেস্টেরল। বাদামের মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড করোনারি ডিজিজ থেকে সুরক্ষা দেয়। প্রোটিন ও অ্যামিনো অ্যাসিড শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করে।
ত্বক সুরক্ষায়ও চীনাবাদাম অপ্রতিরোধ্য। এর বিটা ক্যারোটিন ত্বকের কোষগুলো মেরামত করে। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ফুসকুড়ি, ব্রণ ইত্যাদি কমায় ও ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে। ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো চাপ নিয়ন্ত্রণ ও মনোভাব বদলে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর ফলে চেহারায় বয়সের ছাপ- রিঙ্কল, ফাইন লাইন, ফ্যাকাশে ভাব আসে না। পিনাট বাটার কেবল খেতেই ভালো নয়, বেশ ভালো ফেস ক্লিনজার। বাদামে থাকা আঁশ শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদানগুলো নির্মূল করে এবং ত্বক উজ্জ্বল করে তোলে। চীনাবাদামের ম্যাগনেসিয়াম আমাদের স্নায়ু, শরীর ও রক্তকণাকে সচল রাখে। ফলে স্বাস্থ্যকর ত্বক পাওয়া যায়। অক্সিডেশনের ফলে ত্বকের যে ক্ষতি হয়, বাদামের ভিটামিন ই সেটা পূরণ করে। একই সঙ্গে সূর্যের ইউভি রশ্মি থেকেও সুরক্ষা দেয়। চীনাবাদাম থেকে কোলাজেন তৈরির জন্য ভালো পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। কোলাজেন তরুণাস্থি, টেন্ডন এবং ত্বকের কাঠিন্য ও নমনীয়তা নিয়ন্ত্রণ করে তারুণ্য ধরে রাখে।
চুলের যত্নেও বাদামের ভূমিকা রয়েছে। ভিটামিন ই, ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাবে চুল পড়ে যেতে পারে, যা বাদামে থাকা ভিটামিন ই রোধ করে। বাদাম খেলে বা বাদামের তেল মাথায় দিলে চুল পড়া অনেকাংশে কমে। ফ্যাটি অ্যাসিড চুল নতুন করে গজাতে সাহায্য করে। বাদাম থেকে পাওয়া অ্যামিনো অ্যাসিড চুলের গোড়া পর্যন্ত রক্ত চলাচল নিশ্চিত করে ছেলেদের চুল পড়া থেকে রক্ষা করে।
বাদামের যেমন সুফল রয়েছে, তেমন রয়েছে কুফলও। তবে সেটা কেবল অতিরিক্ত খেলেই! প্রথমত বাদামে প্রচুর ক্যালরি রয়েছে, যা স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের জন্য মোটেও ভালো নয়। বাদামের আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট তো রয়েছেই, প্যাকেটজাত বাদামে অন্যান্য প্রিজারভেটিভ ও কেমিক্যাল মিলে সোডিয়াম ও সুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। বাদামে থাকা অক্সালেট কিডনির পাথরের কারণ হতে পারে। আর যে বাদাম আপনাকে ত্বকের সুরক্ষা দিচ্ছে, অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়ার ফলে সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। তাহলে একজন মানুষের কতটুকু পরিমাণ বাদাম প্রয়োজন- খুব কম, প্রতিদিন মাত্র ২৮ গ্রাম!

ছবি: সংগ্রহ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top