skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I মনের যত্নে

খাদ্যের সঙ্গে শুধু শরীরের নয়, মনেরও ব্যাধি এবং তা উপশমের রয়েছে যোগ। বিশেষজ্ঞ মত এমনটাই বলে। লিখেছেন নিশাত শারমিন নিশি

‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’—জানা কথা। তবে অনেকে স্বাস্থ্য বলতে শুধু শারীরিক সুস্থতাকে ইঙ্গিত করেন। খেয়াল রাখা চাই, স্বাস্থ্য মূলত দুই রকম। একটি শারীরিক, অপরটি মানসিক। শরীর ভালো থাকলেও মন বিগড়ে গেলে কোনো কিছু ভালো লাগে না। জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
সুস্থ থাকতে ডায়েটের গুরুত্ব অপরিসীম। মনকে সুস্থ রাখতে খাদ্যতালিকায় রাখা চাই স্ট্রেস রিলিফ উপাদান।
 কলা: প্রতিনিয়ত স্ট্রেস ফিল করেন যারা, কলা তাদের এনে দিতে পারে উপশম। এই ফল রাখতে পারেন প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায়। ছোট একটি কলায় থাকে প্রচুর মিনারেল; যেমন ম্যাগনেশিয়াম, যা স্ট্রেস রিলিফে দারুণ উপকারী।
 বাদাম: অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রেহাই পেতে হলে খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে বাদাম। বিশেষত মিক্সড নাটসের সঙ্গে কাজু ও আখরোট যেন অবশ্যই থাকে, এমন মিশ্রণ প্রতিদিন স্ন্যাকস হিসেবে হতে পারে এক দারুণ সুপার মিল। এতে থাকা ভিটামিন ই, ম্যাগনেশিয়াম ও ফাইবার শরীরকে নানা সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি মন রাখে প্রফুল্ল।
 ডার্ক চকলেট: চকলেট এমনিতেই লোভনীয়। তবে অন্যান্য চকলেটের বদলে ডার্ক চকলেট বেছে নেওয়া স্বাস্থ্যকর। মানসিক দুশ্চিন্তা কমাতে এটি সাহায্য করে। এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। দুশ্চিন্তার কারণে যাদের রক্তচাপ বরাবরই একটু বাড়তি, তাদের ক্ষেত্রে ডার্ক চকলেটে থাকা ম্যাগনেশিয়াম পালন করতে সক্ষম উপকারী ভূমিকা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতেও বেশ কাজের।
 টক দই: দুধে তৈরি খাবারে টাইরোসিন নামের একটি উপাদান থাকে। নিয়মিত টক দই গ্রহণে এটি সেরোটোনিন নামক হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। তাতে স্ট্রেস ও মানসিক অবসাদ কমতে শুরু করে।
দুশ্চিন্তা বা মানসিক অশান্তি আমাদের দৈনন্দিন সব কাজে প্রভাব ফেলে। তাই দুশ্চিন্তা দূর করা প্রয়োজন সবার আগে। কেননা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকলে নানা রোগ বাসা বাঁধতে পারে শরীরে; যেমন ওবেসিটি। আর তা ডেকে আনতে পারে ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, স্ট্রোকসহ শারীরিক অন্যান্য ব্যাধি। ডিপ্রেশনের কারণে অনেকে ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড ও বাইরের খাবারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। পরিণামে ওজন বাড়তে বাড়তে শারীরিক ভারসাম্য কমতে শুরু করে। এ থেকে মুক্তির জন্য খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে কিছু হ্যাপি হরমোন বুস্টার ফুড। কিছু কিছু খাবার আমাদের দেহে ডোপামিন নামক হরমোন বাড়াতে সাহায্য করে। এসব হরমোনের অভাবে মন ভারাক্রান্ত থাকে; ফলে স্বাভাবিক কাজগুলো নষ্ট হয়। তাই ডোপামিন হরমোন বাড়ানোর জন্য খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন—
 অ্যামাইনো অ্যাসিড: প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে মাছ বা মুরগির মাংসের কোনো আইটেম। এ ক্ষেত্রে নিতে পারেন স্টিম ফিশ, স্টিম চিকেন ডাম্পলিং, ফিশ স্যান্ডউইচ, চিকেন স্টেক ইত্যাদি। তা ছাড়া বায়োলজিক্যাল ভ্যালু বিবেচনায় প্রতিদিন অবশ্যই একটি ডিম রাখা চাই পাতে।
 গ্রিন লিফি ভেজিটেবলস: গাঢ় সবুজ শাকগুলোর মধ্যে পালংশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, থায়ামিন, আয়রন, ডায়েটারি ফাইবার, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম। খাদ্যতালিকায় সপ্তাহে অন্তত তিন দিন রাখতে পারেন এই শাক। পাশাপাশি পালংশাক ভাজি অথবা পনির দিয়ে রান্না করলেও খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর। এই শাক ডোপামিন হরমোন বাড়াতে সাহায্য করে, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি ও মন ভালো রাখার জন্য যথেষ্ট হেল্পফুল।
 রেড ফ্রুটস: লাল রঙের স্ট্রবেরিতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ও সেলেনিয়াম। এটি ডোপামিন হরমোন ব্যালেন্স করতে সাহায্য করে, যা অ্যাংজাইটি কন্ট্রোল করতে এবং ডিপ্রেশন কমাতে বেশ কার্যকর।
 কফি: ঘুম ঘুম ভাব কাটাতে ক্যাফেইনের গুরুত্ব কম নয়। মন চাঙা রাখতে যে ডোপামিন সাহায্য করে, কফি গ্রহণে তা বুস্ট হয়। তাই এক কাপ কফি নিতে পারেন সন্ধ্যায়। অবশ্য যাদের রাতে ঘুমের ডিসটার্বেন্স থাকে, তারা এই পানীয় গ্রহণ করতে পারেন মিড মর্নিং স্ন্যাকস হিসেবে।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দেশে এখনো খুব বেশি আলোচনা হয় না। এমনকি মনের অবস্থা কাউকে সহজে বোঝানোও মুশকিল। কারও মন খারাপকে সাধারণত খুব একটা বড় করে দেখা হয় না এখানে। শারীরিক অবস্থা চোখে দেখা যায় বলে তা নিয়ে কমবেশি সবারই ভাবনা থাকে বেশ। কিন্তু মনে রাখা চাই, মানসিক অবস্থা ভালো না থাকলে ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটতে শুরু করে। তাই মনের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেসব চিন্তাভাবনা করি, সেগুলো মূলত কনশাস মাইন্ড ও সাবকনশাস মাইন্ডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। যেগুলো সরাসরি চিন্তা ও আলোচনা করতে পারি, সেই সব বিষয় কনশাস মাইন্ড থেকেই করে থাকি। যার সমাধান নিয়েও একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করা সম্ভব হয়। কিন্তু যেসব বিষয় নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করি, সেগুলো মানসিক স্ট্রেস বাড়ানোর যথেষ্ট কারণ। আর এই চুপিসারে বসে থাকা দুশ্চিন্তাই আমাদের ধীরে ধীরে করে তুলতে পারে অসুস্থ। সুস্থ মনের জন্য ফলো করতে পারেন কিছু টিপস:
 প্রতিদিন নিয়ম করে সকালে বা সন্ধ্যায় নিজের পছন্দের আঙিনা, বারান্দা অথবা ছাদে নিজস্ব একটু সময় ব্যয় করুন। দেখা যায়, সারা দিনে আমরা অন্যকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকলেও নিজেকে পর্যাপ্ত সময় দিই না। ফলে নিজের প্রতি বেখেয়ালি হয়ে সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে এবং সমাধানের খোঁজ মেলে না। তাই প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশ মিনিট নিজের জন্য রাখুন এবং ভালো লাগা মুহূর্তগুলো নিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন।
 শখের একটি জায়গা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করুন। কারও পছন্দ বৃক্ষরোপণ, কারও ঘর গোছানো, কেউবা বইয়ের ভাঁজে ফুলের পাপড়ি রাখায় আনন্দ খোঁজেন। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুন এবং নিজের উপভোগের জায়গা খুঁজে বের করে প্রতিদিন খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও সেই কাজগুলো করুন।
 বাড়িতে যারা অতিরিক্ত দায়িত্বশীল, তারা অনেক সময় নিজের কেয়ার করতে ভুলে যান। এমনটা হলে চলবে না! নিজের যত্ন নিন। প্রতিদিন নিয়ম করে গোসল করুন। বাথরুমে পছন্দের বডিওয়াশ, শ্যাম্পু রাখতে পারেন। এমনকি বিভিন্ন ফ্লেভারের পারফিউম ব্যবহার করতে পারেন। এতে মন ভালো থাকবে।
 নিয়ম করে মিউজিক বা গান শুনুন। মন হালকা রাখতে সংগীত-সান্নিধ্য বেশ উপকারী।
খেয়াল রাখা চাই, যদি অকারণেই মন খারাপ হতে থাকে, সেটি যেকোনো রোগের লক্ষণ বা কারণ নির্দেশ করতে পারে। যেমন থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার কারণে অনেক সময় ডিপ্রেশন বা অকারণ দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজের সময় বিভিন্ন ধরনের হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মুড সুইং হতে দেখা যায়। তাই মানসিকভাবে কোনো রকম সমস্যা হঠাৎ দেখা দিলে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করার পাশাপাশি একজন কাউন্সিলরের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। শারীরিকভাবে কোনো অসুস্থতা না থাকলে বা রক্তের রিপোর্ট স্বাভাবিক এলে অবশ্যই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার জন্য সঠিক চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় পরবর্তীকালে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ফলে মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়ে যায়।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top