skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I কোলসাই লেকের রত্নখনি

লেক, হ্রদ, সরসী—যে নামেই ডাকি, এ যেন অপার বিস্ময়ের ভান্ডার! নিরন্তর রং বদলের খেলায় মাতোয়ারা! নবদম্পতিদের মধুচন্দ্রিমার জন্য হতে পারে এক দারুণ বিকল্প। কাজাখস্তান থেকে লিখেছেন ফাতিমা জাহান

একটি শান্ত জলাধার। দুপাশে সবুজ গাছের সারি। দূরে পাহাড় নিচু হয়ে জলে মিশে যাচ্ছে। জলাধারের রং নীল। এর মাঝে বিস্ময়ে জলের দিকে মুখ করে জলের স্বচ্ছতা অবলোকন করছি। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি জল। এ রকম দৃশ্য স্বপ্নে দেখেছি আগে। স্বপ্ন সত্যি করার ঝোঁক চেপে গেল কাজাখস্তানে বেড়াতে এসে। এ দেশের সম্ভাব্য যত জায়গায় যাওয়া যায়, তোড়জোড় শুরু করলাম।
প্রথমে এসেছিলাম আলমাতি শহরে। সেখান থেকে যাব কোলসাই লেকে। কোভিড-পরবর্তী বিধিনিষেধের কারণে অনেক ভ্রমণার্থীকে এখন একা ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না এখানে। আর এত বড় কাজাখস্তানের জনসংখ্যা আমাদের ঢাকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। কোনো ঝুঁকিপ্রবণ জায়গায় দুর্ঘটনায় পড়লে উদ্ধারের জন্য কাউকে পাওয়া বিরল। সে জন্যই একা ভ্রমণের ওপর এমন বিধিনিষেধ।
আমাকে অবশ্য উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন আমার গেস্টহাউসের মালিক আইবেক এবং গেস্টহাউসটির দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা রন। আইবেক আর তার স্ত্রী রাহাতের একটি ট্রাভেল এজেন্সি আছে। আইবেক কখনো কখনো নিজে গাড়ি চালিয়ে ভ্রমণার্থীদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান। রন সামলান ট্রাভেল গাইডের দায়িত্ব। রনের বাড়ি জার্মানিতে। আইবেক স্থানীয়। এক সপ্তাহ ধরে সঙ্গী হিসেবে কোনো ভ্রমণার্থী পাওয়া যাচ্ছে না বলে একাই চললাম স্বপ্ন পূরণ করতে! এমনিতেও সাধারণত একা ভ্রমণ করি; কিন্তু এ যাত্রায় বিধিনিষেধ আর কাজাখস্তানের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট যানবাহন না থাকায় গাড়ি ও গাইড—দুই-ই নিতে হলো।
আলমাতি থেকে কোলসাই লেকের দূরত্ব প্রায় তিন শ কিলোমিটার। সকালে রওনা দিয়েছি। কোলসাই লেক বা ন্যাশনাল পার্কে পৌঁছতে পৌঁছতে আকাশ আঁধার করে এল। টিকিট কেটে এই পার্কে প্রবেশ করতে হয়। লেকের গেটে পৌঁছতে পৌঁছতে ঝম ঝম বৃষ্টি হলো শুরু। আমরা টিকিট কেটে বনভূমির মাঝখানের পিচঢালা পথ দিয়ে লেকের কাছাকাছি চলে এলাম। কিন্তু ঘনঘোর থামার নাম নেই। বৃষ্টির মধ্যেই লেকে যেতে আমার অবশ্য কিছুমাত্র আপত্তি নেই!
অদ্ভুত এক দেশ এই কাজাখস্তান। একটু আগেই রুক্ষ-শুষ্ক পাহাড়ি মরুভূমি দেখে এলাম; এখন চারদিকে উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড় আর বন, বরষা নেমেছে এই ভূমিতে। বিপরীত এক জগৎ।
গাড়ি থেকে নেমে আমরা চা খেলাম। অনেক বছর আগে এক বন্ধু বলেছিল, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা খাওয়ার আনন্দই আলাদা। সে বোধ হয় বাংলাদেশের বৃষ্টির কথাই বলেছিল। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও বৃষ্টিতে ভিজে আমার এত আনন্দবোধ হয় না। আর এখন কোলসাই লেকের এখানে ঠান্ডা পড়ে গেছে। জ্যাকেট গায়ে দিতে হলো। বৃষ্টি পড়লেও আশপাশের সবুজ পাহাড়, পাইন বন দেখতে তো কেউ মানা করেনি! সমস্ত জগৎ এখন পাইনের গন্ধে বিমোহিত। পাইন বনের ভেতরে একটি রহস্যের জগৎ লুকিয়ে রয়েছে, সে কথা নিশ্চয় আলাদা করে বলার দরকার নেই! সে রহস্য ভেদ করার জন্য আরও অনেক পাইন বন পার হতে হবে আমাকে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সারি সারি পাহাড়ের মুখোমুখি হলো হাসিখুশি হুল্লোড়ে রোদ। রন হইহই করে উঠলেন, ‘চলো, আমরা নেমে পড়ি লেকের দিকে।’ আইবেকও আসবেন আমাদের সঙ্গে। আমরা যে রেস্তোরাঁয় চা খাচ্ছিলাম, তার আশপাশ থেকে আরও পাহাড়, হ্রদ ও রোদের মতো আহ্লাদি একঝাঁক মানুষ বেরিয়ে পড়ল লেকের দিকে। এক জঙ্গলের ভেতর দিয়ে লেকের একদম কাছে চলে যাওয়া যায়। রেস্তোরাঁর কাছে গাড়ি রেখে, হেঁটে রওনা দিলাম। পাহাড়ের বাঁক দিয়ে লেকের এক টুকরো ধরা পড়ল চোখে। রন বললেন, ‘চলো, ওখানে গিয়ে দেখি।’ বললাম, ‘সরসী যদি দেখতেই হয়, তবে কাছ থেকে দেখব। দূর থেকে দেখে মন ভরবে না।’
জঙ্গলের মাঝে পাকা রাস্তা করা, হাঁটার সুবিধার জন্য। দুপাশে ঘন বন। অল্প কিছু কটেজ আর ইয়ট চোখে পড়ল। অনেকেই বনানীর মাঝে রাত কাটাতে চান। রন বললেন, ‘এসব কটেজ আর ইয়টের ভাড়া অনেক। আমি এখানে ট্রেকিং করেছি লেকের শেষ মাথা অবধি; তাঁবু খাটিয়ে থেকেছি তিন দিন।’ রনের জীবন আমার ভীষণ মনে ধরল। এ রকম বন্ধনহীন জীবন আমাদের উপমহাদেশে সচরাচর দেখা যায় না।
আইবেক বললেন, ‘এই লেকের পাড় ধরে হাঁটতে থাকলে দশ কিলোমিটার পর কিরগিজস্তান সীমান্ত। আগে অভিযাত্রীরা কোলসাই লেক ট্রেক করে কিরগিজস্তানে চলে যেত। এখন অবশ্য ওই সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন অন্য সীমান্ত দিয়ে যেতে হয় ওই দেশে।’ কিরগিজস্তান এত কাছে জেনে আমার লোভ লাগছে এই যাত্রায় সে দেশে একবার ঢুঁ মেরে আসার!
জঙ্গলের মাঝে কিছু জায়গায় ছোট ছোট বোর্ডে লেখা রয়েছে—চলতি পথে কোন কোন বন্য প্রাণীর দেখা পাওয়া যেতে পারে। ভালুক, নেকড়ে, স্নো লেপার্ড, লিঙ্কস, ছাগল, খরগোশ… আরও কত প্রাণী যে আছে এখানে! তবে মানুষ যে পথে চলাচল করে, সেখানে ওদের দেখা পাওয়া ভার।
আমি অবশ্য মনে মনে অন্য কিছুর জন্য আকুল হয়ে বিভোর আছি; তা হলো পাইন বনের সুগন্ধ। আমরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেকটুকু নিচে নেমে গেছি। এখান থেকে সবুজ সরসী একটু একটু ধোঁয়াশার মতো দেখা যাচ্ছে। সরসীর দুপাশে পাহাড়ে পাহাড়ে রোদের চমক আর হ্রদের টলটল জল তখন আর জল হয়ে থাকতে চাইছে না; হয়ে উঠেছে যেন একখণ্ড পান্না। ভাবছি, এই জলের কাছে গেলে নিশ্চয় মুঠো মুঠো পান্না নিয়ে ফিরে আসা যাবে!
এ জগতে বিস্ময়কর অনেক কিছুই আছে; তবে আমি আগে কোলসাই লেকের চেয়ে বেশি বিস্ময়কর কোনো লেক দেখিনি। আগে মনে হয়েছিল, পাইন বনে রহস্য আছে। জলের এ রকম রহস্যের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কোলসাইয়ের যত কাছে পাহাড় বেয়ে বেয়ে নেমে যাচ্ছি, ততই এর অঙ্গ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে অসংখ্য রং। কোথাও দাঁড়ালে সবুজ, কোথাও পান্না-সবুজ, কোথাও ময়ূরকণ্ঠী সবুজ, কোথাও কচি পাতার মতো সবুজ। পাহাড় আর পাইনগাছগুলোও সরসীর খুব বাধ্য যেন; কাছাকাছি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পা ডুবিয়ে রেখেছে! যেন এই মুহূর্তে পা ডুবিয়ে থাকা ছাড়া ওদের আর কিছু করার নেই! এই রঙিন জলাশয়ের মন রাঙানোই যেন এখন আকাশ, পাহাড় আর বনের একমাত্র কাজ!
হ্রদের গা ঘেঁষে হলুদ, বেগুনি, লাল ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। বরষার ছোঁয়া পেয়ে একেবারে নুয়ে ছুঁয়ে দিতে চাইছে সরসীকে। ওদেরও কি ইচ্ছে জাগে না জলাশয়ে নিজের চেহারা দেখতে! আমি এক মুঠো ফুল তুলে নিলাম হাতে। এতই শখ যখন, তখন ওদের ইচ্ছে পূরণ করা আমারও তো দায়িত্ব, তাই না! আমি সরসীর খুব কাছে এখন। এখানে পাহাড়, পাইনগাছ হ্রদের দুপাশ থেকে চলতে চলতে দূরে, মাঝ বরাবর সমান্তরালে এসে, নিচু হয়ে এক কেন্দ্রে মিলে গেছে। যেন মিলে যাওয়ার জন্যই এতটা পথচলা।
কাছে গিয়ে ফুলগুলোকে জলের কাছে সমর্পণ করলাম। দেখুক ফুল নিজেকে এবার! দেখুক সরসী, ফুল ভাসলে কী তরঙ্গ জাগে! ছোট ছোট স্বচ্ছ ঢেউ এসে ফুলগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। খানিকটা মেঘও এসে আঁজলা ভরে জল নিতে চাইল আকাশের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যাবে বলে, সরসীর রং আকাশ গায়ে মাখতে চায় বলে! কিন্তু এভাবে তো জল নেওয়া বা দেওয়া যায় না। তখন ঝরিয়ে দিল আরেকটু বৃষ্টি। এই ছলে লোকচক্ষুর আড়ালে জল দেওয়া-নেওয়ায় বাধা রইল না।
আমি, রন আর আইবেক চললাম ট্রেক করে আরেকটু উঁচু থেকে এই পান্না-সবুজ জল দেখার জন্য। পথটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে গড়া, কোথাও মেঠো পথ; এখন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। এ জন্যই রন আমাকে একা আসতে বারণ করেছিলেন, পা পিছলে গেলে আর রক্ষা নেই।
হ্রদের হাত ধরে ধরে আমি দেখি ওর রং বদলে যাওয়া। পাহাড়ের ছায়া পড়লে হয় নীলকান্তমণি, একটু ঘুরে দাঁড়ালে পান্না, একটু মেঘ করলে নীলা, আর রোদের আদরে হয়ে ওঠে রূপকথার রুপো। সরসীর কাছের গাছগুলো এখন খেলছে বাতাসের সঙ্গে। পায়ে তার নকশা, শিকড়ের নকশা, মাটি ভেদ করে জানান দিচ্ছে। আর রং বদলাচ্ছে সরসী একই সঙ্গে।
জলের নিচের জগৎ এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। কাছের স্বচ্ছ জলে দেখা যাচ্ছে মাছের সাঁতার, ছোট গুল্মের নাচ। আমার সময় যেমন থেমে গেছে এখানে; তেমনি এই জলাশয়, এই পাইন বন, এই আকাশ আর জলের পরিবর্তিত রং সব থমকে আছে সময়ের কাছে। যতই এগিয়ে যাই, সরসীর হাত ধরে ততই এক ইন্দ্রজাল আমাকে ঘিরে ধরে, হাত ধরে নিয়ে যায় অন্য এক ইন্দ্রজালের কাছে। পাইন বন আরও ঘন হয়ে ভাসে বাতাসে, আর এর মাঝ দিয়ে দেখা যায়—জলের রং আমার কাছে ধরা দিতে দিতে নীলকান্তমণি রঙের একটি হৃদয় তুলে ধরেছে; জল তার ছবি ধরেছে পাইন পাতার ফ্রেমে; সরসীর হৃদয়ের রঙে ধরা পড়েছে সব রাগ-অনুরাগ!
আরও চড়াই, আরও উতরাই, আরও অনেক অনেক কথা শোনা এবং না শোনায় আমি সরসীর আরও রূপ দেখতে থাকি। এখন বেশ উঁচু থেকে জল দেখা যায়। তার অন্য রং, পাহাড়ের ছায়ায় পান্না, আকাশের ছায়ায় নীল, পাশাপাশি পাখিদের মতো হাওয়ায় আর জলের জীবনের মতো আনন্দে মাতামাতি।
পাহাড়ি আকাশের মন বোঝা দায়। একটু আগে স্বর্ণালি সন্ধ্যা দেখাবে বলে ডেকে আনল, আর এখন সুরমাই থমথমে ভাব। হুট করে চঞ্চল থেকে মন ভার। চোখে কাজল এখন তার। তা দেখে আমাদের সরসীও চট করে রং বদলে ফেলেছে। এখন সে গাঢ় হচ্ছে, আকাশের মতো। আমরা চলে গেলে ঠিক মিশে যাবে আকাশের বুকে।
ফেরার পথে মেঘ আমাদের তাড়িয়ে মারল! মাঝে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায়, আবার বরষা ঝরায়। তবে আর যা-ই করুক না কেন, কোলসাই লেকের সবুজ রং আমার চোখের সামনে থেকে দূরে সরে না। কোলসাইকে প্রদক্ষিণ করে, কাছ থেকে অনেকবার দেখেও মন ভরে না। মনে মনে ঠিক করলাম, পরেরবার আমি কোলসাইয়ের কাছে বসে সারা দিন, সারা রাত গল্প শুনব। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরব। তাঁবু খাটিয়ে স্বচ্ছ জলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের সঙ্গে পাতা আর তারা গুনব। এত সব করার জন্য কোলসাইয়ের কাছে আবারও ফিরতে হবেই আমাকে!

ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top