skip to Main Content

ফিচার I পুরোনো আরবের পাতে

আরবের কিছু খাদ্যসংস্কৃতি ইসলামের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। কিন্তু প্রারম্ভে কেমন ছিল তা?

ইসলামের শুরুর দিকে আরবের খাবার ছিল তাদের ভূমির মতোই শুষ্ক, বিস্বাদ ও খসখসে। তবে প্রাচীন শাম ও ইরাকে ধর্মটি পৌঁছানোর পর আরবের খাবার মেনু উন্নত হতে শুরু করে। উন্নতি ঘটে রন্ধনশৈলীর। ইসলাম সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের খাদ্যসম্ভার ঝলমলিয়ে ওঠে। আরব রসুইঘর ছাড়াও তাদের কবিতা ও গল্পে এসব খাবারের রসাল বর্ণনার উপস্থিতি শুরু হয়ে যায়।
মরুর শুষ্ক আবহাওয়ায় বসবাসের কারণে ইসলামের সূচনালগ্নে আরবদের আহার্যে খুব বেশি বৈচিত্র্য ছিল না। হাতের কাছের গাছপালা ও শিকারে পাওয়া প্রাণীই ছিল খাদ্যের মূল। তবে এসবের মধ্যেও কিছু খাবার ছিল, যা রন্ধন ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা পায়। তেমনই একটি মরুখাদ্য হলো ‘ছারিদ’। রুটি ছিঁড়ে প্রথমে ভেজানো হতো ঝোলে। পরে সেগুলোর ওপর দেওয়া হতো মাংস। এরপর কাঠ-কয়লায় জ্বাল দেওয়ার পর যে খাবার তৈরি হতো, সেটিই ছারিদ। এ ছাড়া সাখিনাতুন, আসিদাতুন, হারিরাতুন, হারিসাতুন, মাদিরাতুন নামে কিছু খাবারের চল ছিল আরবে।
টক দই যোগে রান্না করা মাংসকে বলা হয় মাদিরাতুন। এসব ছাড়াও এক প্রকার স্যুপ তৈরি করে খেতেন ইসলামপূর্ব আরবেরা। সেটি হলো হারিরা। আটা, চর্বি ও পানি জ্বাল দিয়ে তৈরি হতো এই স্যুপ।
খাজিরা নামে বিশেষ একটি পদ বেশ জনপ্রিয় ছিল আরবে। ইবনে মানজুর নামে এক আরব দিয়ে গেছেন সেই রেসিপি। মাংস ছোট করে কেটে জ্বাল দেওয়া হয় লবণ যোগে। এরপর তাতে আটা যুক্ত করে আবারও জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়। তারপর দেওয়া হয় পাতে। তবে মাংস ছাড়াও এই পদ তৈরি করা যায়। সে ক্ষেত্রে এর নাম দাঁড়ায় আসিদা।
আরবরা শুরু থেকেই মাংসপ্রেমী। তাদের মাংসপ্রীতির একটি গল্প প্রচলিত আছে। এক আরবকে মাংস ও রুটি দেওয়া হলে তিনি মাংস খেয়ে রুটি ফেলে দিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে বলেছিলেন, মাংস হজম হয়, রুটি হয় না। হাড়যুক্ত মাংস খুব বেশি পছন্দ ছিল আরবদের।
তবে উল্লিখিত খাবারগুলো ইসলামপূর্ব আরবের ধনাঢ্যদের পাতেই উঠত বেশি। গরিবেরা প্রায় সবই খেতেন। সেকালের দরিদ্র শ্রেণির কথা চিন্তা করেই বলা হয়; আরবরা যা পেতেন, তা-ই খেতেন। ক্ষুধাই সবচেয়ে সুস্বাদু মসলা—আরবদের কাছে এই কথা ছিল শতভাগ সত্য। কথিত আছে, একবার আরবের এক শহুরে ব্যক্তি এক গেঁয়ো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমরা কী খাও?’ উত্তর এসেছিল, ‘যা পাই, তা-ই খাই।’ তবে নিজেদের পছন্দ না হলে সেই খাবার মুখে তুলতেন না আরবরা; তা যত দামি কিংবা সুস্বাদু হোক না কেন। বিশেষ করে ভেড়ার মগজ তাদের কাছে ছিল ভীষণ অপছন্দের। তাই এর চোখ ও জিভ খেলেও মগজ খেতেন না। সেকালের আসাদ গোত্রের এক ব্যক্তি বলেছিলেন, তাদের খাবারই সবচেয়ে ভালো ও সুস্বাদু। তাদের মেনুতে ছিল গম, করলা, মর্টল ফল ইত্যাদি। ওই ব্যক্তির ভাষ্যে, এর চেয়ে মজাদার খাবার তাদের কাছে নেই। শুধু ক্ষুধা মেটাতেই নয়, আরবদের কাছে খাবার ছিল ওষুধ ও প্রসাধনীতুল্য। সেকালের আরবে সুস্বাস্থ্যকে নারীর অলংকার ভাবা হতো। তাই মোটা হওয়ার উদ্দেশ্যে মেয়েরা বেশি খেতেন খেজুর।
আরব ভোজনরসিকদের নামের তালিকায় রয়েছেন সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে তার সম্পর্কে যাহাবি লিখেছেন, ‘বলা হয়, একবার তিনি ৪০টি মুরগি খেয়েছিলেন। আরেকবার একটি ভেড়া, ছয়টি মুরগি এবং ৭০টি ডালিম খেয়েছিলেন।’ আরবদের খাদ্যবিলাসিতা তুঙ্গে উঠেছিল আব্বাসীয় শাসনামলে [৭৫০-১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ]। কথিত আছে, খলিফা রশিদের মেনুতে প্রতিদিন ত্রিশ ধরনের খাবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। খাবারের পেছনে তিনি দৈনিক ১০ হাজার দিরহাম ব্যয় করতেন।
শুধু নিজেরা উদর পূর্তি করে ক্ষান্ত হতেন না আরবরা, অন্যদেরও খাওয়াতেন। ‘কিতাবুল ওজায়ের’ গ্রন্থে আবু ইসহাক আল-সাবে বলেন, আব্বাসীয় মন্ত্রী ইবনে আল-ফুরাতের দুটি রান্নাঘর ছিল। একটি ছিল তার ব্যক্তিগত, অপরটি জনসাধারণের জন্য। প্রতিদিন জনসাধারণের জন্য ৯০টি ভেড়ার মাথা, ৩০টি ছাগল এবং কয়েক শ মুরগি রান্না হতো।
লেখক যাহাবি তার ‘তারিখুল ইসলাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, পারস্যের রাজা আমর বিন লাইস সাফফার বলেছেন, ‘আমার রান্নাঘরে প্রতিদিন ৬০০ উট জবাই হয়।’ মাসউদি লিখেছেন, আব্বাসীয় যুগে খাবারের প্রতিযোগিতা হতো।
রোম ও পারস্য থেকে আরবের রসুইঘর বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। এ কারণেই বেশির ভাগ আরবীয় মিষ্টির ফারসি নাম। অন্যদের খাবার নিজেদের মেনুতে গ্রহণ করায় আরবরা ছিলেন বেশ উৎসাহী।
মূলত উমাইয়া যুগে [৬৬১-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ] আরবীয় রান্নাঘরগুলোর বিকাশ ঘটতে শুরু করে। এর পেছনে হজরত মুআবিয়া (রা.)-এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। খাদ্য ও পানীয়ে তিনি ছিলেন ভীষণ বিলাসী। ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে ইবনে কাসির লিখেছেন, ‘মুআবিয়া যখন শামে আমির হয়ে এলেন, দৈনিক সাতবার খাবার খেতেন তিনি। প্রতিবারই মাংস থাকত। মিষ্টি ও ফলমূলও থাকত অনেক।’ মুআবিয়ার দস্তরখানায় চিকিৎসক উপস্থিত থাকতেন। তিনি তাকে বলে দিতেন, কোনটা উপকারী, কোনটা ক্ষতিকর। এই ধারা বজায় ছিল পরের প্রজন্মেও।
উমাইয়া যুগে বিকশিত হওয়া আরব রন্ধনশৈলী উন্নতির শেখরে পৌঁছায় আব্বাসীয় আমলে। চিকিৎসকদের দিয়ে তারা খাবারবিষয়ক বই লেখাতেন। তাতে উল্লেখ থাকত স্বাস্থ্যকর খাবার এবং সেসব খাওয়ার পদ্ধতি। ‘আল ফাহারসাত’ গ্রন্থে ইবনে নাদিম রান্নাবিষয়ক ১২টি গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। বইগুলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে খলিফাদের আগ্রহে লেখানো হয়েছিল বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
খাবার তৈরি ও রাঁধুনিদের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কোনো ছাড় দিতেন না আরবরা। বাবুর্চিকে নখ কাটতে, হাত ধুতে এবং হাঁড়ি পরিষ্কার করতে চাপে রাখতেন। এক বইতে জালালুদ্দিন শাইযারি বলেছেন, রান্নাঘরের ছাদ উঁচু করা উচিত। তা ছাড়া চুলার ছাদে চওড়া চিমনি রাখতে হবে, যেখান দিয়ে ধোঁয়া নির্গত হবে। যিনি রুটি তৈরি করেন, তিনি যেন তার পা, হাঁটু বা কনুই দিয়ে আটার খামির না করেন। এতে অঙ্গ থেকে ঘাম পড়তে পারে। পাশাপাশি তিনি যেন হাতে মোজা পরেন, কপালে কাপড় বাঁধেন, যাতে ঘাম না ঝরে। নাকে লাগতে হবে মাস্ক। যেন হাঁচি দিলে খাবারে কিছু না পড়ে। পাচকদের অবশ্যই চুল মুন্ডানো থাকতে হবে। যেন খাবারে চুল না পড়ে।
খাবারের ভেজালের দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতেন সেকালের আরবরা। এমনকি খাবার হোম ডেলিভারি দিতে নাবালেগ ছেলেদের পাঠাতেন তারা। যাতে পরিবারের লোকদের পর্দার খেলাফ না ঘটে।

 আহমেদ সজিব
চিত্রকর্ম: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top