skip to Main Content

স্বাদশেকড় I জিলাপি ঝলক

সুস্বাদু মিষ্টান্ন। খাওয়ার জন্য কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে, উপলক্ষ ঘিরে তো রীতিমতো ধুম পড়ে যায় খাওয়ার!

রমজান মাসে ইফতারির মেনুতে থাকে বাহারি আয়োজন। আর যা-ই থাকুক, জিলাপি ছাড়া ইফতার যেন জমে না! সুস্বাদু এই মিষ্টান্নের উৎপত্তি আমাদের উপমহাদেশে, এমনটা ধারণা অনেকের। আসলে কি তাই? প্রাচীন পারস্যের জুলবিয়া বা জালেবি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মেলার জিলাপি পর্যন্ত, এই মিষ্টান্নের ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই ঘুরেছে নানা বাঁকে।
যুগ যুগ ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীরা এই অতুলনীয় খাবারের প্রেমে পড়ে আছেন। এর উৎপত্তি মোটেই এই উপমহাদেশে নয়, জানি এমন তথ্য কাউকে চমকে দেবে, কারও আবার করে দেবে মন খারাপ। কিন্তু সত্য এমনই! উপমহাদেশের প্রিয় এই রেসিপির আবির্ভাব ঘটেছে সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের জালাবিয়া কিংবা পারস্যের জুলবিয়া থেকে।
জালেবির উৎপত্তি অজানা। তবে মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রারম্ভিক ইতিহাসে জালাবিয়েহের নাম নথিভুক্ত রয়েছে। জুলবিয়ার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে। মুহাম্মদ বিন হাসান আল-বাগদাদির একটি প্রাচীন ফার্সি রান্নার বই ‘কিতাব আল-তাবীখ’-এ উল্লেখ রয়েছে এই খাবারের রেসিপি। সেখানে একে রমজান এবং অন্যান্য উৎসবে জনসাধারণের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে বিতরণ করা মিষ্টি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। দশম শতাব্দীতেই ইবনে সাইয়ার আল-ওয়াররাকের লেখা আরবি রান্নার বইয়েও উল্লেখ রয়েছে খাবারটির। জুলবিয়া এখনো আধুনিক ইরানে বেশ জনপ্রিয়। সেখানকার নওরোজ বা পার্সিয়ান নববর্ষে খাবারের থালায় এটি অপরিহার্য মিষ্টি হিসেবে হাজির থাকে।
জুলবিয়া দেখতে ভারতীয় জালেবির চেয়ে আলাদা। কারণ, জুলবিয়ার একটি ফ্লোরাল কয়েল প্যাটার্ন রয়েছে; অন্যদিকে জালেবি দেখতে বৃত্তাকার কয়েলের মতো। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের রেসিপিতে মধু ও গোলাপজলের সিরাপ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক; অন্যদিকে ভারতীয় জালেবি চিনির শরবত ব্যবহারে তৈরি করা হয়। ভারতীয় শব্দভান্ডার হবসন-জবসন অনুসারে, ‘জালেবি’ শব্দটি জুলবিয়ার ভারতীয় ডেরিভেটিভ, যার রেসিপি মধ্যযুগজুড়ে পারস্য ব্যবসায়ী, কারিগর ও মধ্যপ্রাচ্যের দখলদারেরা ভারতীয় উপমহাদেশে নিয়ে এসেছিলেন।
ঘরোয়া জলবল্লিকা বা কুণ্ডলিকার মতো ভারতীয় খাবারের সঙ্গে সুস্বাদু জুলবিয়ার মিশে যেতে অবশ্য সময় লাগেনি। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে, আদিবাসী উৎসবের পাশাপাশি বিয়ে ও অন্যান্য ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান উদযাপনের অংশ হয়ে ওঠে জালেবি। খাবারটি মসজিদের তবারক কিংবা মন্দিরের প্রসাদের অন্যতম প্রধান উপাদানও হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের ঝিলাম বংশীয় নেতা তানভীর বিন উদ্দিন নিজ দেশে এ খাবারের প্রতিষ্ঠায় জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, এই মিষ্টান্ন শরীরের শক্তির উৎস হিসেবে সর্বোত্তম।
জালেবি শব্দটি রেফারেন্সসহ প্রথম যে ভারতীয় বইয়ে পাওয়া যায়, তার নাম প্রিয়মকর্ণপাকথা (১৪৫০ সাল)। এটি একটি জৈন পাঠ্য, যার রচয়িতা জিনাসুরা নামের এক ব্যক্তি। ভারতীয় ধনী বণিকদের জন্য পরিবেশিত ডিনার মেনুর অংশ হিসেবে জালেবির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। পরবর্তীকালে ষোড়শ শতাব্দীতে সংস্কৃত পাঠ গুণ্যগুণবোধিনীতে একটি মিষ্টান্নের উপাদান এবং রেসিপি তালিকাভুক্ত করা হয়, যেটি বর্তমানের জালেবির মতো। ভারতীয় কূটনীতিক নাগমা মালিকের মতে, জালেবির যাত্রা সম্ভবত তুরস্কে শুরু হয়েছিল এবং ভারতে আসার আগে তিউনিসিয়ায় পৌঁছেছিল। অন্য এক মতানুসারে, আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশিদের শাসনামলে সংগীতজ্ঞ আবদুর রহমান ইবনু নাফা এটি তৈরি করেছিলেন। তিনি বাগদাদ থেকে আন্দালুসিয়ায় যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ায় দীর্ঘ যাত্রাবিরতি করেছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দীতে রঘুনাথের রেসিপি ও খাদ্যবিজ্ঞানের বই ভোজন কুতুহালাতে জিলাপির মতো মিষ্টি খাবারের উল্লেখ রয়েছে। খাদ্য ইতিহাসবিদ কেটি আচায়া তার ইন্ডিয়ান ফুড: আ হিস্টোরিক্যাল কম্প্যানিয়ন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হবসন-জবসনের মতে, জিলেবি শব্দটি আপাতদৃষ্টে আরবি জলাবিয়া বা ফার্সি জালিবিয়ার অপভ্রংশ। যদি তা-ই হয়, তাহলে পুঁথিগতভাবে শব্দটি এবং মিষ্টান্ন হিসেবে জালেবি ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক আগেই প্রবেশ করেছে।’
ভারতে এটি হিন্দিতে জালেবি নামে পরিচিত। দেশটির উত্তরাঞ্চলে প্রায়শ মিষ্টি কনডেন্সড মিল্ক, রাবড়ি, কাচোরি ও সবজির তরকারি সহযোগে খাওয়া হয়। কেরালার অত্যন্ত জনপ্রিয় স্ন্যাকসও এটি। এ ছাড়া উত্তরাখন্ড এবং উত্তর প্রদেশের একটি চলতি ব্রেকফাস্ট স্ন্যাকস, যা উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ডেজার্টের মতোই জনপ্রিয়।
জালেবির ভারতীয় রূপ উত্তর ভারতে কয়েক শতাব্দী ধরেই জনপ্রিয়। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে এটি বেশির ভাগ সময়ই জিলেবি হিসেবে উচ্চারিত হয়। দেশটির রথযাত্রার মেলায় পরিবেশিত বাঙালি জিলাপি হোক কিংবা দশেরার দিনে ফাফদার সঙ্গে খাওয়া গুজরাটি জালেবি, ভারতীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রায় দারুণ জায়গা করে নিয়েছে এই মিষ্টান্ন।
জালেবির বেশ কয়েকটি রূপ এখন ভারতের মূল ভূখণ্ডজুড়ে জনপ্রিয়। ইন্দোরের রাতের বাজার থেকে হেভিওয়েট জালেবা, বাংলার মর্যাদাপূর্ণ মিষ্টি প্রস্তুতকারকদের রান্নাঘরের ছানার জিলিপি, মধ্যপ্রদেশের মাওয়া জালেবি বা হায়দরাবাদের ডপেলগঙ্গার খোয়া জালেবি, এমনকি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে নামকরণ করা অন্ধ্রপ্রদেশের ইমারতি বা ঝাঙ্গিরি—একই জিলাপির কত নাম, কত রূপ!
আমাদের দেশে এই মিষ্টান্নকে প্রমিত বাংলায় জিলাপি বলা হলেও সিলেট, চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু অঞ্চলে একে ডাকে জিলাফি। একটি অপরিহার্য ইফতার আইটেম বা স্ন্যাকস হিসেবে ব্যাপক কদর এর। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান মিষ্টান্নেও পরিণত হয়েছে এটি। তাতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য; যেমন চেন্নার জিলাপি, মাষকলাইয়ের জিলাপি, সুন্দরী জিলাপি, শাহি জিলাপি প্রভৃতি।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top