skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I সুস্থ মনের জন্য

১০ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ উপলক্ষে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সুস্থ হয়ে যাওয়া মানসিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে বিশেষ নিবন্ধ লিখেছেন সালেহীন রানা

শরীর ও মন—এ দুই নিয়ে হচ্ছে মানুষ। শরীরবিহীন যেমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি মনবিহীন শরীরও অসম্ভব। সুস্বাস্থ্যের জন্য সুস্থ শরীর এবং মন জরুরি। ১০ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দিনটি সবার মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য। এটি ১৯৯২ সালে প্রথম পালন করা হয়। আমাদের দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সের ১৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন ইকবাল আহমেদ। ২০১৫ সালে হঠাৎ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ক্লাস-পরীক্ষা সবই বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা প্রথমে তার সমস্যাটা বুঝতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের পরামর্শে তিনি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ জিল্লুর রহমানের কাছে যান। দীর্ঘ চিকিৎসার পর এখন তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন, ক্লাস-পরীক্ষাতেও অংশ নিচ্ছেন।
আলাপকালে তিনি জানান, তার সমস্যা ছিল মানসিক উদ্বেগজনিত। তিনি বলেন, এ কারণে ক্লাস-পরীক্ষা দিতে পারছিলাম না। আমার একজন শিক্ষকের পরামর্শে মানসিক চিকিৎসকের কাছে যাই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ডা. জিল্লুর রহমানের কাছে যাই। আমি ২০১৫ থেকে তার চিকিৎসা নেওয়া শুরু করেছি। এখনো চলছে। অনেক ভালো অনুভব করছি।
ইকবাল আরও জানান, তিনি বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। এই ধরনের অসুস্থতায় পরিবারের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি দরকার বলে তিনি মনে করেন। প্রথম যখন রোগটি ধরা পড়ে, তখন পরিবারের সদস্যদের আচরণ কেমন ছিল? এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, পরিবারের সদস্যরা প্রথমে বিষয়টা বুঝতে পারেনি। তারা কিছুটা রাগ করেছিল। মনে করেছে, আমি মনে হয় ইচ্ছে করে এমন করছি, পড়াশোনা করতে চাচ্ছি না। পরে যখন মানসিক চিকিৎসক তাদের বোঝাল, তখন তারা বুঝতে পারে। তাদের ভূমিকা ছিল সহযোগিতামূলক।
দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিতে গিয়ে কোনো ধরনের অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি ইকবালকে। তবে একটু ভয় লেগেছিল। কিন্তু ডাক্তারের সহযোগিতায় এই ভয় কেটে যায়। ইকবাল আরও জানান, সহপাঠীরা প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরিবারের পাশাপাশি বন্ধুদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সহযোগিতা করেছে। বিশেষ করে কোভিডের সময়ও তারা ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে সময় দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
ইকবাল যেহেতু বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন, তাই অনেক আত্মীয়ও বিষয়টি বুঝতে পারেনি। তবে যারা জেনেছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক ছিল। তিনি জানালেন, আসলে কেউ যদি মানসিক বিপর্যয়ে পড়ে, সে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। সে জন্য চিকিৎসকসহ আশপাশের পরিবেশের সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি খুব প্রয়োজন।
ইকবাল আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চান। চিকিৎসক জিল্লুর রহমানও তাকে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করার উৎসাহ দেন।

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বাংলাদেশে এখনো অবহেলিত
– ডা. জিল্লুর রহমান

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন সালেহীন রানা

ক্যানভাস: আমাদের দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
ডা. জিল্লুর রহমান: বর্তমানে ইন্টারনেটসহ যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। করোনাকালে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে বেশির ভাগ মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এটিও একটি বড় কারণ।
ক্যানভাস: মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কী উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি?
ডা. জিল্লুর রহমান: মানুষের মন যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি কখনো বেদনার্ত হতে পারে। কিন্তু মন খারাপ বা বিষণ্নতা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে নজর দিতে হবে। আমাদের সবার জীবনেই কখনো কখনো মন খারাপ হতে পারে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ বা বেশি দিন থাকার কথা নয়। অথবা ভালো কোনো ঘটনায়, খবরে সেটা ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যদি টানা মন খারাপ বা বিষণ্নতা থাকে, তখন সেটা মানসিক রোগের উপসর্গ বলে ধরে নিতে হবে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি।
ক্যানভাস: এখনো দেশের মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
ডা. জিল্লুর রহমান: সমাজে হেয় হওয়ার ভয়, স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং অসচেতনতার কারণে বিশালসংখ্যক মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার বাইরে রয়েছেন। তিন কারণে মানুষ মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে যায় না। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে মানসিক সমস্যা গুরুতর হতে পারে। এর মধ্যে প্রথম কারণ হচ্ছে সমাজের প্রচলিত স্টিগমা। মানসিক সমস্যা নিয়ে সমাজে একধরনের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। মানুষ এটাকে প্রকাশ করতে চায় না, লুকিয়ে রাখতে চায়। মানসিক সমস্যা প্রকাশিত হলে সমাজের চোখে হেয় হয়ে যাবেন। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা রয়েছে। মেডিকেল কলেজ কিংবা টারশিয়ারি পর্যায় ছাড়া আর কোথাও এই সেবা পাওয়া যায় না।
ক্যানভাস: মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
ডা. জিল্লুর রহমান: করোনাকালে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন অনেকেই। দুশ্চিন্তা কাটাতে তাই সব সময় পজিটিভ বা ভালো কিছু চিন্তা করা উচিত। চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় স্বস্তিদায়ক শ্বাসের ব্যায়াম বেশ কার্যকর। নাক দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া এবং মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ার মাধ্যমে এই ব্যায়াম করা যায়। কোনো কারণ ছাড়াই ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে এ ধরনের লক্ষণ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কাউন্সেলিং এবং ওষুধের মাধ্যমে এর চিকিৎসা সম্ভব।
একটা সময়ে মানসিক রোগ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক প্রকার ভীতি বা ট্যাবু ছিল। কিন্তু এখন সেটা অনেকাংশে কাটতে শুরু করেছে। গত ৭০ বছরে মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন চিকিৎসার মাধ্যমে জটিল রোগীরাও সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
ক্যানভাস: মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে পরিবারের করণীয় কী?
ডা. জিল্লুর রহমান: পৃথিবীজুড়ে মানসিক রোগের দুই ধরনের চিকিৎসা হয়ে থাকে। তার একটি হচ্ছে কাউন্সেলিং বা পরামর্শ সেবা, আরেকটি ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা। কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্যদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে মনোরোগবিদদের পরামর্শ নেওয়া। অনেক সময় কাউন্সেলিং থেরাপির মাধ্যমে সহজেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা না হলে অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে। তখন তারা ওষুধের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করেও চিকিৎসার দরকার হতে পারে।
ক্যানভাস: মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের দেশে প্রতিবন্ধকতা কী?
ডা. জিল্লুর রহমান: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে তাদের যে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোরের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বত্র এখনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সেবা পাওয়া যায় না। মূলত এটি এখনো শহরকেন্দ্রিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই সেবা নেই। গত ১০ বছরের তুলনায় বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। তবে চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট দক্ষ জনবলের সংখ্যা বাড়েনি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে জনবলের অভাবে রোগীর সঙ্গে পরিবারের একজনকে থাকতে হচ্ছে। দেশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আছেন মাত্র ২২০ জন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি এখনো অবহেলিত। এ রোগীদের দীর্ঘদিন চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয়। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালে এ রোগের জন্য ওষুধ পাওয়া যায় না। ফলে অনেকেই একটানা চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না।
ক্যানভাস: মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
ডা. জিল্লুর রহমান: আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় যে সংকট রয়েছে, সেগুলোকে গুরুত্বসহকারে প্রচার ও প্রকাশ করা দরকার। চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে এমন রোগীদের কথা বেশি বেশি প্রচার করতে হবে।
ছবি: সংগ্রহ

ডা. জিল্লুর রহমান
সহযোগী অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top