skip to Main Content

ফিচার I বাবু কালচার

নবাবদের দেওয়া উপাধি। যদিও পরবর্তীকালে এর পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটেছে। ভোগবিলাস আর অপচয় ছিল তাদের সংস্কৃতি। লিখেছেন মনোজ দেব

‘ধন্য ধন্য ধার্মিক ধর্মাবতার ধর্মপ্রবর্তক দুষ্টনিবারক সৎপ্রজাপালক সদ্বিবেচক ইংরাজ কোম্পানী বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া স্বর্ণকার বর্ণকার কর্মকার চর্মকার চটকার পটকার মঠকার বেতনোপভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের খাটের ঘাটের মাঠের ইটের সরদারি চৌকিদারি জুয়াচুরি পোদ্দারী করিয়া অথবা অগম্যাগমন মিথ্যাবচন পরকীয়রমণীসংঘটনকামি ভাঁড়ামি রাস্তাবন্ধ দাস্য দৌত্য গীতবাদ্য তৎপর হইয়া কিম্বা পৌরোহিত্য ভিক্ষাপুত্র গুরুশিষ্য ভাবে কিঞ্চিৎ অর্থসঙ্গতি করিয়া কোম্পানীর কাগজ কিম্বা জমিদারী ক্রয়াধীন বহুতর দিবসাবসানে অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন…’
এভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ‘নববাবুবিলাস’ বইয়ে শ্রী প্রমথনাথ শর্মা ছদ্মনামে শ্রী ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার বাবুদের পরিচয় লিখেছিলেন। তখন অবশ্য ধনী ও শিক্ষিতদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। শব্দটি আগে থেকে এটি ব্যবহারের অধিকার কারও ছিল না। এটা ছিল নবাবদের দেওয়া উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া কাউকে তারা এই পদবি দিত না। তবে ইংরেজ শাসন শুরুর পর ‘বাবু’ নামে নতুন এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সবাই যেখানে-সেখানে বাবু বনে গেল। পুরোনো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিল। আবির্ভূত হলো নব্য ধনিক শ্রেণি। এরাই তখন ‘বাবু’।
মূলত কলকাতার বনেদি অঞ্চলেই বাবুদের উত্থান ঘটেছিল। বাগবাজার, শোভাবাজার, চিৎপুর—এসব এলাকার জমিদার বা ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকেই।
প্রমথনাথ শর্মার লেখা থেকে আন্দাজ করা যায়। সাধারণের পক্ষে বাবু হওয়া সম্ভব ছিল না। তা হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করতে হয়। চার ঘোড়ায় টানা গাড়ি হাঁকিয়ে ভেঁপু বাজিয়ে গঙ্গা স্নানে যাওয়া, দু-একটা রক্ষিতা রাখা, তাদের বাড়ি বানিয়ে দেওয়া, কবুতর ওড়ানো, বাইজিদের আসর বসানো ইত্যাদিও করতে হতো। এসব পাল্লা দিয়ে করতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছে। কিন্তু যার এসব শৌখিনতা করার সামর্থ্য নেই, সে আর যা-ই হোক বাবু হতে পারবে না।
তখন বাবুদের ছিল বাইজি বাড়ি। জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে, কবজিতে বেলিফুলের মালা জড়িয়ে, আতর মেখে, গিলে করা পাঞ্জাবি আর জরিদার ধুতি পরে তারা বাইজিদের বাগানবাড়িতে যেত। এক হাতে থাকত ধুতির খুঁট, অন্য হাতে সাদা রুমাল অথবা হাতির দাঁতের বাঁটওয়ালা ছড়ি। সবাই ছিল মেজাজি। ইয়ারদোস্ত নিয়ে, টাকা উড়িয়ে, মদ-মাংস খেয়ে গভীর রাতে নেশায় বুঁদ হয়ে তবেই বাড়ি ফিরত। কখনো কখনো এসব বারাঙ্গনা বা বিশ্বস্ত চাকর-বাকরকে নিজের আঙুল থেকে হীরার আংটি খুলে দিয়ে দিত। কেউ কেউ থেকে যেত বাইজির সঙ্গে। হঠাৎ কোনো বারাঙ্গনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তাকে নিজের বাঁধা মেয়েমানুষ হিসেবে রাখবার জন্য ধনীর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। লক্ষেèৗ বা বেনারস থেকে আনা হতো বিখ্যাত বাইজি। আসত সারেঙ্গি, সানাই। জলসা চলত রাতভর। বাদ্যযন্ত্রে বাজত কখনো মালকোষ, বাগেশ্রী বা দরবারি কানাড়া। বারাঙ্গনাদের দেওয়া হতো মোহর, বেনারসি ও অন্যান্য মূল্যবান উপহার। কখনো বাবুদের শয্যায় তাদের স্থান হতো। বৈঠকখানায় ঝুলত বেলোয়ারি ঝাড়, তাতে জ্বলত বিদেশ থেকে আনা মোমবাতি। এগুলো ছিল বাবু কালচারেরই অংশ।
বাবুদের সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘বাবু মহাশয়েরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, ফুল আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রিকালে বারাঙ্গনাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদ-প্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইতেন।’
উনিশ শতকের আরেকজন লেখক কালিপ্রসন্ন সিংহের রচনা থেকে জানা যায়, তখন রাজরাজড়া রাতে নিজের স্ত্রীর মুখ দেখত না। বাড়ির প্রধান কর্মচারী, চাকর, দারওয়ান, মুৎসুদ্দিরা মালিকের বিষয়সম্পত্তি দেখত। স্ত্রীদের দেখভালোর দায়িত্ব ছিল তাদের। কলকাতার আট বাবুÑনীলমনি হালদার, রামতনু দত্ত, গোকুল চন্দ্র মিত্র, রাজা রাজকৃষ্ণ, ছাতু সিংহ [ইনি কালিপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ], দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু—বাবুয়ানিতে এদের পরিচিতি ছিল। পরে আরও কয়েকজনের নামডাক হয়েছিল, তবে এই আটজনই ছিল কলকাতার প্রথম ‘বাবু’। তার আগে সনাতন ধর্মের সব আচার অনুষ্ঠান নিয়ম মেনে পালিত হতো। তাদের স্ত্রীদের নির্দেশে অন্দরমহলে পুরোহিত রেখে এসব পালন করার চল ছিল। অন্যদিকে বাড়ির বাইরে তারা সব শাস্ত্র উপেক্ষা করত।
এমনকি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরও ছিলেন এই সংস্কৃতির ধারক। তিনি গোমাংস খেতেন, ইংরেজদের সঙ্গে বসে মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে হইহুল্লোড় করতেন। তার বাগানবাড়িতে প্রায়ই বাইজিদের নাচের আসর বসত। তার স্ত্রী নিজের বাড়িতে ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। যদিও ঠাকুর পরিবার পরবর্তীকালে ব্রহ্মধর্ম গ্রহণ করে। প্রথম জীবনে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করলেও পরে হলেন জমিদার। খনি ও জাহাজ ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকার।
কলকাতা শহরের এই রঙ্গ—ঘরে এক, বাইরে অন্য। এটা আঠারো-উনিশ শতকে উচ্চবিত্ত পরিবারের একটা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ যত ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করত, বাবুরা ততই ধর্মবিচ্যুত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বাবু’ নামের রম্যরচনায় লিখেছেন, ‘যিনি উৎসবার্থে দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।’
সে সময় কলকাতার বাবু সমাজের বিত্তবান পুরুষেরা রক্ষিতা অথবা বাইজি বাড়িতে রাত্রিযাপন করত, ব্যাপারটা নিন্দিত হতে দেখা যায়নি; বরং এটাই ছিল তখনকার ধনিক শ্রেণির জন্য মর্যাদার। এসব বাবুমশাইকে ঘিরে থাকত একদল চাটুকার। তাদের চামচামিও এসব বিত্তবান পুরুষ উপভোগ করত।
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, ‘কল্কেতা শহর রত্নাকর বিশেষ। এখানে যা না আছে, এমন জানোয়ার পৃথিবীর কোন চিড়িয়াখানায় নাই।’ বিনয় ঘোষ ‘নববাবুচরিত’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এই নব্যবাবুরা এক নতুন সংস্কৃতির পত্তন করেছিল। একদিকে নবাবী আমলের আবর্জনা তরজা-খেউড়, আর একদিকে ইংরেজি বণিকসভ্যতার জঞ্জাল, এই ছিল এই নব্য “বাবু কালচারে”র উপজীব্য।’
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top