skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I অনিঃশেষ অনিশ্চয়তা

হলিউড। আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের তারা-ঝলমলে এক তল্লাট। চলচ্চিত্র দুনিয়ার সবচেয়ে দাপুটে স্টুডিওগুলোর ঠিকানা। তাই সারা দুনিয়ার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রস্থল। হলিউড মানে এককথায় মহাতারকাদের পদচারণ ও কর্মব্যস্ততায় সব সময় ঝাঁ-চকচকে পরিবেশ। তবু প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো, এখানেও রয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের বিবিধ বিষাদগাথা। হলিউডের রাস্তায় শুধু অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, টম ক্রুজ, মেরিল স্ট্রিপ, নিকোল কিডম্যান, ক্রিস্টেন স্টুয়ার্টদেরই দেখা মেলে, তা নয়। সাক্ষাৎ মেলে গৃহহীন মানুষদেরও। এমনই এক গৃহহীন তরুণীকে চার বছরের বেশি সময় ধরে ক্যামেরা নিয়ে নিরন্তর অনুসরণ করেছেন ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’ পত্রিকার স্টাফ ফটোজার্নালিস্ট ক্রিস্টিনা হাউস। উদ্দেশ্য, ম্যাককেঞ্জি ট্র্যাহান নামের ওই তরুণীর জীবনচিত্রের ভেতর দিয়ে হলিউড লাইফস্টাইলের ভিন্নতর চিত্র নথিবদ্ধ করা। তাতে সফল তিনি। ম্যাককেঞ্জির একটি বিশেষ মুহূর্তের ছবি ক্রিস্টিনাকে চলতি বছর এনে দিয়েছে ‘ফিচার ফটোগ্রাফি’ বিভাগে মর্যাদাপূর্ণ পুলিৎজার পুরস্কার।
ছবিতে দেখা যায়, হলিউডের রাস্তায় নিজের তাঁবুর খুব কাছেই, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন ম্যাককেঞ্জি। গর্ভবতী তিনি। অভিব্যক্তিতে একই সঙ্গে ফুটে উঠেছে অন্তঃসত্ত্বাকালীন যন্ত্রণাকাতরতা ও অনিশ্চয়তাবোধ। তার তলপেটে হাত রেখে আছেন প্রেমিক এডি। যুবকটি যেন এই আলতো পরশের মাধ্যমে একই সঙ্গে নিজের প্রেমিকা ও অনাগত সন্তান—উভয়কেই জোগাতে চাইছেন ভরসা। ‘প্রেগন্যান্ট, হোমলেস অ্যান্ড লিভিং ইন আ টেন্ট: মিট ম্যাককেঞ্জি’ শিরোনামে ১৩ জুলাই ২০২২, ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’-এ প্রকাশিত এক দীর্ঘ আর্টিকেলে প্রথম প্রকাশ পায় ছবিটি। তোলা হয়েছিল আগের বছর। বলা বাহুল্য, ম্যাককেঞ্জির ওপর ক্রিস্টিনার ওই দীর্ঘ পর্যবেক্ষণশীল উদ্যোগেরই ফল এটি। সেখানে ওই সিরিজের আরও বেশ কিছু ছবিও প্রকাশ পায়, যাতে ফুটে উঠেছে ম্যাককেঞ্জি তথা গৃহহীন মানুষদের যাপনচিত্র। সেগুলোর মধ্যে আলোচ্য ছবিটিই হয়ে ওঠে বেশি আলোচিত।
ওই আর্টিকেলে ম্যাককেঞ্জি জানান, ছবিটি তোলার সময় তিনি ছিলেন সাড়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার প্রেমিক এডি ছিলেন এইচআইভি পজিটিভ। অবশ্য ভাগ্য ভালো, এডির শরীরে ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় থাকায় শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সেটি ম্যাককেঞ্জির শরীরে ছড়িয়ে পড়েনি। জানালেন, গর্ভধারণ করেছেন—এ কথা নিশ্চিত হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিল তাদের। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবরে পড়ে গিয়েছিলেন ভীষণ দোটানায়। একই সঙ্গে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক গ্রাস করেছিল তাকে। গর্ভপাতের অ্যাপয়েন্টমেন্টও নিয়ে রেখেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করেননি।
জানা যায়, ম্যাককেঞ্জির পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা রাজ্যের কাজুন কান্ট্রি অঞ্চল থেকে চরম দারিদ্র্যের কারণে লস অ্যাঞ্জেলেসে এসেছিল। একই সঙ্গে তাদের তিন প্রজন্ম পারিবারিক সহিংসতা, মানসিক ব্যাধি ও গৃহহীনতার ভোগান্তি পোহিয়েছে। ম্যাককেঞ্জি নিজে পরিবার থেকে পালিয়ে আসেন ১১ বছর বয়সে। সে সময়েই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তারপর থেকে রাস্তাই তার ঘরবাড়ি। হলিউডে এসেছেন ১৩ বছর বয়সে। জীবনের চলতি পথে স্বভাবতই বিবিধ নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে তাকে। নিজেও জড়িয়েছেন মাদক গ্রহণ, মাদক বিক্রিসহ নানা অপরাধে।
এটিই অবশ্য ম্যাককেঞ্জির প্রথম গর্ভধারণ নয়। ১৬ বছর বয়সে যখন লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তায় তার প্রথম প্রেমিক শনের সঙ্গে জীবন কাটাতেন, একসময় খেয়াল করেন, তিনি সাড়ে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ২০১৩ সালের এপ্রিলে জন্ম দেন পুত্রসন্তানের। সেই পুত্রকে নিয়ে ম্যাককেঞ্জি ও শন তখন চলে গিয়েছিলেন ম্যাককেঞ্জির মা ক্যাটের কাছে; যিনি থাকতেন মিড-সিটির একটি কনভার্টেড গ্যারেজে। শনের সঙ্গে সম্পর্কে সহসাই ভাঙন ধরলে তিন মাস বয়সী শিশুটিকে নিয়ে যান স্থানীয় সমাজকর্মী। আদালতের রায় যায় ম্যাককেঞ্জির বিপক্ষে; সন্তানের দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র। এখন সে তার দাদির কাছে বড় হচ্ছে।
সন্তানের সঙ্গে এই বিচ্ছেদ ম্যাককেঞ্জিকে ভীষণ বেদনা দিলেও তিনি ছিলেন অসহায়। মাদকের সূত্র ধরেই নতুন জীবনসঙ্গী অ্যান্থনির সঙ্গে জড়িয়ে নেন নিজেকে। ১৮ বছর বয়সে আবারও হয়ে পড়েন অন্তঃসত্ত্বা। এ সময় সব বদভ্যাস ছেড়ে দিয়ে, সেন্ট অ্যান’স ফ্যামিলি সার্ভিসের একটি রেসিডেন্সিয়াল প্রোগ্রামে আশ্রয় নেন।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে পৃথিবীর মুখ দেখে ম্যাককেঞ্জির দ্বিতীয় পুত্র। কিন্তু মাদক ব্যবসা ও অপরাধকর্মের জন্য অ্যান্থনি গ্রেপ্তার হলে এই গৃহহীন তরুণী আবারও ভেঙে পড়েন। অবশ্য, পরবর্তীকালে তাকেও যেতে হয় কারাগারে। সন্তানকে যেন নিজের মতো গৃহহীন হতে না হয়, তাই এক বন্ধুর হাতে তুলে দেন সেবার। কিন্তু চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কর্তৃপক্ষ খবর পেয়ে শিশুটিকে নিজেদের আশ্রয়ে নিয়ে যায়। তারপর আদালত ওকে দিয়ে দেয় অ্যান্থনির জিম্মায়। একে একে দুই সন্তানের অধিকার হারিয়ে স্বভাবতই মুষড়ে পড়েছিলেন ম্যাককেঞ্জি। ভুগেছেন অনুতাপেও। একই সঙ্গে কিছুটা স্বস্তিও আছে তার। সন্তানেরা গৃহহীন নয়; পারিবারিক পরিমণ্ডলে বড় হচ্ছে, যদিও মাকে ছাড়া।
সব মিলিয়ে এবার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর ম্যাককেঞ্জির পৃথিবীটা আবারও কেঁপে ওঠে। জানালেন, এডির সঙ্গে তার পরিচয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সন্তানের সঠিক লালনপালন সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ডিপার্টমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ফ্যামিলি সার্ভিসের একটি আলোচনা সভায়। সেখানে এক সমাজকর্মীর বক্তব্য তার ভীষণ মনে ধরেছিল। ‘তিনি বলেছিলেন, গৃহহীন মানেই অবজ্ঞেয় নয়! জীবনে এই প্রথম কোনো সমাজকর্মীর কাছ থেকে এমন কথা শুনেছিলাম,’ বলেছেন ম্যাককেঞ্জি। তবু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে ভয় দেখাচ্ছিল। সন্তান প্রসব করবেন নাকি গর্ভপাত—পড়ে গিয়েছিলেন ভয়ানক সিদ্ধান্তহীনতায়। তত দিনে অভিমান ভেঙে ফিরে আসেন এডি। জোগান ভরসা। অবশেষে এই যুগলের কন্যাসন্তান দেখে পৃথিবীর আলো। তবে এবার ম্যাককেঞ্জি রাস্তায় রাস্তায় আর জীবন কাটাতে নারাজ। নিজের সন্তানকেও হারাতে চান না। হলিউডের মতো জমকালো শহরে তার স্বপ্ন তবু কুয়াশাচ্ছন্ন; ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
এই মর্মভেদী জীবনচিত্র দৃশ্যবন্দি করার কারিগর ক্রিস্টিনা হাউস বলেন, ‘ম্যাককেঞ্জির ছবি প্রতিদিন তুলতাম, আর নিজেও মুষড়ে পড়তাম বেদনায়। ওই পরিস্থিতিতে ওর মধ্যে যে অধ্যবসায় ও সাহস দেখেছি, তা অতুলনীয়। ওর ওই জীবনসংগ্রাম ও মর্মযাতনার মধ্যে আনন্দের মুহূর্তও ছিল প্রচুর।’ ম্যাককেঞ্জির মতো ওই সময়ে, ঘটনাচক্রে ক্রিস্টিনাও ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। তার দাবি, ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সংযোগ কেমন, এর ফলে তা আমার পক্ষে আরও গভীরভাবে বোঝা সহজ হয়েছিল।’ সেই বোঝাপড়ার ছাপ দারুণভাবেই প্রকাশ পেয়েছে এই আলোচ্য আলোকচিত্রে।

সূত্র: লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ও পেটা পিক্সেল
 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top