skip to Main Content

কভারস্টোরি I তৈজসের কারুকাজ

খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল না বাসনকোসনের গুরুত্ব। এর সৌন্দর্যের দিকেও মানুষের আগ্রহ ছিল। প্রাগৈতিহাসিক কালেও। আজ অব্দি তা অব্যাহত। অধিকন্তু এখনকার পাত্রে নতুন আঙ্গিকে যোগ করা হচ্ছে পুরোনো মটিফ। ফলে ইন্ডাস্ট্রি ও আর্টে ঘটছে বৈচিত্র্যপূর্ণ মেলবন্ধন। লিখেছেন কনক বিশ্বাস

অর্থপূর্ণ আবেগ থেকেই শিল্পকলার জন্ম। নানান উপলব্ধি ও বোধ, জীবনকে দেখার বিভিন্ন সূত্র মানুষ বিভিন্নভাবে, রঙে-রেখায়, ভাষায়, সুরে প্রকাশ করে থাকে। এভাবে সৃষ্টি হয় শিল্পের। আদিম যুগের মানুষেরাও তাদের উপলব্ধির প্রকাশ ঘটাত বিচিত্র রেখাচিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে। কেবল শিল্পের চর্চার জন্য আলাদাভাবে চিন্তার বাইরেও মানুষ প্রতিদিনের জীবনে আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ প্রকাশের জন্য বেছে নেয় শিল্পের নানান মাধ্যম। সুরে, রঙে, নৃত্যে অথবা কেউ কেবলই ঘর-গেরস্থালি সাজাবার কাজেই নিজের শৈল্পিক মনের পরিচয় দিয়ে চলে। তা কেবল নাগরিক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মনের মধ্যেই বিরাজ করে না, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গ্রামের খেটে খাওয়া নারী-পুরুষ- সবারই রয়েছে নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি। তাদের এসব শিল্পচিন্তার প্রকাশ দেখে কখনো কখনো অবাক হতে হয়। প্রান্তের জনগোষ্ঠীর সৌন্দর্যবোধ প্রকাশের রয়েছে নিজস্বতা। যেটাকে বলা হচ্ছে লোকশিল্প। তৈজসপত্রের ইতিহাস বা তার কারুকাজে সেই ধারাবাহিকতা দেখা যায়।

টেবিলওয়্যার: বাসনওয়ালা

কোনো কোনো পরিবারে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রক্ষিত মাটির পট, ধান রাখার মটকা, বাসনকোসন ইত্যাদির নানান মটিফ লোকসমাজের শিল্প হিসেবে আজও অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে। সেই পুরোনো তৈজসপত্রের অপরূপ কারুকাজ এখন আর কোথাও দেখা যায় না। অথচ অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত আঙ্গিকের এসব শিল্প সহজেই সাধারণ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে উদ্ভব ঘটেছিল তৈজসপত্রের?
বলা যায়, শিল্প মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন ও আদিম। রাতারাতি তা গড়ে ওঠেনি। এর উদ্ভব ও বিকাশ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন, রুচি ও মননের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই ‘পৃথিবীর বুকে মানুষের জীবন সব সময় “পায়ের চিহ্ন” রেখে গেছে, এর ব্যতিক্রম কখনো ঘটেনি।…বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন,…প্রাচীন মানুষের জিনিসপত্র দেখাও আমাদের, অমনি বলে দেব তারা কী করত, তাদের জ্ঞানবুদ্ধি কী রকম ছিল, কীভাবে বেঁচে ছিল তারা’। [ফিওদর করোভকিন, পৃথিবীর ইতিহাস : প্রাচীন যুগ] এভাবেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন আদিম যূথবদ্ধ জনগোষ্ঠীর শ্রমের হাতিয়ার, পাথুরে অস্ত্র, কাঠের লাঠি ও মাটি খোঁড়ার শাবল, হাড়ের তৈরি হারপুন, কৃষিজ যন্ত্রপাতি, ব্যবহার্য তৈজসপত্র ইত্যাদি। হোমোসেপিয়েন্স তার চারপাশে যা দেখেছে, তার অনেক কিছুই তাদের শিল্পমাধ্যমে ধরে রেখেছে। জনৈক স্পেনীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ আবিষ্কার করেন গুহার ছাদে আদিম মানুষের আঁকা ‘ম্যামথ’, ডালপালার মতো বাঁকানো শিংওয়ালা হরিণ, বাইসন, আহত, রক্তাক্ত ভালুক, পরিত্যক্ত তৈজস ইত্যাদি। এই আবিষ্কারের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় এসব শিল্পচর্চার ইতিহাস।
অর্থাৎ দৈনন্দিন প্রয়োজনেই তৈজসপত্রের উদ্ভব ঘটে। আদিম মানুষেরা অতিকষ্টে সংগৃহীত খাদ্য, পানীয়সহ জীবনধারণের কিছু সামগ্রী দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণের জন্য পাত্র তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তখন তারা টুকরো টুকরো পাথরের গর্ত অথবা গাছের চওড়া ছাল তৈজস হিসেবে ব্যবহার করত। ধীরে ধীরে তারা মৃৎপাত্র তৈরি করতে শেখে। কিন্তু কাঁচা মাটির পাত্র বেশি দিন ব্যবহার করা যায় না, আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করার পরই তারা কোনো এক সময় জেনেছিল, পোড়ানো মাটি শক্ত ও টেকসই। ‘পৃথিবীর ইতিহাস : প্রাচীন যুগ’ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘কৃষিকাজ ও পশুপালনের সঙ্গে সঙ্গে তখনকার মানুষদের মধ্যে আরও একটি জিনিস আবির্ভূত হলো- হস্তশিল্প অর্থাৎ কারিগরি।…হাতের কাজ করত যেসব কারিগর বা হস্তশিল্পী, তাদের বেশির ভাগই পাথর নিয়ে ব্যস্ত থাকত: প্রায় ৭ হাজার বছর পূর্বে পাথর ছিদ্র করা বা তাকে ঘষেমেজে মসৃণ করা ইত্যাদি তারা শিখে নিয়েছিল। কাঁচা মাটি পুড়লে শক্ত কঠিন হয়ে যায় দেখে তারা হাঁড়ি, থালা-বাটি ইত্যাদি মাটি দিয়ে তৈরি করে পোড়াতে লাগল। মাটি ও পাথর থেকে তারা চুলাও তৈরি করল।’ সেসব তৈজসে আঙ্গিকের নির্দিষ্ট একটা ধরন ছিল, তাতে নকশার নানান মটিফ যোগ হয় আরও পরে।

দুই
ভৌগোলিক ও পেশাগত কারণে তৈজসপত্রের উপকরণে বৈচিত্র্য দেখা গেছে। জৈব উপাদানের বেশ পরে মানুষ শিখেছে ধাতুর ব্যবহার। সেসব আজ লোকশিল্প হিসেবে পরিচিত। তবে তার কিছু মটিফ নতুন করে আবার ফিরে এসেছে। এ কারণে তৈজসের কারুকাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লোকশিল্পের সেই আঙ্গিক সম্পর্কেও বলা দরকার। লোকশিল্প মূলত পুরুষানুক্রমে প্রচলিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির রূপায়ণ। ১৮৪৬ সালে ইংল্যান্ডের গবেষক উইলিয়ম থম্স দি অ্যাথেনিয়াম পত্রিকায় লিখিত একটি পত্রে ফোকলোর শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর থেকে এর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক তর্কবিতর্কের সৃষ্টি হয়। কেননা লোকশিল্প কেবল মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে রক্ষিত হয় না। সাহিত্য, সংগীত ছাড়াও চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাচ, আলপনা, তৈজসপত্র ইত্যাদিও এর মধ্যে পড়ে। ড. মযহারুল ইসলাম ফোকলোরে দৃশ্যশিল্প হিসেবে লোকচিত্রকলা বা অংকনশিল্প, লোকভাস্কর্য, লোকস্থাপত্য, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, নকশিকাঁথা, লোকপুতুল, লোকজ খেলনা, মৃৎশিল্প, লোকপ্রতিমা, আলপনা, পিঠা, আলপনা ও পিঠার নকশা, অলংকার, বাসনকোসন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
গবেষকদের মতে, লোকশিল্পের এই আঙ্গিকের মোটামুটি সুগঠিত রূপ তৈরির চল শুরু হয় মাটি দিয়ে। তৈজসপত্র নির্মাণে ধীরে ধীরে পাথর, ধাতু ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে।
কিন্তু কবে থেকে মানুষ মৃৎপাত্র তৈরি করতে শুরু করেছিল এবং কোন সভ্যতার জনগোষ্ঠী প্রথম এই শিল্পে অবদান রাখে, তা নির্ণয় করা কঠিন। যদিও ইতিহাসবিদেরা এ নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন বেশ আগে থেকেই। তবে অনুমান করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যেই প্রথম মাটির পাত্র তৈরি শুরু হয়। প্রত্নতত্ত্ববিদ জেমস মেলার্ট তুরস্কের আনাতোলিয়া উপত্যকা খনন করে ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে নানান ধরনের মাটির পাত্র উদ্ধার করেন। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা হয়, পাত্রগুলো কমপক্ষে ৯ হাজার বছর আগের তৈরি। খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ছয় হাজার অব্দে আরও উন্নত মানের হাতে তৈরি, পোড়ানো এবং রং করা মাটির পাত্রও একই জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্দ উলে ৩ হাজার বছর আগের তৈরি মাটির পাত্র আবিষ্কার করেন।
সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে [এখন পাকিস্তান] মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করা হয় মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও লেখক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ননীগোপাল মজুমদার এই সভ্যতা দুটি আবিষ্কার করেন। এর ধ্বংসাবশেষ থেকেও মৃৎপাত্রের অনেক নমুনা পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদারোর মাটির পাত্রগুলোতে রয়েছে লতা-পাতা, ফুল, ফল, পশু-পাখি, চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতির মটিফ।
এ ছাড়া বেলুচিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে যেসব বসতি গড়ে উঠেছিল, তারা বাড়ি তৈরি করত কাদামাটি দিয়ে। কোয়েটা, মাল ও কুল্লিতে পাওয়া গেছে মেটে রঙের নানা ধরনের মৃৎপাত্র। কোয়েটায় পাওয়া সেই বাসনকোসনগুলো অলংকারহীন। এ ধরনের নকশাবিহীন মৃৎশিল্প অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি।
বৈদিক যুগের মানুষও মাটির পাত্রের ওপর নানা রকম নকশা অঙ্কন করত। মৌর্য, কুষাণ ও গুপ্তযুগের বিভিন্ন মৃৎপাত্রের নমুনা পাওয়া গেছে মাটি খুঁড়ে। এসব তৈজসের মাধ্যমে সে যুগের মানুষের জীবন-যাপনের ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে। বৈদিক যুগে প্রতিমা পূজার প্রথা ছিল, তখনকার পোড়ামাটির অনেক প্রতিমা পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে মৃৎপাত্রের ধারাবাহিকতা ও বিকাশ প্রকৃতপক্ষে ওই ঐতিহ্যেরই ফল। সেসব তৈজসে পৌরাণিক নানান চরিত্র, লতাপাতা, ফুলের মটিফ চিত্রিত হতে দেখা গেছে। আলপনার মটিফও সেসবের উল্লেখযোগ্য কারুকাজ।
গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ও মধ্যভারতজুড়ে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু করে দ্বিতীয়-তৃতীয় খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পোড়ামাটির যে শিল্পধারা গড়ে উঠেছিল মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুর, পোখরান, তমলুক, মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলী, বীরভূম প্রভৃতি এলাকায় আবিষ্কৃত প্রাচীন পোড়ামাটির ফলকে তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন ধরা পড়ে। উল্লেখ্য, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুরের মৃৎফলকে মানুষ ও জীবজন্তুর চিত্রই বেশি ছিল। মুসলিম শাসন আমলের মসজিদ, মাজার ইত্যাদি ইমারতে যেসব চিত্রফলক ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোতে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর ছবি নেই, রয়েছে লতা-পাতা, গাছ-পালা ইত্যাদির ছবি। তবে হিন্দু-বৌদ্ধদের মঠ ও মন্দিরের মৃৎফলকে মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি পাওয়া গেছে। তৈজসপত্রের মটিফেও তার প্রভাব রয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটি মসৃণ, রোলেটেড। কতগুলোতে লতাপাতা, পূজার আলপনা, পৌরাণিক দেবদেবী ইত্যাদির মটিফ রয়েছে।
পুন্ড্ররবর্ধনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহারে এবং পুন্ড্ররাজ্যের রাজধানী পুন্ড্রবর্ধনের মৃৎপাত্রের ঐতিহ্য এই অঞ্চলের মৃৎশিল্পের গৌরব বহন করে আসছে। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জায়গার মধ্যে দিনাজপুর জেলার সীতাকোট বিহার, রংপুর জেলার বোগদহ, সিরাজগঞ্জ জেলার তারাস থানার নিমগাছি, রাজশাহীর বিজয়নগর, নওগাঁর ধামইরহাট, বগুড়ার ক্ষেতলাল, নীলফামারীর ধর্মপালগড়েও একই ধরনের শিল্পকর্ম পাওয়া গেছে। ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলার উয়ারী ও বটেশ্বর নামক পাশাপাশি দুটি গ্রামে বিভিন্ন নিদর্শনসহ পাওয়া গেছে উত্তর অঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, রোলেটেড মৃৎপাত্র, নব্যুক্ত মৃৎপাত্র। আলাদা কোনো মটিফ এগুলোতে আঁকা হয়নি বললেই চলে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া মৃৎপাত্রের নানান ধরনের নমুনা দেখে ধারণা করা যায়, এ শিল্প প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বিকশিত হয়ে আসছে। এর পেছনে রয়েছে এ দেশের পেশাজীবী মানুষের অবদান। বৈদিক কাল থেকে কুম্ভকার বা কুমার নামে পরিচিত এই পেশাজীবী শ্রেণির উপাধি ‘পাল’। তবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে, উখিয়া থানার রাজাপালে, নোয়াখালী অঞ্চলে অনেক মুসলমান মৃৎশিল্পী বাস করে। এদের উপাধি ‘কুলাল’। এদের লোকজ শিল্পবোধ ও অঙ্কনশৈলী নির্মিত তৈজসে ফুটে ওঠে। ফুল, লতাপাতা, পশু-পাখি, চাঁদ-সূর্যের মটিফ ছাড়াও সেসবে আঁকা হয় নানান দৃশ্যপট, ঐতিহাসিক ঘটনার চিত্র, এমনকি বিখ্যাত ব্যক্তির প্রতিকৃতিও। ফলে লোকশিল্পের গল্প থেকে এখনকার কারিগরেরা সরে এসেছেন, রূপ দিয়েছেন সমকালীন জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের মটিফ। আগের প্রাকৃতিক রং বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে কেমিক্যাল বা প্লাস্টিক কালার।

তিন
সভ্যতা বিকাশের সঙ্গেও রয়েছে ব্যবহার্য তৈজসের নানান মটিফ এবং আঙ্গিকের সম্পর্ক। যেমন গ্রিসে হোমারের নামানুসারে শুরু হয়েছিল হোমেরিক যুগ। অন্যদিকে জ্যামিতিক শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যের কারণে সময়টিকে জ্যামিতিক যুগও বলা হতো। এটি মিসিনিয়ান সভ্যতার শেষ দিকে খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৯ম শতাব্দীর কথা। তখনকার বেশির ভাগ তথ্য পাওয়া যায় সমাধি ও সমাধিস্থ দ্রব্যাদি থেকে। সেখানে পাওয়া তৈজসপত্রের ধরনে তাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতার পরিচয়ও গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন। সেগুলো ছিল প্রোটো জ্যামিতিক নকশার, যা আগের থেকে কম জটিল, অপেক্ষাকৃত সরল। এ সময় তারা উন্নত তৈজস তৈরির জন্য কুম্ভকারদের চাকা এবং অলংকরণের কাজে নির্ভুলভাবে বৃত্ত ও অর্ধবৃত্ত আঁকাতে কম্পাসের ব্যবহারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। উচ্চ তাপমাত্রায় কাদামাটি পুড়িয়ে আরও চকচকে করা হতো। এসব তৈজসে হোমারের মহাকাব্যের বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনার মোটিফ অঙ্কিত হতো। এখন আবার নতুন করে সেসব কারুকাজ তৈজসে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
বাসনকোসনে ধাতুর ব্যবহারও বেশ প্রাচীন। ব্রোঞ্জ-কাঁসা-পিতল-তামা তো বেশ আগে থেকেই ছিল। এই উপমহাদেশে পাল আমলে এই শিল্পের যাত্রা শুরু বলে ধারণা করা হয়। যদিও এখন ওই সব ধাতু যুদ্ধাস্ত্রসহ মূল্যবান দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহারের কারণে সেগুলোর তৈজস সাধারণের ক্রয়সীমার মধ্যে নেই। এখন অবশ্য সেসব শৌখিন উপকরণ হিসেবে দেশে-বিদেশে বেশ কদর পাচ্ছে। সে যা-ই হোক, এসব ধাতব পাত্রের কারুকাজ শিল্পে সব সময়ই বেশ উল্লেখযোগ্য হিসেবে বিবেচিত। কারণ, সম্ভবত এগুলোর স্থায়িত্ব, আভিজাত্য ও ধর্মীয় আবেগ। কাঁসা-তামা-পিতলের কিছু তৈজস গ্রামের সাধারণ মানুষ ব্যবহার করলেও এসবের বেশির ভাগই ব্যবহৃত হতো জমিদার বা ধনীদের গৃহে। সেসবের মটিফও হতো দৃষ্টিনন্দন। দৈনন্দিন প্রয়োজনের পাশাপাশি এসব তৈজস পূজা-পার্বণে, উৎসব-অনুষ্ঠানে ব্যবহারের প্রচলনই ছিল বেশি। ফলে সেগুলোর নকশায় ছিল ফুল, লতাপাতা, আলপনা, সূর্য, পশুপাখি বা পৌরাণিক চরিত্র। মটিফগুলোতে বৃহত্তর অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির প্রভাব ফুটে উঠতে দেখা গেছে। এখন, নাগরিক জীবনে সেসব ধাতব পাত্রের প্রচলন আবার শুরু হয়েছে। কখনো কখনো তাতে রঙের ব্যবহারও করা হয়ে থাকে।
এসব সোনালি ধাতব পাত্রের চেয়ে এখন মেলামিন, সিরামিক বা স্টিলের তৈজস সস্তা। তা ছাড়া যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি হচ্ছে বলে তা নিখুঁত। কারুকাজ ও রঙের বৈচিত্র্যে নজরকাড়া। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এগুলো যতই নান্দনিক হোক না কেন, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের বিচারে, উৎসবে-অনুষ্ঠানে, পূজা-পার্বণে এখনো মানুষ পুরোনো দিনের তৈজসের গুরুত্বই অনুভব করে।

চার
প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে প্লাস্টিক সামগ্রী সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য হওয়ায় তৈজসপত্রের আদি উপকরণগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে এসব শিল্পীর একটি ছোট অংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা শিল্পসামগ্রীর রপ্তানিকারক ও দেশীয় বিপণনকাজে নিয়োজিত সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন আঙ্গিকে সেসবের বিকাশ ঘটাচ্ছে। ঢাকার রায়েরবাজার, সাভার, নবীনগর, রাজশাহী, পাবনা, রাজবাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, হাটহাজারী, নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চলে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও মৃৎশিল্পের পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন কিছু মানুষ। তবে একথা সত্য যে, দিনে দিনে এই শিল্পে নিয়োজিত শিল্পী-পরিবারের সংখ্যা কমছে। অন্যদিকে কাঁসারি বা ধাতব পাত্র তৈরির কারিগরদেরও একই অবস্থা; বরং তার চেয়ে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মেলামিন, সিরামিক বা স্টিলের বাসনকোসন। এখন তৈজসশিল্পীরা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে। অবশ্য এসব শিল্পের প্রায় সবটাই শৌখিন বস্তু হিসেবে তৈরি হচ্ছে। ফিরিয়ে আনা হচ্ছে পুরোনো নকশার নানান মটিফ।

সহায়ক গ্রন্থাবলি
ফিওদর করোভকিন, পৃথিবীর ইতিহাস : প্রাচীন যুগ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৬
সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস, প্যাপিরাস, ঢাকা ১৯৯৬
ড. মযহারুল ইসলাম, ফোকলোর : পরিচিতি ও পঠন-পাঠন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৪
তোফায়েল আহমেদ, আমাদের প্রাচীন শিল্প, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯২
শফিকুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশের মৃৎশিল্প, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৫
ছোটদের বুক অব নলেজ, দেবসাহিত্য কুটির, কলিকাতা, ১৯৭৯
লোকসংস্কৃতি, সম্পাদক : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ডিসেম্বর ২০০৭

কভার : অভিনেত্রী জয়া আহসান
মেকওভার : পারসোনা
ফ্যাশন ডিরেকশন: মাহমুদুল হাসান মুকুল
ওয়্যারড্রোব : কিয়ারা
জুয়েলারি: স্পার্কেল
ছবি : জিয়া উদ্দীন

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top