skip to Main Content

মনোজাল I ফ্যাশন হোর্ডার

‘কিছু ফেলতে পারি না/ পুরনো ট্রাঙ্কে পড়ে থাকা/ ছেঁড়া মোজা জোড়া, ছেঁড়া সোয়েটার…’ বেদনাকাতর কণ্ঠে স্মৃতি আঁকড়ে রাখার গান গেয়েছেন মৌসুমী ভৌমিক। তাতে মনে দোলা দিয়ে যাক যতই, এমন অভ্যাস ডেকে আনতে পারে সর্বনাশা পরিণতি

ছেলেবেলায় পাওয়া প্রথম টেডি বিয়ার, লাল টুকটুকে নরম জামা, বহু ব্যবহৃত ব্যাকপ্যাক কিংবা খুব প্রিয় কোনো সামগ্রী রয়েছে আপনার সংগ্রহে? যা দীর্ঘদিন ধরে মূল্যবান সম্পদের মতো আগলে রেখেছেন, কিছুতেই ফেলতে পারছেন না? নিশ্চয়ই আছে, আমাদের সবারই থাকে। ভালোবাসা আর আগলে রাখার মতো। যার সঙ্গে বিচ্ছেদের চিন্তা আমরা সহ্য করতে পারি না। হয়তো তার সঙ্গে প্রিয় কোনো স্মৃতি জড়ানো, কিংবা যেটি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছেলেবেলায়। অথবা হতে পারে সেই পোশাক বা বস্তু আমাদের জন্য বয়ে এনেছে কোনো না কোনো সৌভাগ্য। সেটি সংগ্রহে রাখা দোষের কিছু নয়; বরং স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সংযুক্তি ও স্মৃতি যখন একজন ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রায় সবকিছুতে উপস্থিত থাকে, তখন সেটিকে স্বাভাবিক বলার উপায় থাকে না। বইয়ের ভাষায়, ব্যক্তিগত সম্পদের প্রতি তীব্র সংযুক্তি এবং অকারণে সেগুলো ধরে রাখার ইচ্ছাকে একটি বাধ্যতামূলক আচরণ হিসেবে ধরা হয়। যখন কেউ এ ধরনের আচরণ কিছুতেই ছাড়তে পারেন না, ছাড়ার চেষ্টাটাও কঠিন মনে হয়, তখন সেই আচরণকে হোর্ডিং ডিজঅর্ডার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফ্যাশন হোর্ডার শব্দটিও এসেছে সেখান থেকে। ব্যাপারটি অনেকের কাছে অচেনা মনে হতে পারে। যারা জানেন না তাদের বলছি, ফ্যাশন হোর্ডার বলা হয় তাদেরকে, যারা নিজের পোশাক কিংবা জুয়েলারি সংগ্রহ করে রাখেন, কেনাকাটায় অতিরিক্ত খরচ করেন এবং প্রয়োজন না থাকলেও বাধ্যতামূলকভাবে কেনাকাটা করেন। এটি একধরনের আসক্তি। অনেকটা মাদকের মতো, যা ছাড়তে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই যে সম্পদ ধরে রাখা, অহেতুক কেনাকাটায় অর্থ ব্যয় করা—এই আচরণ তাদের অস্থির আবেগকে শান্ত করে।
আমাদের আশপাশে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, কিংবা আমি বা আপনি নিজেই হয়তো সে রকম কেউ। আচরণটি যে স্বাভাবিক নয়, তা অনেক সময় ধরতে পারি না; আবার ধরতে পারলেও এতে আকাঙ্ক্ষা ও অপরাধবোধের ভয়ানক যে লুপ সৃষ্টি হয়, তা ভাঙা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যেক মানুষই তার আনন্দ ও প্রশান্তির স্মৃতিগুলোকে মূল্যায়ন করতে পছন্দ করেন। অনেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ঘটে নির্দিষ্ট কিছু পোশাকের মাধ্যমে। পোশাকগুলো অনেকটা মেমোরি ব্যাংকের মতো কাজ করে এমন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার গড়ে তোলে, যা তাদের নস্টালজিয়াকে ট্রিগার করতে পারে। ফলে তাদের মস্তিষ্কে একধরনের সুখানুভূতি জন্ম নেয় এবং মানসিকভাবে তারা প্রশান্ত হয়ে ওঠেন। নিজেই ভেবে দেখুন, যদি কোনো পোশাক আপনাকে আনন্দ দেয়, পুরোনো সুখকর দিনগুলোতে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেখায়, তাহলে আপনিও কি চাইবেন না সেটিকে আরও কিছু সময়ের জন্য লালন করতে? একজন ফ্যাশন হোর্ডার এসব আবেগকে সেই একটি বিশেষ বস্তুতে বাঁচিয়ে রাখেন, হতে পারে সেটি তার বিয়ের শাড়ি বা গাউন, সন্তানের প্রথম জামা কিংবা এমন একটি পোশাক, যা তাকে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ফ্যাশনবিশ্বে বলা হয়, যদি কেউ হোর্ডিং আচরণের সঙ্গে লড়াই করেন, অন্যরা তাদের ক্রয়ের ধরন দেখে তা আন্দাজ করতে পারেন। পুরো ব্যাপারটি তার আবেশী কেনাকাটা প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত থাকে বলে ধারণা করা হয়। ধরুন, খুব পছন্দের একটি পোশাক কিনতে গিয়ে দেখলেন, সেটি বিভিন্ন রঙে পাওয়া যাচ্ছে। সব কটিতেই আপনাকে সুন্দর লাগছে কিংবা পুরোপুরি মানানসই, তখন সেখান থেকে দু-তিনটি কেনার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। কিন্তু যখন মনে হবে, যেভাবেই হোক এই সব কটিই কিনে ফেলতে হবে; কারণ, আপনি নিশ্চিত যে এ রকমটা ভবিষ্যতে আর না-ও পাওয়া যেতে পারে, সে ভাবনা আসলে স্বাভাবিক নয়। এ ধরনের মানুষ মাথার ভেতর এমনটা ভেবে নিয়ে অত্যধিক এবং অর্থহীনভাবে কেনাকাটা করতে শুরু করেন। আবার, অনেক সময় কোনো পোশাকে ডিসকাউন্ট পাওয়া যাচ্ছে কিংবা সস্তায় বিক্রি হচ্ছে—এমন তথ্য কারও মনে এমন একটি শক্তিশালী সংবেদন সৃষ্টি করে, যাতে তার পক্ষে কেনাকাটা এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। আচরণ থেকে সৃষ্ট বাধ্যতামূলক এই ইচ্ছার কারণে একজন ক্রেতা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যয় করেন, যা মূলত এই আবেশী অভ্যাসের বীজ বপন করে।
সমস্যা হলো, অসংখ্য মানুষ আছেন, যারা নিজেরা জানেনই না তারা হোর্ডিং ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। ফলে এটি সারিয়ে তোলার ব্যাপারেও তাদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। পোশাকের মতো একটি জড়বস্তুর সঙ্গে আবেগগতভাবে সংযুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং এটিকে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাতে ব্যথা অনুভব করাকে তারা স্বাভাবিক বলে ধরে নেন। নিজেরা তাদের আচরণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন বলেই বিশ্বাস করেন না, তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। তাই চিকিৎসকদের মতে, হোর্ডিং ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা চ্যালেঞ্জিং এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কঠিন।

তবে যিনি রোগে ভুগছেন, তিনি যদি ব্যাপারটি বিশ্বাস করেন, তাহলে কাজটি সহজ হয়ে যায়। সমাধান হিসেবে প্রয়োজন পড়ে সাইকোথেরাপি কিংবা জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি। যার মাধ্যমে, কেউ তাদের আরও পোশাক কেনার তাগিদ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে পারেন। পাশাপাশি পুরোনো পোশাক ধরে রাখার বিষয়ে তার মনোভাব ও বিশ্বাসকে শনাক্ত ও চ্যালেঞ্জ করতে শিখতে পারেন। তার মানে, কোনটি রাখতে এবং কোনটি ফেলে দিতে হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বা তার সম্পদকে সংগঠিত ও শ্রেণিবদ্ধ করতে শিখতে পারেন। বলা বাহুল্য, কাজটি করার জন্য পেশাদার সাহায্য প্রয়োজন। তবে তা সম্ভব না হলে প্রিয়জনের সাহায্যেও এই তাগিদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এমন একজন মানুষ দরকার, যিনি তাকে কাজটি করতে বাধা দেবেন, কিংবা ধরিয়ে দেবেন যে তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। সবচেয়ে ভালো হয় মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোর ব্যাপারে সহায়তা করতে পারলে।
পরতে পরতে পোশাকটির রং নষ্ট হবে, একসময় ছিঁড়ে যাবে, তবেই তার পরিপূর্ণ ব্যবহার হবে—এমন বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা চাই। থরে থরে সাজানো নানা রঙের, ধরনের, তন্তুতে বোনা পোশাক পরে, দেখে এবং দেখিয়ে একজন যে আনন্দ পান, তা-ই তাকে এই আচরণ গড়ে তুলতে ও বাড়িয়ে চলতে উৎসাহিত করে। যখনই মনে হবে এমন কিছু করছি, রাশ টেনে ধরতে হবে তখনই। আবার পছন্দের জামাকাপড় প্রায় নতুন অবস্থায় আলমারির তাকে অপেক্ষা করে থাকে, গায়ে ছোট হয়ে যায়, অথচ মায়া ত্যাগ করে কাউকে দেওয়াও হয় না—এই মোহ ত্যাগ করা চাই। সহজ উপায় হচ্ছে, পোশাকটি ভালো থাকতে থাকতে কাউকে দিয়ে দেওয়া। তা না করতে পারলে বুঝতে হবে একজন ফ্যাশন হোর্ডারে পরিণত হতে যাচ্ছেন আপনি; সাবধান হওয়ার সময় চলে এসেছে।

 রায়া ফাতিমা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top