skip to Main Content

ফিচার I বাঙালি ময়রা

বড় বড় শেফের নাম হরহামেশা শোনা যায়। কিন্তু একটা সময় বাঙালি ময়রারা মাতিয়ে রেখেছিলেন বঙ্গ থেকে লন্ডন। ইংরেজ ও ফরাসিরা মজেছিলেন তাদের মিষ্টিতে

এখন যেমন বিশ্বের বড় বড় শেফের জয়-জয়কার, তেমনি একটা সময় বাঙালি ময়রাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে। তাদের তৈরি নানান মিষ্টি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সমাদৃত ছিল। মিষ্টি তৈরির মুনশিয়ানা দেখিয়েই তারা মজিয়েছেন ইংরেজ শাসক ও ফরাসিদের মন। এসব ময়রার মিষ্টি তৈরি ছাড়াও ছিল ভিন্ন গুণ। কারও ঝোঁক ছিল কবিতায়, কেউ আবার ছিলেন বিজ্ঞানপ্রেমী। তাদের নামের তালিকা বেশ দীর্ঘই। তবে মোটা দাগে যেসব বাঙালি ময়রা ইতিহাসে দাগ কাটতে পেরেছিলেন, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ভোলা ময়রা, ভীমচন্দ্র নাগ, নবীনচন্দ্র দাস, কৃষ্ণচন্দ্র দাস ও সারদা চরণ দাস।
ভোলা ময়রা
পুরো নাম শ্রী ভোলানাথ মোদক। ময়রার পাশাপাশি কবিয়াল হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। কলকাতার বাগবাজারে তার দোকানে শুধু মিষ্টির জন্যই নয়, বরং কাব্যরসে সিক্ত হতেও ভিড় জমাতেন ভোজনরসিকেরা। লুচি ও পরোটার সঙ্গে তিনি পরিবেশন করতেন নানা ধরনের মিষ্টি। নবাবি ও ইংরেজ আমলে ভোলা ময়রা একটি ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছিলেন। তখন আরও অনেক ময়রা থাকলেও তার খ্যাতিই ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র।
ভোলা ময়রার কবি হয়ে ওঠার পেছনে ভূমিকা ছিল সেকালের বিখ্যাত কবিয়াল হারু ঠাকুরের। তা ছাড়া যগা বেনেও তার গুরু ছিলেন। তাদের সান্নিধ্যে কাব্য রচনায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন ভোলা। যদিও খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি তার। সেকালে এটা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব তার কবিতাকে প্রভাবিত করেনি; বরং কবিতায় শব্দের ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হতেন সে সময়ের বিজ্ঞজনেরা। কাব্যপ্রতিভা ও মিষ্টি তৈরিতে মুনশিয়ানা—এ দুটি কাজে লাগিয়ে ভোলা তার বাবা কৃপানাথার ছোট ঝুপড়ি দোকানকে সে সময়ের কলকাতার সবচেয়ে বড় দোকানে পরিণত করতে পেরেছিলেন। ইতিহাসে ভোলা ময়রা মিষ্টি ও কবিতা—দুটির জন্যই সমাদৃত।
ভীমচন্দ্র নাগ
বাঙালি ময়রাদের মধ্যে যাদের নাম ইতিহাসের সোনালি পাতায় লেখা রয়েছে, তাদের একজন ভীমচন্দ্র নাগ। ভীমনাগ নামে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি একটি বিশেষ মিষ্টান্নের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন, যেটি এখন ‘লেডিকেনি’ নামে পরিচিত। এ মিষ্টি তৈরির পেছনে অবশ্য এটি ইতিহাস রয়েছে। সেকালের গভর্নর জেনারেল চার্লস ক্যানিং সস্ত্রীক এসেছিলেন কলকাতায়। তার স্ত্রীর জন্য বিশেষ মিষ্টি তৈরির ফরমাশ পেয়েছিলেন ভীমনাগ। পরে ভীমনাগ ময়রা একধরনের মিষ্টি তৈরি করে চার্লসের স্ত্রী লেডি ক্যানিংকে তা পরিবেশন করেন। মিষ্টি খেয়ে লেডি ক্যানিং এতই বিমোহিত হয়েছিলেন, ভীমনাগকে পুরস্কৃত করেছিলেন তিনি। পরে সেই বিশেষ মিষ্টি পুরো ভারতে লেডিকেনি নামে পরিচিতি পায়। শুধু যে লেডিকেনির জন্য ভীমনাগ খ্যাতি পেয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। তার তৈরি সন্দেশ ও মনোহরা মিষ্টিও বিখ্যাত ছিল সে সময়। ভোলা ময়রার মতো ভীমনাগও তার বাবার ছোট দোকানকে পুরো ভারতে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন।
ভীমনাগ ময়রাকে নিয়ে আরও কিছু গল্প প্রচলিত আছে। সে সময় কুক অ্যান্ড কেলভি নামের একটি বিখ্যাত ঘড়ি নির্মাতা কোম্পানি ছিল। একদিন ভীমনাগের দোকানে মিষ্টি খেয়ে বিমোহিত হন কোম্পানির মালিক চার্লস কেলভি। তিনি ভীমনাগকে জিজ্ঞাসা করেন, তার এত বড় দোকানে কোনো ঘড়ি নেই কেন? এমন প্রশ্নে ভীমনাগ ময়রা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দেন, ‘কেনা হয়নি।’ কেলভি একটি বড় ঘড়ি উপহার দিতে চাইলে ভীমনাগ জানান, তার দোকানের কর্মীরা ইংরেজি জানেন না। তাই একটা বাংলা ঘড়ির অনুরোধ করেন তিনি। কেলভি মুচকি হেসে দোকান থেকে বেরিয়ে যান। কিছুদিন পর লন্ডন থেকে একটি গোলাকার ঘড়ি ভীমনাগের দোকানে পাঠিয়ে দেন কেলভি। সেটির নম্বরগুলো ছিল বাংলায়। ভীমনাগের মিষ্টির দোকানে এখনো রয়েছে সেই ঘড়ি।
নবীনচন্দ্র দাস
বাংলার ময়রাদের মধ্যে ‘রসগোল্লার কলম্বাস’ নামে খ্যাত নবীনচন্দ্র দাস। কলকাতায় জন্ম নেওয়া এই ময়রা সেখানে এন সি দাস নামেও পরিচিত ছিলেন। ভোলা ময়রার মতোই কলকাতার বাগবাজারে ছিল তার মিষ্টির দোকান। ব্যক্তিজীবনে তিনি ভোলার নাতজামাই ছিলেন। পুরো কলকাতায় নবীন ময়রা নামে তিনি খ্যাত ছিলেন। অনেকের মতে, রসগোল্লার উদ্ভাবক তিনিই, যেই মিষ্টি এখন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। এ ধরনের মিষ্টি তৈরির পেছনে একটি গল্প প্রচলিত আছে। শোনা যায় এক মেয়ে নাকি নবীন ময়রাকে বলেছিল, ‘চটচটে নয়, শুকনো হতে মানা/ দেখতে হবে ধবধবে চাঁদপানা/ এমন মিষ্টি ভূ-ভারতে নাই/ নবীন ময়রা, এমন মিষ্টি চাই।’
মেয়েটির এমন শর্তযুক্ত আবদার মেটাতে নবীন তৈরি করেছিলেন রসগোল্লা। পরে এই রসগোল্লার সূত্রেই প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন নবীন। মেয়েটির নাম ক্ষীরোদমণি দেবী। যদিও রসগোল্লা তৈরিতে বেগ পেতে হয়েছিল নবীন ময়রাকে। এমনকি বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর তার মেজাজ প্রায় খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। একবার খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বাগবাজারে বসেছিলেন তিনি। পাশেই বসেছিলেন ভীমনাগ ময়রা। নবীনের খিটখিটে মেজাজ দেখে ভীমনাগ তাকে বলেছিলেন, ‘মুখে ও মনে মিষ্টি না থাকলে হাত দিয়ে মিষ্টি বানাবে কীভাবে?’ পরে নবীন ময়রা শান্ত হন। শেষে রসগোল্লা বানাতে সফল হন।
রসগোল্লা ছাড়াও নবীনের আরও কিছু মিষ্টি সেকালে বিখ্যাত হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেদো সন্দেশ, আতা সন্দেশ, বৈকুণ্ঠভোগ, আবার খাবো, কাঁঠাল সন্দেশ ও কস্তুরী পাক।
কৃষ্ণচন্দ্র দাস
বাংলার প্রসিদ্ধ ময়রাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। এ কারণেই হয়তো একজনের মিষ্টি তৈরির মুনশিয়ানা আরেকজনের কাছেও মেলে। যেমন নবীনচন্দ্র ময়রার একমাত্র সন্তান কৃষ্ণচন্দ্র দাস ময়রা। কে সি দাস নামেও পরিচিত। রসমালাই ও ভ্যাকুয়াম টিনজাত রসগোল্লার উদ্ভাবন তার হাত ধরেই। ভোলা ময়রার মতো কবিতা লেখার বাতিক না থাকলেও কে সি দাস ছিলেন বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষ। কৃষ্ণচন্দ্র ময়রাই প্রথম মিষ্টি তৈরিতে যান্ত্রিক সহায়তা নেন। আজকে পুরো ভারত-বাংলায় রসগোল্লার যে জয়-জয়কার, তাতে কে সি দাসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাবার ব্যবসাকে আরও বড় করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া নিজের ছোট ছেলে সারদা চরণ দাসের সঙ্গে ‘কৃষ্ণচন্দ্র দাস মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ নামে দোকান শুরু করেছিলেন। সেটা ১৯৩০ সালে। ভারতে এখনো দাস পরিবারের ধারা অক্ষুণ্ন আছে। সেখানে রয়েছে কে সি দাস প্রাইভেট লিমিটেড।
সারদা চরণ দাস
কৃষ্ণচন্দ্র দাসের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট সারদা চরণ দাস। ১৯৩৪ সালে তার বাবা মারা যান। এর এক বছর পর ধর্মতলার মোড়ে সম্পূর্ণ আধুনিক চিন্তাধারায় তিনি গড়ে তোলেন ‘কে সি দাস রেস্তোরাঁ’। সেকালের ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে এই রেস্তোরাঁ খুব কদর পেয়েছিল। সারদা চরণই প্রথম বয়লার পদ্ধতিতে মিষ্টি তৈরি করেন। ১৯৬০ সালে লন্ডনে টিনজাত রসগোল্লা রপ্তানি শুরু করেন তিনি। তার হাতে মিষ্টিগুলোর মধ্যে অমৃতকুম্ভ সন্দেশ, সন্দেশ কেক, আইসক্রিম সন্দেশ ও ডায়াবেটিস সন্দেশ সেকালে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল।

i আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top