skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I অবাক ট্রেনে পাহাড়চূড়ায়

মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্য। পাহাড়, অরণ্য, সাগর, সাগরের ওপর সেতু, মনোমুগ্ধকর দালানকোঠা, স্ট্রিট ফুড—সব মিলিয়ে অসাধারণ এক লোকেশন। বড় আকর্ষণ পেনাং হিল। আশ্চর্য এক ট্রেনে চেপে পৌঁছাতে হয় সেখানে। সবুজ সেই পাহাড়রাজ্য ভ্রমণের গল্প শোনাচ্ছেন ইশতিয়াক হাসান

ট্রেন নাকি ট্রাম—একে কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। লাইনটি আমাদের রেলপথের মতোই, তবে একটিমাত্র বগি দেখে ট্রামের কথা মনে পড়ে বেশি। আর এতে চেপে আমরা উঠে পড়েছিলাম পেনাং হিলে। উপভোগ করেছিলাম অসাধারণ এক পাহাড়রাজ্যের সৌন্দর্য।
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগেই একগাদা লোকেশনে ভ্রমণের পরিকল্পনা মাথায় ঢুকিয়ে নিই। দলবল নিয়ে ঘুরতে গেলে যা হয়, লিস্টির কোনো কোনোটিতে যাওয়ার সুযোগ ঘটে না। তবে তালিকায় ছিল না এমন কয়েকটি স্থান আবার ঘোরা হয়ে যায়। অবশ্য পেনাং হিল আমার ‘অবশ্যই যেতে হবে’—এমন গন্তব্যগুলোর লিস্টিতে ছিল ওপরের দিকেই।
পেনাং পাহাড়কে বাছাইয়ের কারণ দুটি। প্রথমত, পাহাড়-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অদ্ভুত এক রেলগাড়ি ভ্রমণ; অপর কারণ, পেনাং হিলের জঙ্গল ও বন্য প্রাণী দর্শন। অবশ্য সময় বেশি পাব না বলে মূলত পেনাং পাহাড়ের দ্য হেবিটাল পেনাং হিল নামের অংশেই ঘুরে বেড়ানোর মনস্থির করলাম। পাহাড়ের এই অংশে পথ-ঘাটের সুবিধার কারণে ঘোরাফেরা সহজ। নানা প্যাকেজের আওতায়ও এখানকার প্রকৃতি ঘুরিয়ে দেখানো হয়।
ভ্রমণ দলে আমি ছাড়া ছিল স্ত্রী পুনম, মেয়ে ওয়াফিকা, শাশুড়ি ও খালাশাশুড়ি। আমার শ্যালিকা ডোনা ও তার স্বামী সেলিম মালয়েশিয়ার বাসিন্দা হওয়ায় বাড়তি সুবিধা হয়ে গেল। ওরাই আমাদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির বিভিন্ন এলাকা।
পেনাং পৌঁছানোর তৃতীয় দিন সকালে রাজ্যটির রাজধানী জর্জটাউন থেকে আমরা গেলাম পেনাং হিলে। সেখানে গিয়ে জানলাম, শুধু ওই ট্রেনে চাপতেই (আসা-যাওয়া) জনপ্রতি গুনতে হবে ৩০ রিঙ্গিত। তখন এক রিঙ্গিত মানে আমাদের ২৫ টাকার সমান। এদিকে জঙ্গল আমাকে যত টানে, পুনম বাদে অন্যদের সিকি ভাগও নয়। তাই ওয়াফিকাসহ বাকিরা গেল পাশের এক পাহাড়ে, সেলিমের গাড়িতে চেপে ঘুরতে। আমি আর পুনম টিকিট কেটে চড়ে বসলাম ট্রেন বা ট্রাম—যা-ই বলি, তাতে। পরে অবশ্য অন্তর্জাল ঘেঁটে নিশ্চিত হয়েছি, এটি ট্রেনই; তবে বিশেষ ধরনের। এর ইতিহাস বেশ পুরোনো। এই রেলপথ ও ট্রেন পরিচিত ফিউনিকুলার রেলওয়ে নামে। সাধারণত খাড়া পথ উঠতে এ ধরনের ট্রেন ব্যবহার করা হয়। এতে দুটি বগি পরস্পর জোড়া লাগানো; দেখে মনে হয়, যেন একটিই।
এই রেলওয়ে যখন তৈরি করা হয়, মালয়েশিয়ায় তখন ব্রিটিশ রাজত্ব। মূলত পেনাং পাহাড়ের শীতল আবহাওয়া উপভোগের জন্যই এই পথের গোড়াপত্তন, ১৯২৩ সালে। এয়ার ইতাম নামে একটি স্থান থেকে যাত্রা শুরু করে রেলওয়েটি চলে গেছে একেবারে পেনাং পাহাড়ের ওপরে। তবে পুরোনো বগি আর রেলট্র্যাক—কিছুই এখন নেই। ২০১০ সালে পুরোনো রেলওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরের বছরের এপ্রিলে নতুন ট্র্যাক ও বগি নিয়ে আবারও যাত্রা শুরু পেনাং হিল রেলওয়ের।
প্রথম ট্রেনটিতে আমরা ইচ্ছা করেই উঠলাম না। নয়তো বগির একদম পেছনের দিকে জায়গা হতো। পরের ট্রেনে একেবারে সামনের দিকে জায়গা পেয়ে গেলাম। এতে ভারি মজা হলো। ট্রেন ছাড়তেই সামনের রেলপথটি চোখ জুড়িয়ে দিল। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। ট্রেন থেকে শুরুতে দূরে, পাহাড়ের গায়ে থাকা ঘরবাড়ি নজর কাড়ল। তারপর বেশ চেপে গেল ট্র্যাকটি। প্রায় গা ঠেকিয়ে দুই পাশে পাহাড়ি ঢাল। তাতে হরেক গাছপালা। সবুজের মাঝখান দিয়ে এভাবে ট্রেনে চেপে যেতে বেশ মজা লাগছিল। পথটি সংক্ষিপ্ত হলেও অভিজ্ঞতা একেবারে অন্য রকম।
বলে রাখি, পেনাং হিল বুকিট বেন্দেরা নামেও পরিচিত। এটি ইউনেসকো ঘোষিত বায়োসফিয়ার রিজার্ভ। এর সর্বোচ্চ চূড়া ২ হাজার ৭৩৩ ফুট।
ওপাশ থেকে আসা ছোট ছোট ট্রেনকে দেখেও ভারি আনন্দ হচ্ছিল। একটু পর যখন সামনে খাড়া উঠে যেতে দেখলাম রেলপথকে, দারুণ এক রোমাঞ্চের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল দেহ-মনে। মনে হলো যেন থ্রিডি মুভির কোনো রোলার কোস্টারে চড়েছি। ওয়াফিকাকে আনলে খুব আনন্দ পেত, ভেবে মনটা একটু খারাপ হলো।
একটি টানেল পার হয়ে শেষ হলো আমাদের মিনিট দশেকের অসাধারণ যাত্রা। সুড়ঙ্গটি অবশ্য বেশি বড় নয়; তবে ঘটনা হলো, এর আগে কখনো ট্রেনে চেপে কোনো টানেল পেরোইনি। ট্রেন থেকে নামার পর দেখি, অসংখ্য মানুষ। এদের মধ্যে বিদেশি পর্যটক আছেন অনেক। তাদের দেখে, আমাদের দেশের পাহাড়ে-সমতলে দেখার মতো জায়গার কমতি নেই, তবে বিদেশি পর্যটক এত কম আসেন কেন—ভাবনাটি আরেকবার ডালপালা মেলল মাথায়।
একাধিক পথ চোখে পড়ল। আমরা একটি বেছে নিলাম। পাকা ওই পথের এক পাশে পাহাড়ের গায়ে গাছপালা, আরেক পাশে খাদ। চোখ-কান খোলা রাখছি, যদি কোনো বন্য প্রাণীর দেখা মেলে। অন্তর্জাল ঘেঁটে জেনেছিলাম, পেনাং দ্বীপে যত ধরনের পাখি আছে, আশি শতাংশের বেশি এ পাহাড়ে। সংখ্যায় শখানেক। আগেই জেনেছি, অরণ্যটি অনেক পুরোনো হলেও বড় প্রাণী খুব বেশি নেই। গন্ধগোকুল বা পাম সিভেট, আমাদের চশমা হনুমানের জ্ঞাতি একধরনের লেঙ্গুর বা বানর, বুনো শূকর, উড়ন্ত লেমুর (আসলে গ্লাইড করে), বড় জাতের কাঠবিড়ালি, বিভিন্ন ধরনের সাপ আছে এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রাণিসত্তার তালিকায়।
একটি বিষয় দেখে বেশ ভালো লাগল। পথে একটু পরপরই হেবিটাল পেনাং হিলের মানচিত্র দেওয়া। এটি অনুসরণ করে চললে পথ ভুল হওয়ার আশঙ্কা নেই। আবার এই বনে-পাহাড়ে কোন কোন জীবজন্তুর বাস, তা-ও কোথাও কোথাও বোর্ডে ছবিসহ দেওয়া আছে।
তারপরই অসাধারণ এক জায়গায় চলে এলাম। পাহাড়ি এক খাদের ওপর লম্বা একটি ঝুলন্ত সেতুর মতো। আগেই জানা ছিল, এর দৈর্ঘ্য ২৩০ মিটার। নাম দেখলাম লেঙ্গুর ক্যানোপি ব্রিজ। তবে চশমা বানরেরা এটি ধরে চলে কি না, বলতে পারব না। এ ধরনের হনুমান অনেক নামে পরিচিতি; যেমন ডাসকি লিফ মাঙ্কি, ডাস্কি লেঙ্গুর। মালয় ভাষায় এদের বলে লুতং।
এই জায়গাতে অনেকটা সময় কাটালাম। কারণ, গভীর বনানীর মাঝখানে এমন দীর্ঘ সেতুতে ভ্রমণের সুযোগ মেলা ভার। সেতুর নিচের খাদে জন্ম নেওয়া প্রাচীন সব বৃক্ষ নজরে পড়ল। আমাদের মাথার অনেক ওপর পর্যন্ত উঠে গেছে। সেতুতে আরও অনেক পর্যটক ঘোরাফেরা করছেন। কেউ দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। সেতুতে দাঁড়িয়ে একটু দূরে পেনাং হিলের গভীর জঙ্গলাবৃত পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সহজেই বোঝা যায়, শতবর্ষী বহু বৃক্ষ এখানকার অরণ্যে বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে।
সেতু পেরোবার পর গাছপালার মাঝখানে চমৎকার একটি দোলনার দেখা মিলল। বয়স্ক এক মালয়েশিয়ান নারী নিজে থেকেই আমাদের ছবি তুলে দিতে চাইলেন। আমরা সবুজের মাঝখানে মিশে যাওয়া দোলনায় বসে পড়লাম। আর হলাম ওই নারীর ক্যামেরাবন্দি। এরপর এগোতে এগোতে পৌঁছে গেলাম এমন এক জায়গায়, যেখানে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে হলে আবারও টিকিট কাটা লাগে। দাম বেশ চড়াও। টিকিটপ্রতি ৫৫ রিঙ্গিত। একটু দোটানায় ছিলাম। কিন্তু তখনো বলার মতো তেমন কোনো বন্য প্রাণীর দেখা পাইনি বলে ফিরতে মন সায় দিল না। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম সেই জঙ্গলে।
এবার অবশ্য গাছপালার ঠাসবুনোটের মাঝখান দিয়ে এগোবার সময় চোখে পড়ল কয়েক জাতের পাখি। তারপর বিশাল আকারের একটি কাঠবিড়ালি নজর কাড়ল। জানা ছিল, এর নাম ব্ল্যাক জায়ান্ট স্কুইরাল বা মালয়েশিয়ান জায়ান্ট স্কুইরাল। তারপরই চলে এলাম স্কাইভিউ ওয়াক নামে অদ্ভুত সুন্দর এক স্থানে। এখানে টিকিট কেটে আসার এটিও একটি বড় কারণ। প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে বেশ ওপরে। আমরা সেই সিঁড়ি ধরে ঘুরতে ঘুরতে একেবারে ওপরে উঠে পড়লাম। মুহূর্তেই আশ্চর্য এক পৃথিবীর দরজা যেন খুলে গেল আমাদের সামনে।
প্যাঁচানো সিঁড়িটি গোলাকার এক কাঠামো তৈরি করেছে। নিচে তাকালে ওঠানামা করতে থাকা মানুষদের দেখা যায়। তবে আসল আনন্দ পাওয়া যায় এখানে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে। এক পাশে উঁচু পাহাড়, তাতে গভীর বনানী নজর কাড়ে। কখনো কখনো একটি-দুটি বাড়িও পড়ে চোখে। অবশ্য পর্যটকদের মূল আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে অপর দিকটি। মানে, সামনের বিস্তৃত সাগর। সাগরের এপারে সবুজ পাহাড়, দালানকোঠা; আবার দূরে, ওপারেও গাছপালা, ঘরবাড়ি। আরেকটি জিনিসে আপনার চোখ এখানে এলে নিশ্চিত আটকে যাবে! তা হলো সাগরের বুক চিরে চলে যাওয়া একটি সেতু। এত ওপর থেকে একে হয়তো ফিতার মতো মনে হবে। মালয়েশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পেনাং নামের দ্বীপকে সংযুক্ত করেছে যে দুটি, এর একটি এটি। সাগর শুরুর আগে নিচে সবুজের মাঝখানে সুবিন্যস্ত উঁচু উঁচু দালান মোটেই চোখে জ্বালা ধরাচ্ছিল না; বরং আরাম দিচ্ছিল।
অনেকটা সময় ওই গোল-প্যাঁচানো সিঁড়ির ওপরের জায়গাটি থেকে চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। একসময় রোদের তেজ সহ্যের অধিক বেড়ে গেলে বাধ্য হলাম নিচের দিকে নেমে আসতে। ফিরতি পথে দেখি, ক্যানোপি ব্রিজে পর্যটকদের ভিড়। অন্তত একটি চমশা হনুমানেরও দেখা পেলাম না—ভেবে মন খারাপ করে সেতু পেরিয়ে ফিরছিলাম।

যাওয়ার পথে একটি বিষয় খেয়াল না করলেও এ বেলা তা নজর কাড়ল। পুরোনো সব গাছে নানা ধরনের রং শোভা পাচ্ছে। দেখে মুগ্ধতার ঘোর কাটতে চায় না যেন! তাকিয়ে তাকিয়ে, খানিক সময় পার করে, তারপর অনেক পাতায় ঠাসা একটি গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় ওপরে মৃদু খসখস শব্দ কানে এলো। মাথা তুলে তাকাতেই চোখ কপালে! চোখে চশমা পরা একজন বিজ্ঞ যেন একাকী বসে আছে গাছের ডালে—ডাসকি লিফ মাঙ্কি! অবশ্য বেচারার মুখে রাজ্যের মেঘ। জিজ্ঞেস করলে যদি রাগ করে চলে যায়, এই ভয়ে কথা না বাড়িয়ে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম তার। আমাকে দেখে আরও দুই পর্যটক মনোযোগ দিলেন ওই মুখভার করে রাখা, চশমা পরা বানরের দিকে। মনে মনে ভাবলাম, হয়তো সঙ্গীর সঙ্গে খুব একচোট হয়েছে আজ বেচারার!
এই বানরের সঙ্গে আরও অনেকটুকু সময় কাটানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সময় সংকট। দলের বাকি সদস্যরা নিশ্চয় আমাদের জন্য অপেক্ষারত। তবে যতটুকু দেখা হয়েছে, সেটিও-বা কম কি। সবুজের স্নিগ্ধতা আর পাহাড়চূড়ার প্রকৃতির যে অনিন্দ্যসুন্দর মাধুর্য অবলোকন করা হলো, তা নিশ্চিতভাবে মনের গহিনে এক অবিস্মরণীয় ছাপচিত্র হয়ে রয়ে যাবে।
পেনাং হিল ভ্রমণের টুকিটাকি
মালয়েশিয়ার পর্যটন ভিসা করিয়ে দেয় বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি। ৫-৬ হাজার টাকা জনপ্রতি। পরিবার নিয়ে গেলে ভিসা পাওয়া সহজ। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার কয়েকটি এয়ারলাইনস বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ফ্লাইট পরিচালনা করে। আমাদের আসা-যাওয়ার টিকিট পড়েছিল জনপ্রতি ৩১ হাজার টাকা। কুয়ালালামপুর থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যেতে পারেন পেনাংয়ে। এ ছাড়া পাবেন বাসও।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top