skip to Main Content

ফিচার I সন্দেশ শোভিত

পোশাকের ক্যানভাসে এর সুনিপুণ উপস্থাপন যেন খুলে দিয়েছে নকশার নতুন সব সম্ভাবনার দুয়ার। ছাঁচের শিল্পমূল্যের গবেষণালব্ধ কাজ সেই পথকে আলোকিত করছে আরও। সারাহ্ দীনার লেখায় বিস্তারিত

মিষ্টান্নের জগতে সন্দেশ বিখ্যাত হওয়ার পেছনে স্বাদ ও নকশা- দুয়েরই ভূমিকা রয়েছে। এই মিষ্টি খাবার তৈরির মূল উপকরণ ক্ষীর। নকশার জন্য ব্যবহার করা হয় ছাঁচ। সন্দেশের নান্দনিকতা প্রকাশিত হয় অলংকরণে। যা জানান দেয় বাংলার জনপদের গল্প। সন্দেশের ছাঁচ এক প্রকার লোকশিল্প। লৌকিক জীবনের বিভিন্ন দিক ছাঁচগুলোর নকশায় প্রকাশিত।
এঁটেল মাটি, কাঠ, নরম পাথর ছাঁচ তৈরির উপাদান। মূলত সনাতন ধর্মের অনুসারী পরিবারেই বেশি তৈরি হতো এগুলো। নানান বিচিত্র নকশায়। শিল্পী হিসেবে সৃজনশীলতা প্রকাশ করতেন বাড়ির মেয়েরা। বিশেষ করে বয়স্কদের অলস দুপুর কাটত সন্দেশ তৈরির নতুন নতুন ছাঁচ অলংকরণ করে।
গোল, চারকোনা, চন্দ্রাকৃতি, পানপাতাসহ জ্যামিতিক নানা আকার দেখা গেছে গঠনে। এর ওপরে ফুল, ফল, পাতা, পাখি, মাছ, প্রজাপতির মোটিফ আঁকা হতো। এর বাইরে আমবাগান, পুকুরপাড়ে তালগাছ, গোয়াল ভরা গরু, ঢেঁকিতে পা দেওয়ার ছন্দ, আলপনাও দৃশ্যমান হয়েছে সন্দেশ অলংকরণে।
অতীতের মতো সন্দেশের ছাঁচ তৈরির পারিবারিক চর্চা তেমন আর প্রচলিত নেই; তবে এর উপস্থিতি আজও চোখে পড়ে। দেশীয় ফ্যাশন সেক্টর বিশেষ দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে সন্দেশের মোটিফ নিয়ে কাজ করছে অনেক সময় ধরে। প্রায় এক দশক দীর্ঘ এই টাইমলাইন। শারদীয় কালেকশন তৈরিতে সন্দেশের অলংকরণের উৎসাহ বেশি দেখা যায়। পয়লা বৈশাখেও কিছু মোটিফ ব্যবহৃত হয়। পূজা আর অতিথি আপ্যায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক থাকার কারণে সন্দেশের মোটিফ পোশাকে উৎসবের উচ্ছলতার প্রকাশ ঘটাতে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের লোকাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে সন্দেশের ছাঁচ নিয়ে কাজ প্রথম চোখে পড়ে ২০১৫ সালে। ফ্যাশন ডিজাইনার কাউন্সিল অব বাংলাদেশ আয়োজিত খাদি উৎসবের মঞ্চে। দুদিনব্যাপী সেই উৎসবে বাংলাদেশের ১৮ জন এবং ভারতের ৬ জন ডিজাইনার অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশি ডিজাইনাররা নানা ধরনের লোকজ মোটিফের পাশাপাশি সন্দেশের নকশা নিয়েও কাজ প্রদর্শন করেছিলেন সেখানে।
সন্দেশের ছাঁচ ও পোশাকে এর মোটিফ ব্যবহার নিয়ে বিশদ প্রকাশনা রয়েছে লোকশিল্প গবেষক চন্দ্র শেখর সাহার। ‘সন্দেশ: অর্নামেন্টেড টেরাকোটা অ্যান্ড স্টোন, মোল্ডস অব বাংলাদেশ- ট্র্যাডিশনাল মোটিফস থাউজেন্ড পসিবিলিটিস’ শিরোনামে। বইটিতে সন্দেশের ছাঁচের রৈখিক নকশা রচনা করেছেন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে এ নিয়ে গবেষণা শুরু। পরবর্তীকালে নিমফিয়া পাবলিকেশন ২০১৭ সালে বই আকারে তা বাজারে আনে।
এই কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, ‘আমার মা বাড়িতে বিভিন্ন রকমের সন্দেশ তৈরি করতেন। মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো ক্ষীর। তারপরে ছাঁচে বসিয়ে সম্পন্ন করতেন নকশা। মিষ্টান্নে অলংকরণ মুগ্ধ করেছিল আমাকে। সেখান থেকেই এই আনকোরা শিল্প নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাই। কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারি, জীবনযাপনের সঙ্গে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে আছে ঘরে বানানো এই মিষ্টি। অবসরে তৈরি হওয়া ছাঁচে তাই মনের খেয়ালখুশির স্পষ্ট প্রকাশ। নকশাগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে মাছ ও পাতার আকার। এই অঞ্চলের মানুষের রসনাবিলাসের পাশাপাশি জীবনযাপনের সঙ্গে মিশে আছে মাছ। অতিথি আপ্যায়ন, বিবাহ প্রথাতেও আছে এর উপস্থিতি। লোকশিল্প সন্দেশের ছাঁচেও তার প্রভাব দেখা যায়।’
গবেষক চন্দ্র শেখর সাহা মোট ১৫টি সন্দেশের ছাঁচের রূপান্তর পদ্ধতি প্রকাশ করেছেন। সন্দেশ মোটিফের নকশার বিশ্লেষণ ও নতুন মাত্রা সংযোজন প্রক্রিয়া তুলে ধরেছেন। অলংকরণের মৌলিক মোটিফের চারিত্রিক বিশেষত্ব অক্ষুণœ রেখেছেন তিনি। সেখানে কোনো রূপ পরিবর্তন করেননি। কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন গাণিতিক নিয়মের প্রায়োগিক ধারাবাহিকতা, যা সন্দেশ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ডিজাইনারদের সাহায্য করবে। চন্দ্র শেখর সাহার সন্দেশবিষয়ক বই প্রকাশের সময়, গবেষণালব্ধ ছাঁচের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লোকাল মাল্টি ব্র্যান্ড দেশী দশের সব কয়টি ব্র্যান্ড সন্দেশ মোটিফ নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে; যা কিউরেশনের দায়িত্বে ছিলেন গবেষক নিজেই।
ফ্যাশন লেবেল রঙ বাংলাদেশ পরবর্তী সময়েও সন্দেশের নকশার সিরিজ নিয়ে কাজ করেছে। এ তথ্য জানিয়েছেন ব্র্যান্ডটির স্বত্বাধিকারী সৌমিক সাহা। নানান রকম সন্দেশের উপমা ব্যবহারে পোশাক সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি।
ফ্যাশন আইটেমে সন্দেশের নকশার উৎসাহ ও ব্যবহার সম্পর্কে অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট চারু ও কারুশিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদের বক্তব্য পাওয়া যায় চন্দ্র শেখর সাহার ‘সন্দেশ’ নামক বইতে। তার বয়ানে সেখানে লেখা হয়েছে, ‘সন্দেশের মোটিফ তৈরি হয়েছিল কুটুম্বিতা পাতানোর সুখে, আত্মিক তাগিদে।’ এ বক্তব্য থেকে বলা যায়, আতিথেয়তাকে গুরুত্ব দিয়ে নকশায় নান্দনিকতার কাব্যিক প্রকাশ সন্দেশ। বিয়ে, অর্থাৎ একটি পরিবারের সঙ্গে অন্য পরিবারের সম্পর্কের সূচনায়, পরিবারে নতুন শিশুর জন্ম, অতিথি আপ্যায়নসহ নানা পার্বণে যুক্ত ছিল সন্দেশ। বলা যায়, সন্দেশ সুখবর এবং আনন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই মোটিফেও প্রকাশ ঘটেছে এসব সুখস্মৃতির।
দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের পোশাকে সন্দেশের মতো দেশজ মোটিফ ব্যবহারের ইতিবাচক বিষয়টি এর সৃজনশীল প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা যায়। এতে গ্রামীণ কারুশিল্পীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং প্রাপ্য মূল্যায়নও নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

ছবি: সৌমিক সাহার সৌজন্যে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top