skip to Main Content

ফিচার I Tea Party

শুরুতে এটি ছিল শহুরে অভিজাতদের আনুষ্ঠানিকতা। ধীরে ধীরে পাল্টেছে এর রূপ। আজকাল তো এটি গেট টুগেদারের সাধারণ অনুষঙ্গ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা-বাণিজ্যে নাম লেখানোর পর ইংল্যান্ডে এই পানীয় জনপ্রিয় হতে হতে আরও কিছুটা সময় লেগেছিল। বৈকালিক চা-চক্র ইংল্যান্ডের পুরোনো একটি ঐতিহ্য। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সে দেশে এই সংস্কৃতির শুরু। দৈনন্দিন জীবনযাপনে চা জনপ্রিয় হতে শুরু করে ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের স্ত্রী রানি ক্যাথরিন অব ব্রাগাঞ্জার মাধ্যমে। ক্যাথরিন ছিলেন পর্তুগালের রাজা জন অষ্টম ডিউকের মেয়ে। সামাজিকভাবে চায়ের কদর বাড়িয়ে তুলতে অ্যানা মারিয়া রাসেল নামের আরেকজন ব্রিটিশ নারীর ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। তিনি রানি ভিক্টোরিয়ার ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। অ্যানা ব্রিটেনের মানুষদের খাদ্যাভ্যাসে দারুণ পরিবর্তন আনেন ‘আফটার নুন টি’ বা বৈকালিক চা-চক্রের প্রথা চালুর মাধ্যমে। এর আগে লাঞ্চ এবং ডিনারের মধ্যভাগে কিছু খাবারের তেমন চল ছিল না। দুপুরের খাবারের পর ক্ষুধা নিবারণ ছিল এই চা-চক্রের মূল উদ্দেশ্য। চায়ের সঙ্গে বৈকালিক নাশতা হিসেবে তারা কেক ও পাই কিংবা মাংসের বিভিন্ন পদও রাখতেন। এসব টি-পার্টিতে অংশগ্রহণের জন্য বিশেষ ধরনের বড় গ্রাউন পরতেন ব্রিটিশ নারীরা। একে ঘিরে উচ্চবিত্ত ইংরেজ পরিবারের অবিবাহিত নারীর মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা লেগে থাকত, কে কার চেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে অংশ নেবেন এবং কোন উঁচু ঘরের ব্রিটিশ পুরুষের নজর কাড়বেন। ব্রিটিশ সমাজে তো বটেই, ধীরে ধীরে এই টি-পার্টির রীতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
ক্লান্তি দূর করা ছাড়াও সামাজিক ও পারিবারিক আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে চা পরিবেশনার ঐতিহ্য বহু পুরোনো। যুগ যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আতিথেয়তার নিদর্শনস্বরূপ চা-চক্র বা টি-পার্টি আয়োজিত হয়ে আসছে। সেই রকমই একটি অনুষ্ঠান জাপানের চাডো বা সেডো। এতে মাটচা নামে এক প্রকার গ্রিন টির চূর্ণ পরিবেশন করা হয়। জাপানের ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে উঠলেও এই অনুষ্ঠানের গোড়াপত্তন হয়েছিল চীনে। তবে গত কয়েক শ বছরে জাপানে এই অনুষ্ঠানের ব্যাপকভাবে বিকাশ ঘটেছে।
উৎপত্তিস্থল যেহেতু চীন, স্বাভাবিকভাবেই চা সে দেশে ঐতিহ্য হিসেবেই পরিচিত। এবং একে কেন্দ্র করে যে উৎসব পালিত হয়, সেটির নাম চেই। এটি (এই উৎসব) কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এটি পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার উদ্দীপনা হিসেবেও পরিচিত। চায়নিজরা মনে করেন, তাদের জীবনের সাতটি চাহিদার একটি হলো চা।
ভারতবর্ষের মানুষকে চায়ে অভ্যস্ত করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ব্রিটিশ ভারতীয় চা বোর্ডকে। এমনকি বিনা পয়সায় এটি বিতরণ করতে হয়েছিল। তখন চা কীভাবে পানযোগ্য করে তুলতে হয়, সেটাই ভারতবাসী জানত না। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ব্যাপক প্রচারণা ও বিপণন কৌশলের ফলস্বরূপ শহুরে মানুষের মাঝে চা পানের অভ্যাস গড়ে ওঠে। গল্প, আড্ডা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ক্ষেত্রে টি-পার্টি বা চা-চক্রের জুড়ি নেই। দারুচিনি; তেজপাতা, লবঙ্গসহ বিভিন্ন মসলা মিশ্রিত চা ভারতে বেশ জনপ্রিয়। কোথাও কোথাও আদা, এমনকি রসুনও ব্যবহার করা হয়।
তাইওয়ানের অধিবাসীরা চা-চক্রে বাবল বা পার্ল মিল্ক চা পান করতে ভালোবাসেন। আশির দশকের শুরুতে এটি তৈরির রীতি আবিষ্কৃত হয়। ঠান্ডা চায়ে বিভিন্ন রকম ফল বা দুধ দিয়ে প্রস্তুত করা হয় এটি। মরক্কোয় মেঘরেবি মিন্ট নামের বিশেষ ধরনের চা অতিথিকে পরিবেশনের পর তারা যদি তা পান না করেন, তবে সেটা অভদ্রতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
রাশিয়ানরা যে শুধু ভদকায় মগ্ন থাকেন, এমন ধারণা ভুল। চায়ের প্রতিও তাদের প্রবল অনুরাগ রয়েছে। তারা সাধারণত চায়নিজ ও ভারতীয় চা পছন্দ করেন। রাশিয়ানরা এটি তৈরি করে ভিনভাবে। তারা স্টোভে পানি সেদ্ধর পরিবর্তে চা তৈরির কাজে লোহার একটি বিশেষ পাত্র (সামোভার) ব্যবহার করেন। ক্লান্তি দূর ও শিথিলায়নের জন্য কোরিয়ানদের কাছে এটি জনপ্রিয়। তবে অন্য অনেক দেশের মতো চা তাদের আনুষ্ঠানিকতার অংশ নয়, বরং একে তারা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন।
তুর্কির সামাজিক জীবনে চা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা মনে করেন, চা-চক্র ছাড়া আড্ডা হলো চাঁদহীন রাতের আকাশের মতো। সেখানকার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। তারা ছোট ছোট গ্লাসে পান করেন। এতে দুধ মেশানো হয় না। চায়ের সঙ্গে চিনি না মিশিয়ে বরং চিনির খ- জিহ্বা ও গালের মধ্যবর্তী স্থানে রেখে তারা এটি পান করেন।
বাংলাদেশে চা-চক্রের সংস্কৃতিও খুব বেশি দিনের নয়। এখানকার মানুষের কাছে এটি জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কত চেষ্টাই না করল সরকার আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। বিনা মূল্যেও চা খেতে রাজি হতো না ঘোল-ঝোলে অভ্যস্ত বাঙালি। প্রথম দিকে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিহ্বা আর তালু ঝলসানো বাঙালির সংখ্যা কম ছিল না। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শহুরে মানুষের কাছে পানীয় হিসেবে এটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
একসময় এটি ছিল কেবল শহুরে ও উচ্চবিত্তদের কালচার। জানা যায়, ঢাকার নবাব আবদুল গনি সকালবেলায় এক দফা চা খেতেন। সেখানে শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত হতেন। এই চা-চক্র পরিচিত ছিল গণি মিয়ার আড্ডা নামে। দুপুরের খাবার শেষে খেতেন কাশ্মীরি টি। রাতে রং-চা।
মোটামুটি ষাটের দশকে শহুরে মধ্যবিত্ত এবং গ্রামের অভিজাত পরিবারে চা পানের প্রচলন ঘটে। তখন থেকে টি-পার্টিও আনুষ্ঠানিকতা বৈকালিক নিমন্ত্রণের আয়োজন বলে গণ্য হতো। বিশেষত অফিস পাড়ায় কোনো সভায় আপ্যায়নের অংশ হিসেবে। তবে টি পার্টি বলতে শুধুই চা পানের নিমন্ত্রণকে বোঝায়, এমন কিন্তু নয়! এর সঙ্গে থাকে নানা রকম মুখরোচক বৈকালিক নাশতার আয়োজনও— বিস্কুট, কেক, মুড়ি, শিঙাড়া, সমুচা, পুরি বা তেলে ভাজা আলুর চপ-বেগুনি, চিকেন ফ্রাই ইত্যাদি।
টি-পার্টি আভিজাত্যের গন্ডি থেকে বেশ আগেই বের হয়ে এসেছে। পাল্টেছে রূপ। ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে। এমনকি রাস্তার ধারে চা-দোকান কিংবা স্টেশনের টি স্টলেও এখন সেই সমাগম অনানুষ্ঠানিকভাবে দেখা যায়। তেমনি পারিবারিক যেকোনো গেট টুগেদারে এক কাপ চা খাওয়াকে উপজীব্য করে এগিয়ে যায় নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আজকাল বিবাহপূর্ব অনুষ্ঠানে বরপক্ষ কনে উভয় পক্ষ চায়ের দাওয়াতের কথা বলে একে অপরের বাড়িতে নিমন্ত্রণ দিয়ে থাকে। মূল উদ্দেশ্য থাকে দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনা অথবা পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার সূচনা করা।

 সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top