skip to Main Content

টেকসহি I ন্যায়বিচার সমাচার

২০ ফেব্রুয়ারি। ওয়ার্ল্ড ডে অব সোশ্যাল জাস্টিস। কাগজে-কলমে যা-ই থাকুক, বাস্তবে সামাজিক ন্যায়বিচারের চিত্র কেমন? লিখেছেন সাদিয়া আফরিন শায়লা

‘নভেম্বরে যাত্রা শুরুর ১০ দিন পরই আমাদের নৌকার ইঞ্জিন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে ফুরিয়ে যেতে থাকে খাবার, পানীয় জল। ভেসে থাকার সে সময়টাতে বৃষ্টি হলেই কেবল আমরা গলা ভেজানোর মতো কয়েক ফোঁটা পানির দেখা পেতাম। ভেবেছিলাম, আমার মেয়েটা হয়তো এযাত্রায় বাঁচবে না। বাকি মায়েদের মতো আমিও ওর তৃষ্ণা মেটাতে সমুদ্রের লোনাপানি খেতে দিই,’ ইন্দোনেশিয়া থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দুর্বিষহ সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা দিচ্ছিলেন রোহিঙ্গা শরণার্থী হাতেমন নেসা। গত বছরের নভেম্বরে কক্সবাজার থেকে আরও অনেকের সঙ্গে নৌকাযোগে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। এক মাসের দীর্ঘ ভয়াল সমুদ্রযাত্রা শেষে পৌঁছান ইন্দোনেশিয়ায়। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে তিনিও একজন। গত পাঁচ বছর হাতেমন নেসার ঠিকানা ছিল বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। উন্নত জীবনের উদ্দেশ্যে এখান থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমালেও, তা পাওয়া আদৌ সম্ভব কি না—জানেন না তিনি।
শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, গত বছর মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগরে বিপজ্জনকভাবে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৪০০ জন, যাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। হাতেমন নেসাদের নৌকায় যাত্রী ছিলেন প্রায় ২০০ জন। উত্তাল সাগরে নৌকার ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর প্রায় ১৯ জন রোহিঙ্গা সাগরে সাঁতরে নিকটবর্তী কিছু নৌযানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তবে তারা সকলেই প্রাণ হারিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাঝ সাগরে আটকা পড়ার পর নৌকাটির যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য বারবার অনুরোধ করা হলেও বেশির ভাগ দেশ থেকেই কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শেষমেশ ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা তাদের উদ্ধার করেন। কিন্তু নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত, অবহেলিত এ মানুষগুলোর কি আসলেই কোনো অধিকার নেই?
শুধু শরণার্থী নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গনির্বিশেষে সব মানুষের সমানভাবে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার যে ব্যবস্থা, তাকে কেতাবি ভাষায় বলে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’; ইংরেজিতে সোশ্যাল জাস্টিস। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, লৈঙ্গিক সমতা, অভিবাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন—এ বিষয়গুলো মোকাবিলার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিবছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ‘বিশ্ব সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস’ [ওয়ার্ল্ড ডে অব সোশ্যাল জাস্টিস]। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এ দিবস ঘোষণা করে। ২০০৯ সালে প্রথম পালিত হয় দিবসটি।
সামাজিক ন্যায়বিচারকে বাস্তবে রূপ দিতে মূলত চারটি নীতি নিয়ে কাজ করা হয়: মানবাধিকার, প্রবেশাধিকার, অংশগ্রহণ এবং সমতা। আমরা প্রায় সময়ই ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ ও ‘মানবাধিকার’কে একই অর্থে ব্যবহার করলেও, দুটি বিষয় কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। আবার একটি ছাড়া অন্যটির উন্নতিও সম্ভব নয়। একটি সমাজ যখন ন্যায়পরায়ণ হয়, তখন সে সমাজ প্রত্যেকের মানবাধিকার রক্ষা করে এবং মর্যাদা দেয়। আবার যখন কোনো সমাজ সবার মানবাধিকারকে সম্মান ও প্রচার করে, তখন প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক ন্যায়বিচার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কী বলে? আন্তর্জাতিক অঙ্গন বরাবরই এ দেশের মানবাধিকার চর্চা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মানবাধিকারের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। করোনা মহামারির সময়কার কথাই ধরা যাক। করোনা প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ও সমসাময়িক নানা ইস্যুতে সমালোচনা করার কারণে সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট থেকে শুরু করে লেখক-সমালোচক, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নানা রোষের শিকার হতে হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে বিতর্কিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’-এর অধীনে ৪৩৩ জনকে আটক করা হয়। তাদের বেশির ভাগই ‘মিথ্যা বা আপত্তিকর তথ্য’ প্রকাশের অভিযোগে সাজা ভোগ করেছেন। এই আইনের অধীনে ২০২০ সালের তুলনায় পরের বছর আটকের সংখ্যা বেড়েছে ২১ শতাংশ।
এখানেই শেষ নয়। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারা [মিথ্যা বা আপত্তিকর তথ্য প্রকাশ—ধারা ২৫, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ—ধারা ২৯ এবং আইনশৃঙ্খলা অমান্যকারী অপরাধের জন্য শাস্তি—ধারা ৩১] মূলত সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট ও মানবাধিকারকর্মীদের মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে বলে অভিমত অ্যামনেস্টির। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৮০ জন সাংবাদিক তাদের চাকরিকালে হামলার শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকেই হয়েছেন আহত, অনেকেই হারিয়েছেন প্রাণ।
সামাজিক ন্যায়বিচার রক্ষায় একটি দেশের নাগরিকদের আশ্রয়, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবার মতো মৌলিক অধিকারের অ্যাকসেস থাকাও জরুরি। বৈশ্বিক খাদ্যসংকট এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে বহুগুণ।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের জরিপে জানা গেছে, গত বছরের আগস্টে দেশের ২২ শতাংশ পরিবার মাঝারি আকারে খাদ্যনিরাপত্তাহীন ছিল। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই নিম্ন আয়ের। তা ছাড়া সংকটকালে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও পরবর্তীকালে তা আর কমেনি। চাল-ডাল থেকে শুরু করে সবকিছুর দামই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। নিম্নবিত্তরা তো আছেই, বর্তমানে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরাও পুষ্টিকর খাবার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরপর আসে শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান চিত্র। করোনার সংক্রমণ রোধ করতে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে এত বেশি দিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। তারা আরও জানায়, মহামারি চলাকালীন এত দীর্ঘ বন্ধ থাকার কারণে দেশে তিন কোটির বেশি শিশু শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ শিক্ষাগত তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২১’ অনুসারে, ২০২০ সালের তুলনায় পরের বছরে মাধ্যমিক শিক্ষা নেওয়া মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৬ শতাংশ। এদিকে চিকিৎসা খাতে বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। গ্লোবাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার ডেটাবেজ, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসা খাতে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস (বিএনএইচএ) ১৯৯৭-২০ অনুসারে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার ছিল ৬৯ শতাংশ। ডাক্তারের ভিজিট থেকে শুরু করে রোগীকে হাসপাতালে আনা-নেওয়া, ভর্তির খরচ, নার্সের খরচ, চিকিৎসা দ্রব্য, মেডিসিন কেনা—এত সব খরচের জাঁতাকলে পড়ে নিম্ন আয়ের অনেকেই চিকিৎসাসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন এ দেশে। হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের তথ্যসূত্রে জানা যায়, আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছর প্রায় ১৬ শতাংশ রোগী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
একটি সমাজে যদি সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমান অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, দেশের প্রান্তিক ও অরক্ষিত জনগণ বরাবরই কোণঠাসার শিকার হয়ে থাকে। সম্পদ, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার নিচে চাপা পড়ে যায় তাদের কণ্ঠস্বর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথা। ২০২১ সালের অক্টোবরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ উৎসব দুর্গাপূজার সময়টাতে দেশের অন্তত ৪০টি পূজামণ্ডপে আগুন দেওয়া হয়; পাশাপাশি, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ২৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সে বছর সাম্প্রদায়িক এ সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে কমপক্ষে ৭১টি মামলা করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাড়ে চার শতাধিক; দেশজুড়ে নিহত হন অন্তত ৭ জন—এমনটাই জানিয়েছে অ্যামনেস্টি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি ধুঁকছেন জাতিগতভাবে সংখ্যালঘুরাও। ২০২১ সালের অক্টোবরে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, বনাঞ্চলকে ‘অক্ষত’ রাখার জন্য বনাঞ্চলে বসবাসকারী লোকজনকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করা কর্মীরা এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সে সময় বলেন, আদিবাসীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদের জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সে বছরেরই মে মাসে মৌলভীবাজারের একটি গুচ্ছগ্রামে (আগরপুঞ্জি) ৪৮টি খাসি পরিবারের এক হাজার সুপারিগাছ কেটে দেওয়া হয়। এ গাছ ছিল সম্প্রদায়টির জীবিকা নির্বাহের মূল উৎস। তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা জুড়ে ক্রমাগত বন উজাড় এবং ভূপৃষ্ঠের জলাশয় থেকে পাথর ও বালু অপসারণ ওই অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য পানিসংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে; সেই সঙ্গে তাদের জীবন-জীবিকা পড়েছে হুমকির মুখে।
একটি বৈষম্যহীন সমাজই দিতে পারে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। যে সমাজ সাংবাদিকের কলমের কালি রুখে দেয়, যে সমাজে সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর দমিয়ে রাখা হয়, যে সমাজে মানুষ অনাহারে-অপুষ্টিতে ভোগে, যে সমাজে শিশুরা স্কুলের গেট পেরোনোর আগেই ঝরে যায়, সে সমাজে কি আদৌ ‘সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস’-এর কোনো মূল্য আছে?

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top