skip to Main Content

স্বাদশেকড় I সুশি সাম্রাজ্য

জাপান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সুদূর অতীত থেকে বর্তমানে। জনপ্রিয়তায় শীর্ষে

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য, অর্জন, ভূমিকা, অংশগ্রহণ, পছন্দ-অপছন্দ, প্রতিকূলতা ইত্যাদি নিয়ে মার্চজুড়ে সারা দুনিয়ায় বিশেষ আলোকপাত করা হয়। নারীদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার কোনগুলো? এমন এক জরিপ থেকে জানা যায় চকোলেট, স্টেক, সুশি, স্যালাড, পপকর্ন, কেক, পনির, পাস্তার নাম রয়েছে তালিকার শীর্ষে। তাই জাপানি খাবার হিসেবে সুপরিচিত সুশির ইতিহাসে একটু ঢুঁ মারা যাক।
শুনতে আজব লাগলেও সুশির ইতিহাসের সূচনা ঘটেছিল ধানখেত থেকে! সেখানে মাছের সঙ্গে ভিনেগার, লবণ ও চাল মিশিয়ে গাঁজন করা হতো; তারপর খাওয়া হতো চাল ফেলে দিয়ে। খাবারটির প্রাচীনতম রূপ ছিল বর্তমানের নারেজুশি। এটি প্রথম জাপানে ইয়ায়োই যুগে (প্রাথমিক লৌহ যুগ) তৈরি হতো। মুরোমাচি যুগে (১৩৩৬-১৫৭৩) লোকেরা ভাত ও মাছ খেতে শুরু করেন। এদো যুগে (১৬০৩-১৮৬৭) গাঁজানো চালের পরিবর্তে ভিনেগার ব্যবহারের প্রচলন ঘটে। সেই থেকে খাবারটি জাপানি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠে। আধুনিক সুশির উদ্ভাবক হিসেবে হানায়া ইয়োহেই সর্বাধিক পরিচিত, যিনি নিগিরিজুশি নামে একধরনের সুশি আবিষ্কার করেছিলেন। এই সুশিতে হাতে কচলানো, ভিনেগারযুক্ত চালের ওপর রাখা হতো সামুদ্রিক খাবার। এটি ছিল এদো যুগে চোনিন সম্প্রদায়ের পছন্দের ফাস্ট ফুড।
সুশির প্রাচীনতম রূপ নারেজুশির সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ-পশ্চিম চীন, মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের মেকং নদীর তীরবর্তী ধানখেত। চতুর্থ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়কার প্রাচীন চীনে যখন হান চীনারা বাইয়ু থেকে এই খাবার গ্রহণ করার জন্য দক্ষিণে গমন করেছিলেন, তখন নারেজুশি শব্দটি নথিভুক্ত করা হয়। প্রটোটিপিক্যাল নারেজুশি তৈরি করতে ল্যাকটো-ফার্মেন্টিং মাছের সঙ্গে লবণ ও ভাত দিয়ে পটিফ্যাকশন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জাপানে ইয়ায়োই সময়কালে ভেজা খেতে ধান চাষের প্রবর্তন ঘটলে খাবারটি বিতরণের পরিধি খেত পেরিয়ে লোকালয়ে বিকশিত হয়। প্রাচীন এক লেখায় প্রাচীন জাপানি জনগণ এবং ইয়াংজি দ্বীপ শাসনকারী কিংবদন্তি রাজা শাও কাংয়ের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়, সে সময়ে ছোট-বড়নির্বিশেষে সবাই নিজ মুখে উল্কি আঁকতেন এবং নকশা দিয়ে শরীর সাজাতেন। প্রাচীনকাল থেকে যারা চীনা দরবার পরিদর্শন করতেন, নিজেদের তারা গ্র্যান্ডি বলতেন। জিয়া অঞ্চলের শাসক শাও কাংয়ের এক পুত্রকে কুয়াইজির লর্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। সাপ ও ড্রাগনের আক্রমণ এড়াতে তখন চুল কেটে ফেলেছিলেন তিনি। তার শরীর সাজানো হয়েছিল নকশা দিয়ে। ওয়া আদিবাসীরা মাছ ও মাছের শাঁস পেতে জলে নামতেন। সেই সময়কালে বড় মাছ ও জলপাখিকে দূরে রাখার জন্য দেহ সজ্জিত করতেন তারা। পরে অবশ্য নকশাগুলো নিছক শোভাময় হয়ে থাকত তাদের শরীরে।
আরও জানা যায়, তৃতীয় শতাব্দীতে, জাপানে চীনা ভ্রমণকারীরা ‘উ’ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য দাঁত তোলা, উল্কি আঁকা ও বাচ্চাদের পিঠে বহন করার মতো আচার-অনুষ্ঠান চালু করেছিলেন। জাপানে আগে থেকেই আরও ভিন্ন কিছু প্রথা স্বীকৃত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, প্রার্থনার সময় হাততালি দেওয়া, কাঠের ট্রেতে খাবার পরিবেশন করা এবং কাঁচা মাছ খাওয়া (জিয়াংসু ও ঝেজিয়াংয়ের ঐতিহ্যবাহী) প্রভৃতি। তারও আগে, দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনা অভিধানে সা (লবণ ও ভাতের সঙ্গে আচারযুক্ত মাছ) নামে আবির্ভূত হয়েছিল নারেজুশি। সে সময় হান চীনারা ইয়াংজি নদীর দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। হান জনগোষ্ঠী নয়—এমন মানুষদের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতেন তারা। পূর্ব চীনের প্রাক-হান বাইইউ সাংস্কৃতিক অঞ্চল ডংগিতে পাওয়া যেত চাষাবাদের উপকরণ কুয়াই, সাশিমি ও কোদাল। প্রাচীন চীনা দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ কনফুসিয়াস বর্তমান নানক্সিন টাউনের কাছে কুফু, শানডংয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রচলিত আছে, তিনি কাঁচা মাংস খেতে ভালোবাসতেন। প্রাচীনতম রাজবংশগুলো (শাং রাজবংশ ও ঝৌ রাজবংশ) পশ্চিম শানডংয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন পূর্ব শানডংয়ে ডংগি জনগোষ্ঠীকে ‘বর্বর’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পরবর্তী শতাব্দীতে ডংগিরা শেষ পর্যন্ত সিনিসাইজড বা তথাকথিত ‘সভ্য’ হয়ে যান। অর্থাৎ ধীরে ধীরে চীনাদের আচার-অনুষ্ঠান রপ্ত করেন তারা।
সুদূর অতীত থেকেই জাপানিরা ভাতের সঙ্গে মাছ খেতে পছন্দ করতেন, যা নামনারে বা নামানারি নামে পরিচিত ছিল; যার অর্থ ‘আধা-গাঁজানো’। মুরোমাচি আমলে নামনারে ছিল সুশির সবচেয়ে জনপ্রিয় ধরন। নামনারে ছিল ভাতে মোড়ানো আংশিক কাঁচা মাছ, যা স্বাদ নষ্ট হওয়ার আগেই টাটকা খাওয়ার প্রচলন ছিল। তবে এটি মাছ সংরক্ষণের একটি উপায় হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং জাপানি কুজিনের এক নতুন সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এদো যুগে আরেক ধরনের সুশি তৈরি হয়েছিল, যার নাম হায়া-জুশি। এই খাবারে ভাত ও মাছ একত্র করা হয়েছিল, যেন একসঙ্গে উভয়ই খাওয়া যায়। হায়া-জুশি দ্রুতই জাপানি সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। এ ধরনের সুশিতে চাল গাঁজন করে নয়; বরং ভাতের সঙ্গে ভিনেগার মেশানোর পরে মাছ, শাকসবজি ও শুকনো খাবার যোগ করা হয়। এই সুশি আজও বেশ জনপ্রিয়।
আজকের নিগিরিজুশির রন্ধনশৈলী, ১৮২০ কিংবা ১৮৩০-এর দশকে এদোতে (বর্তমানে টোকিও) জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮২৪ সালে রিয়োগোকুতে নিজ দোকানে এই রন্ধনকৌশল আবিষ্কার এবং পরে তা আরও নিখুঁত করেছিলেন শেফ হানায়া ইয়োহেই। ১৯২৩ সালে প্রলয়ংকরী গ্রেট কান্তো ভূমিকম্পের পর নিগিরি-জুশি শেফরা টোকিও থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে সারা জাপানে ছড়িয়ে পড়েন। এরাই পরবর্তীকালে সারা দেশে খাবারটি জনপ্রিয় করে তোলেন।
জাপানে সুশির প্রাচীনতম লিখিত রূপটি ৭১৮ সালে ইয়োরো কোডে (কোড ল্যাঙ্গুয়েজ) প্রকাশ পেয়েছিল। সেই সময়কার সুশির স্বাদ ছিল আজকের নারেজুশির মতোই। সময়ের পরিক্রমায় এ খাবারে আসে নানান পরিবর্তন। অবশেষে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জাপানি অন্যান্য কুজিনের মতো সুশিও একটি পরিচিত রূপ পায়। সময়ের প্রবাহে জাপানিরা দিনে তিন বেলা এবং ভাপের পরিবর্তে সেদ্ধ ভাত খেতে শুরু করেন। ফলে রাইস ভিনেগারের বিকাশ বাড়তে থাকে ব্যাপকভাবে। ভাতের সঙ্গে মাছ গাঁজন করে সুশি উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও রাইস ভিনেগার দিয়ে গাঁজন করার ক্ষেত্রে সময় অনেকটা কমে যায় এবং ভাত ও মাছের সঙ্গে তা খাওয়ার চল শুরু হয়। অন্যদিকে, গাঁজন প্রক্রিয়ায় লবণ পরিহার করে এর পরিবর্তে ভিনেগার ব্যবহার শুরু হওয়ার মাধ্যমে মুরোমোচি যুগে ওশিজুশি উৎপাদনের প্রক্রিয়ার ধীর বিকাশ ঘটেছিল। আজুচি-মোমোয়ামা যুগে (১৫৭৩-১৬০৩) উদ্ভাবিত নামনারে, ১৬০৩ সালের জাপানি-পর্তুগিজ অভিধানে যার আক্ষরিক অর্থ লেখা হয়েছিল ‘অর্ধ-তৈরি সুশি’, তা নারেজুশির চেয়ে কম সময়ের জন্য গাঁজানো হয়ে থাকে। আর তা ম্যারিনেট করা হয় রাইস ভিনেগার দিয়ে। ফলে গন্ধের দিক দিয়ে এটি নারেজুশির চেয়ে আলাদা।
নারেজুশির গন্ধ সম্ভবত গাঁজন প্রক্রিয়ার সময় কমানো, এবং অবশেষে তা এড়িয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লেখা কনজাকু মনোগাতারিশুর একটি গল্পে উল্লেখ করা হয়, নারেজুশির গন্ধ তেমন আকর্ষণীয় ছিল না, তবে স্বাদ ছিল ভালো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ওশিজুশির বিকাশ ঘটেছিল ওসাকাতে; বর্তমান টোকিওতে এর আগমন ঘটে ওই শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা হতো এই সুশি। যেহেতু গাঁজনের জন্য খানিকটা সময় প্রয়োজন হতো, তাই গ্রাহকদের উদ্দেশে দোকানিরা নোটিশ ও পোস্টার ঝুলিয়ে জানান দিতেন, অর্ডার দেওয়া সুশি নিতে চাইলে কখন আসতে হবে।
শুরুর দিকে জাপানের ঐতিহ্যবাহী হানামি বা ফুলের উৎসব ঘিরে পার্কের ধারে ও থিয়েটারে সুশি বিক্রি হতো বেন্তোতে (বিভিন্ন ধরনের সুশির সমাহারে বাক্সবিশেষ) করে। এর ফলে, ইনারিজুশি, ওশিজুশি, মাকিজুশি, চিরাশিজুশিসহ বিভিন্ন ধরনের সুশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হাজার হাজার সুশি রেস্তোরাঁর ভিড়ে টোকিওতে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিল তিনটি—মাতসুনোজুশি, ইয়োহেইজুশি ও কেনুকিজুশি। উনিশ শতকের শুরুতে, মাত্র বিশ বছরের ব্যবধানে গড়ে ওঠে এই তিন রেস্তোরাঁ। আর তা নিগিরিজুশির বাজারে একটি তাৎক্ষণিক ধাক্কা দেয় এবং যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে!
১৮৫২ সালে প্রকাশিত ‘মরিসাদামাঙ্কো’ বই থেকে জানা যায়, টোকিওর প্রতি চো (১ লাখ ১০ হাজার বর্গফুট) এলাকার মধ্যে সুশি রেস্তোরাঁ ছিল দুটি; অথচ সোবা রেস্তোরাঁ ছিল প্রতি এক বা দুই চোতে মাত্র একটি করে। বলে রাখি, ঐতিহ্যবাহী জাপানি নুডলসের রেস্তোরাঁগুলোকে সোবা বলা হয়। তার মানে হিসাবটা এমন, শহরটিতে সুশি রেস্তোরাঁ ছিল সোবা রেস্তোরাঁর প্রায় দ্বিগুণ।
নিগিরিজুশির এই প্রাথমিক ধরনগুলো বর্তমান ধরনের চেয়ে ভিন্ন ছিল। এতে মাছকে সয়া সস কিংবা ভিনেগার দিয়ে ম্যারিনেট করা হতো। লবণ দেওয়া হতো প্রচুর। ক্ষেত্রবিশেষে সুশিতে রাখার আগে কিছু মাছ আলাদা রান্না করে নেওয়া হতো। প্রতিটি টুকরা এতই বড় ছিল, যা আজকের সুশির দুই টুকরার সমান।
আধুনিক রেফ্রিজারেশনের আবির্ভাব কাঁচা মাছের তৈরি সুশিকে আগের চেয়ে বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। বিশ শতকের শেষের দিকে সারা বিশ্বে এ খাবারের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বেড়ে যায়। জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ নানা দেশে ঘটে যায় এর দারুণ বিস্তার।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top