কভারস্টোরি I স্বচ্ছতার সৌন্দর্য
চকচকে আয়নার মতো, নিজের কাছে নিজেই স্বচ্ছ হয়ে ওঠার মহিমা অপরিসীম। তাতে সহজ ও সাবলীল হয়ে ওঠে জীবনের পাঠ। লিখেছেন রুদ্র আরিফ
জীবনকে যদি কোনো মহাসড়ক ধরা হয়, এর ব্যাপ্তিজুড়ে পুরোটা পিচ ঢালাই করা সরল ও মসৃণ নয়; কোথাও কোথাও দুর্নিবার বাঁক, কোথাও খানাখন্দ। এই সড়কে জীবনগাড়ি চালানোর কালে চালক হিসেবে যে যত দক্ষ ও বিচক্ষণ, তার জন্য রাস্তা পাড়ি দেওয়া তত সহজ ও সাফল্যজনক হয়ে ওঠে। এই দক্ষতা ও বিচক্ষণতা তিনি শুধু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়েই অর্জন করেন না; থাকে পরোক্ষ অভিজ্ঞতারও ভূমিকা। অতীতের কোনো চালকের, গ্রন্থ কিংবা চলচ্চিত্রে জায়গা করে নেওয়া কোনো ব্যক্তির অভিজ্ঞতাগুলোও জোগায় পাঠ। তবে স্টিয়ারিং যখন নিজের হাতে, নিজ মস্তিষ্কের ওপরই রাখতে হয় মূল ভরসা। নিজ বিবেচনাবোধকে দিতে হয় গুরুত্ব। সহজ কথায়, নিজের কাছে যতটা সম্ভব স্পষ্ট হতে হয় পথ, পাথেয় ও বাহন সম্পর্কে। তাহলে, যদি শত সতর্কতা সত্ত্বেও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে যায়, নিজেকে অন্তত সান্ত¡না দেওয়া সম্ভব। নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পোষণ তাই জীবনের অন্যতর পাথেয় হয়ে ওঠে।
আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধের খেলা
আভিধানিক ভাষায়, সেলফ-ক্ল্যারিটি বা আত্মস্বচ্ছতা এমনই এক ধারণা, যা একজন ব্যক্তিমানুষের ভেতর থাকা সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির মাধ্যমে তাকে আত্মপরিচয় ও আত্মবিশ্বাসের মহিমা এনে দেয়। বলা হয়ে থাকে, যাদের আত্মসম্মানবোধ প্রখর, তাদের তুলনায় কম আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষের ভেতর আত্মস্বচ্ছতার উপস্থিতির ঘাটতি থাকে। পাঁচ শতাধিক ক্লায়েন্টকে মানসিক পরামর্শ দেওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ বব বিহেলের মতে, ‘স্বচ্ছতার ওপর মনোনিবেশ এবং তা অর্জন করা ছাড়া কারও পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় অনুপ্রেরণা পাওয়া। জীবনের পরিকল্পনা সাজানো অসম্ভব। অন্য কারও বা কিছুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করাও দুষ্কর।’
কিছু কিছু ব্যক্তিমানুষ এমন, নিজেদের বিষয়ে এবং নিজ নিজ জীবনকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, সেই সম্পর্কে যাদের স্পষ্ট ধারণা থাকে; নিজের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা, নিজ ব্যক্তিত্বের ধরন এবং নিজ মনোভাব ও মূল্যবোধের গুরুত্ব সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকেন তারা। অন্যদিকে, জগতে এমন মানুষও মেলে, নিজের সম্পর্কে যাদের ভেতর স্পষ্ট ধারণার খুব একটা উপস্থিতি থাকে না; কিংবা থাকলেও নিতান্তই কম। নিজেদের সম্পর্কে, নিজ অবস্থানের গুরুত্ব সম্পর্কে, এমনকি নিজ সক্ষমতা সম্পর্কেও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়ে যায় তাদের। নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে নিজেকে ভালোভাবে জানা সম্ভব হয়ে ওঠে; অন্যের সঙ্গে আসন্ন সংঘাত এড়াতে তারা পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং পৃথিবী দেখার দৃষ্টিও তাদের হয় তুলনামূলক শাণিত।
অন্যদিকে, আত্মমর্যাদাবোধকে দেখা হয় একজন ব্যক্তিমানুষের এক সামগ্রিক মূল্যায়ন হিসেবে, হোক সেটি ভালো কিংবা খারাপ; আর আত্মধারণার স্বচ্ছতাকে দেখা হয় ওই মানুষের ভেতর জন্মগতভাবে সাজানো জ্ঞানের পরিধি বিবেচনায়। এককথায় বলা যেতেই পারে, নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা এমনই সদ্্গুণ, যা ব্যক্তিমানুষের কাছে জীবন বোঝাপড়ার এক ব্যাপক বোধ ও তাৎপর্য হাজির এবং নিজ জীবনের ভালো ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
নিজে স্বচ্ছ থাকলে আত্মবিশ্বাস গাঢ় হয়ে ওঠে। আর তা অর্জনে নিজেকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করা ভালো। যেমন, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কালে লক্ষ্যের ব্যাপারে সুনিশ্চিত থাকা। সেই সব সিদ্ধান্তের প্রশ্নে নিজের অনুভূতি ও অভিব্যক্তি আত্মবিশ্বাসসহ প্রকাশ করা। কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে সেই বিষয় নিয়ে কথা বলা। আর ধারণা স্বচ্ছ করতে সমালোচনামুখর প্রশ্ন হাজির করা। মনোবিদেরা বলেন, কী করতে বা পেতে চান, তা নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলে সফল হওয়ার পথ বেছে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মস্বচ্ছতার অন্যতম প্রাথমিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে আত্মমর্যাদার সঙ্গে। যেসব ব্যক্তিমানুষের আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর, তারা সাধারণত নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ও সরব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন; অন্যদিকে কম আত্মমর্যাদাসম্পন্নদের ভেতর নিজের সম্পর্কে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অনিশ্চিত ও নড়বড়ে দৃষ্টিভঙ্গির দেখা মেলে। গবেষণায় জানা যায়, যাদের আত্মস্বচ্ছতার ধারণা উন্নত, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, উৎকণ্ঠা, স্নায়বিকতা প্রভৃতি মনোরোগে ভোগার প্রবণতা কম; তারা কম আত্মস্বচ্ছতাসম্পন্নদের তুলনায় সামাজিক সমর্থন ও মানসিক সমন্বয়ে অধিক পারদর্শী।
মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে আত্মস্বচ্ছতার সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে গবেষকেরা আরও দেখেছেন, যাদের মধ্যে এই ধারণা কম, তারা জীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে বোঝাপড়া করার কালে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে অন্যের দ্বারস্থ হন, অন্যদের অনুকরণের চেষ্টা করেন; তাতে সবকিছু গোলমাল লেগে যায়। কেননা, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ নানা দিক থেকেই আলাদা। অন্যদিকে, আত্মস্বচ্ছতা যাদের কাছে যত বেশি স্পষ্ট, তারা প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানোর সময় তত বেশি সঠিক ও সময়োপযোগী কর্মকাণ্ড, পরিকল্পনা তৈরি এবং প্রতিকূলতাকে ইতিবাচকরূপে পরিণত করতে সক্ষম।
দমের দাম
শুধু তা-ই নয়, নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারিবারিক ও কর্মজীবনেও রাখে প্রবল প্রভাব। ধরা যাক, নিজেকে আপনি দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে তৈরি করেছেন কোনো প্রতিযোগিতার জন্য। হতে পারে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা কিংবা চাকরির লড়াই। আর তা নিয়ে শুধু নিজের মধ্যেই নয়, আপনাকে ঘিরে রাখা অন্যদের বা সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যেও প্রত্যাশার পারদ উঠে গেছে শীর্ষে। অথচ চূড়ান্ত ফলে দেখা গেল, বিজয়ের মুকুট আপনার মাথায় ওঠেনি; ছিনিয়ে নিয়েছে অন্য কেউ। এমন পরিস্থিতিতে হতোদ্যম হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তা কত দিনের জন্য? চিরকালের জন্য রণে ভঙ্গ দেবেন? নাকি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবেন আবার? নতুন করে নামবেন লড়াইয়ের ময়দানে?
‘আমি কে? আমার পক্ষে কত দূর যাওয়া সম্ভব? সত্যি কি বিজয়ের মুকুট আমার জন্যই?’ নিজের কাছে এমন বেসিক প্রশ্নগুলোর জবাব যদি স্পষ্ট থাকে, আর যদি তা ইতিবাচক হয়, দেখবেন পরাজয় বা ব্যর্থতার ভয় আপনাকে স্থায়ীভাবে কাবু করতে পারছে না। এটাই আত্মস্বচ্ছতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। এর এক জ্বলজ্বলে বৈশ্বিক উদাহরণ লিওনেল মেসি। অল্প বয়স থেকেই এই আর্জেন্টাইন ফুটবলারকে গণ্য করা হয়েছে জগতের সবচেয়ে প্রতিভাধর খেলোয়াড়দের একজন হিসেবে। বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়তে বাড়তে তা তাকে অনেকের বিবেচনায় সর্বকালের সেরা ফুটবলারের তকমাও এনে দিয়েছে। তবু তাতে জুড়ে ছিল ‘যদি… কিন্তু…’। কেননা, ক্লাব ফুটবলে বার্সেলোনার হয়ে সম্ভাব্য সব শিরোপাই জিতেছেন তিনি; দিয়েছেন নেতৃত্ব। অথচ জাতীয় দলের হয়ে সেই প্রত্যাশা যেন মেটাতে পারছিলেন না। ফলে ‘মেসি শুধু ক্লাব ফুটবলেই ভালো করেন, দেশের জন্য কিছু করতে পারেন না…’ এমনতর সমালোচনায়ও অহর্নিশ বিদ্ধ হতে হয়েছে তাকে। শুধু তা-ই নয়, ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ২০১৪-এর ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালে যখন দল হেরে গেল, খোদ আর্জেন্টিনাতেই মেসির বিরুদ্ধে হয়েছে বিক্ষোভ, ভাঙা হয়েছে তার ভাস্কর্য। এরপর একাধিক কোপা আমেরিকা প্রতিযোগিতার ফাইনালে হেরে যাওয়ায় জাতীয় দলের হয়ে তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। এমনকি হতাশায় মুহ্যমান মেসিও সাময়িকভাবে ধরে নিয়েছিলেন, ‘আর নয়’! সেই মানসিক ধকল সামলিয়ে তিনি আবার ফিরেছেন জাতীয় দলে। আর নিজের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপে, ২০২২-এর আসরে ‘বুড়ো’ মেসি শেষ চেষ্টা চালানোর দেখিয়েছেন প্রত্যয়। তাতে প্রথম ম্যাচেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল সৌদি আরবের কাছে হেরে যাওয়ার পর আবারও হাসির পাত্রে পরিণত হতে হয়েছিল তাকে। ‘হোয়্যার ইজ মেসি?… মেসি কোথায়?…’ ট্রল ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর জবাব তিনি কীভাবে দিয়েছেন, তা তো সব ফুটবলপ্রেমীরই জানা! স্বল্পভাষী মেসি সামর্থ্যরে প্রশ্নে নিজের কাছে ছিলেন স্পষ্ট; এর দারুণ ফল তিনি পেয়েছেন অবশেষে।
আত্মধারণার দোলা
আপনি আসলে কে? কী আপনাকে ‘আপনি’ করে তুলেছে? ধরা যাক এমন নিগূঢ় প্রশ্নের মুখোমুখি করা হলো আপনাকে। হয়তো জবাবে বলবেন, ‘আমি একজন মা,’ কিংবা ‘আমি চিকিৎসক’, কিংবা ‘ধর্মবিশ্বাসী,’ ‘একজন ভালো বন্ধু’, ‘ভাই’। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ‘আমি আমার কাজের জায়গায় দুর্দান্ত,’ ‘আমি একজন সুসম্পন্ন মিউজিশিয়ান,’ কিংবা ‘সফল খেলোয়াড়’। কেউ হয়তোবা দেবেন অন্য জবাব, ‘আমি হৃদয়বান মানুষ,’ ‘আমি বুদ্ধিদীপ্ত ও কঠোর পরিশ্রমী’, কিংবা ‘আমি খুব সরলমনা’।
এসব জবাব সাধারণত ব্যক্তিমানুষের অন্তস্তল থেকে উঠে আসে। জীবনকে তিনি এত দিন যেভাবে দেখে এসেছেন, সেই বোধ থেকেই এর ঘটে আবির্ভাব; অথচ জীবনের চলার পথে এই বোধের নিরন্তর পুনর্মূল্যায়ন ও সমন্বয় ঘটতে থাকে। আর সেই সূত্রেই মনোবিজ্ঞানে আত্মধারণা বিষয়টির আবির্ভাব।
আত্মধারণা গড়ে ওঠা প্রসঙ্গে তাত্ত্বিকেরা মোটামুটি কয়েকটি ব্যাপারে একমত হয়েছেন। তাতে দেখা যায়, সার্বিকভাবে এ এমন একটি সামগ্রিক আইডিয়া, যা জ্ঞানীয় ও কার্যকর বিচারবোধসহকারে আমাদেরকে নিজ প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে বার্তা দেয়। এই ধারণা বহুমাত্রিক, যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। এটি জন্মগতভাবে অর্জন করা কোনো গুণ নয়, বরং শিখে নিতে হয়। জৈবিক ও পরিবেশগত বিষয়-আশয় একে প্রভাবিত করলেও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া তাতে রাখে বিরাট ভূমিকা। সাধারণত শৈশব ও কৈশোরজুড়েই এর বিকাশ ঘটে, তবে প্রাপ্তবয়স্ককালে তা হরদম পরিবর্তিত কিংবা পরিমার্জিত হতে পারে। বাস্তবতার সঙ্গে সব সময় যে এর কোনো সম্পর্ক থাকতে হবে, তা নয়; কল্পলোকও তাতে নাড়তে পারে কলকাঠি। আর আত্মধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে আত্মস্বচ্ছতার ধারণা। নিজেকে জানা হয়ে গেলে, নিজের সম্পর্কে ধারণা গড়ে উঠলে, প্রয়োজনে আর রুচিভেদে তা রূপান্তর ও পরিমার্জন ঘটিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাতে গড়ে উঠবে আত্মস্বচ্ছতার বিচ্ছুরণ।
গড়ার উপায়
নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সত্যিকারের আত্মপরিচয়, তার অনুভূতি ও নীতিবোধ জড়িয়ে থাকে। এই ধারণা গড়ে তোলার নির্দিষ্ট বয়স নেই; শুধু এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা চাই। তাতে কিছু চর্চা দেবে সহায়তা। এর শুরুতেই রয়েছে নিজেকে জানার গুরুত্ব। নিজের প্রকৃত সত্তাকে চেনার একটি সচেতন চেষ্টা থাকা চাই ব্যক্তিমানুষের ভেতর। আর তা অর্জন করতে পারলে নিজেই হয়ে ওঠা সম্ভব নিজের এমন এক বন্ধু, যে জীবনের চলার পথে কখনো কোনো পরিস্থিতিতেই হাত ছেড়ে দেবে না। কীভাবে চিনবেন নিজেকে?
এ বিষয়ে আমেরিকান লেখিকা, সাংবাদিক ও মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টাল রেপোল রেখেছেন কিছু দারুণ পরামর্শ। তার মতে, শুরুতেই গুরুত্ব দেওয়া চাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ওপর। ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা বা নিজেকে স্বমহিমায় তৈরি করার প্রক্রিয়া মানুষের মনে সহজাতভাবেই ডালপালা মেলে। সবাই তা উপলব্ধি করতে পারেন না; কেউ কেউ করেন। যারা করেন, তারা জীবনের নানা বাঁকে ঘটান এর নানা সংশোধন। তার আগে, শৈশবেই এই কিছু লক্ষণ ফুটে ওঠে। তাতে কখনো কখনো যে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়, সে কথা বলা বাহুল্য। কোনো কোনো শিশুর আত্মপ্রকাশের ভঙ্গিমাকে বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়-পরিজন ভালোভাবে নেন না; নিন্দামন্দ করেন। তাতে শিশুটি আপাতদৃষ্টে দমে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই শিশু যখন বড় হয়ে ওঠে, যদি নিজের ভেতর সুপ্ত থাকা সেই সহজাত ও স্বকীয় ব্যক্তিত্বের করতে পারে যথাযোগ্য লালন, তাহলে তার পক্ষে প্রকৃত আত্মপরিচয়ের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব।
তা ছাড়া প্রাত্যহিক রুটিনের বাইরে সময় ও সুযোগ পেলেই নিজেকে ঠেলে দিতে পারেন অনভ্যস্ত ও নতুন পরিস্থিতির ভেতর। যেমন ধরুন, আগে কখনো যাননি, এমন কোনো জায়গায় একলা ভ্রমণে যেতে পারেন। তাতে নিজ ব্যক্তিত্বের নতুন কোনো দিক প্রকাশ পেতে পারে সামনে। হয়তো অবাক হয়েই খেয়াল করবেন, কত অজানার সান্নিধ্য এত দিন পাননি!
মনোবিশ্লেষকদের মতে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার একটি সীমারেখা তৈরি করে নেওয়াও ভালো। ‘মন কী যে চায় বলো…’কে নিয়ন্ত্রণ করতে তা সাহায্য করবে। কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার অনুভূতিকে ইতিবাচকভাবে করা যেতে পারে নিজ মনোজগতে প্রয়োগ। তাতে শুধু নিজেকে দোষারোপ করলেই চলবে না; নিজেই নিজের পিঠে রাখা চাই অদৃশ্য অথচ বোধযোগ্য হাত। সহজ কথায়, অন্যের সমবেদনার মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই নিজেকে দেওয়া ভালো সান্ত্বনা। পাশাপাশি, অতীতের কোনো ক্ষত পুষে না রেখে, কিংবা পুরোদস্তুর এড়িয়ে না গিয়ে, নিজের মতো করে সারিয়ে তোলা চাই। নিজে নিজে; অথবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে।
পুষ্পমঞ্চ
বলা হয়ে থাকে, জীবন ফুলের বিছানা নয়। এ অনেকটাই ধ্রুব সত্য। তবু জীবনের কাঠখড় পোড়াতে পোড়াতে যে মানুষ নিজের কল্পজগৎকে করতে পারেন সমৃদ্ধ, তার পক্ষে প্রতিকূল পরিবেশকেও মনে মনে আদিগন্ত পুষ্প উদ্যান হিসেবে ভেবে নেওয়া সম্ভব। আর তা নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকারই এক অনন্য সৌন্দর্যের ফল।
‘জীবন যদি একটি মঞ্চ হয়ে থাকে, আর আপনি তাতে নিজেই নিজের প্রতিনিধি, তাহলে নিজের মর্জিমতো চরিত্রে অভিনয় করতে ইতস্তত করবেন না,’ বলেছেন আমেরিকান কবি ও লেখিকা রিচেল ই. গুডরিচ। আসলে তাই! নিজেকে স্পষ্টভাবে জানা থাকলে সেই অভিনয় করাটা, মোদ্দাকথা, নিজের মতো জীবনযাপন করতে পারাটা সহজ ও সাবলীল হয়ে ওঠে।
নিজের কাছে অচেনা নই : রাজ
নিজের সঙ্গে অনেক কথা হলেও কখনো মিথ্যা বলি না। আদর্শ নিয়ে আমার দৃষ্টি পরিষ্কার। সিদ্ধান্তের শিকড় জানি। অল্প বয়সেই নিজের নীতি-জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হয়েছি। আমার ওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম সাহায্য করেছে নিজেকে বুঝতে। নিজস্ব কাজের দায়িত্ব নিতে শিখেছি। জীবনে যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিস্থিতি এসেছে, নিজেকে সময় দিয়েছি। নৈতিকতাবোধকে পাশে সরিয়ে রাখিনি; বরং নিজ মতবাদ আর দর্শন সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। তাই কখনো থমকে গেলে আমাকে বুঝিয়েছি যে, স্বচ্ছতা গুরুত্বপূর্ণ। জীবন এতে বরং কিছুটা কঠিন হয়েছে বলা যায়। কারণ, নিজেকে চিনতে হয়েছে, নিজস্ব মতামতকে মূল্য দিতে স্রোতের বিপরীতে পাড়ি দিতে হয়েছে। এখনো হয়! তাতে মসৃণতার চেয়ে দুর্গমতা বেশি। কিন্তু আমি ভাবনাহীন নিশ্বাস নিতে পারি। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। আমার আদর্শ আর নীতি কী, তা জানি। তাই নিজের কাছে অচেনা নই; বরং খুব চেনা।
নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া : সুনেরাহ্
আমার আয়না আমি নিজে। নিজস্বতা সবটুকু চিনেছি ধীরে ধীরে; তবে খুব ভালো করে। জানি আমি কী চাই। চাওয়ার পেছনের যুক্তি কখনোই অগ্রাহ্য করিনি। অন্যথায় আদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সত্যে বিশ্বাসী, তাই সত্য আমাকে সাহসী করেছে। মিথ্যা বয়ান সাময়িক স্বস্তি দিতে পারবে; কিন্তু সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার শক্তি মিথ্যার নেই। চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন, পরিকল্পনা—সবকিছুই নিজের কাছে স্বীকার করি। ঠিক তেমনি কোনো ভুল হলে আসামি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকও হই। নিজেই প্রশ্ন করি, উত্তর দিই। নিজস্বতায় আঘাত লাগে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিই না। নিজের সঙ্গে অভিনয় করে বাঁচা যায় না। নিজেকে আমি ভালোবাসি। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কোনো মিথ্যে নেই।
অনুলিখন: ফুয়াদ রূহানী খান
মডেল: সুনেরাহ্ ও রাজ
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ওটু
ছবি: কৌশিক ইকবাল