skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I সফেদ বালির স্বচ্ছ সাগরতটে

কেনিয়ার দিয়ানি। তর্ক সাপেক্ষে আফ্রিকার সবচেয়ে ঐশ্বর্যমণ্ডিত সমুদ্রসৈকত। পান্নাসবুজ, সবুজ, নীলকান্তমণি, নীলা…নানা রঙে স্তরবিন্যাসে সাজানো সমুদ্রের জল। তার ওপরে স্বচ্ছ গাঢ় নীল আকাশের খেলা। আবার জলের তলে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণোচ্ছলতা।
লিখেছেন ফাতিমা জাহান

সরু মেঠো পথ ধরে তরতর করে নেমে যাচ্ছি। পথের দুপাশে সারি সারি গাছ ঘন হয়ে আসছে। বেশির ভাগই কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া। মাঝে কয়েকটি নারকেলগাছও আছে। এ দেশের মতো এমন ঝাঁকড়া, পুষ্ট গাছ কোথাও দেখিনি। বাইরের প্রখর রোদ এই গাছগুলোর মাথা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে, কিছুতেই ভেদ করতে পারছে না। আমি যাচ্ছি দিয়ানি সৈকতে। কেনিয়ায় এসেছি বেশ কিছুদিন। পণ করেছি, দিয়ানি না দেখে এ দেশ ছাড়ব না। কেনিয়ার পুরোনো রাজধানী মোম্বাসা থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে এই সমুদ্রসৈকত। মোম্বাসা থেকে আসার পথে যত গ্রাম পড়েছে, সব কটির বর্ণনা দিলে বিশাল এক আখ্যান লেখা হয়ে যাবে। প্রকৃতি নিজ হাতে সাজাচ্ছে এখন কেনিয়াকে। বর্ষা শুরু হয়েছে। এমনিতে সারা বছর শুষ্ক-রুক্ষ থাকে প্রকৃতি। এখন এই জানুয়ারি মাসে সবুজে সবুজে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রকৃতির শোভা। গাছগুলোতে এত পাতা যে ডাল অবধি দেখা যায় না। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কনকচূড়া, কাঠগোলাপ, বাগানবিলাস গাছগুলোর পাতাও অবশ্য ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না ফুলের ভারে। একেবারে বসন্তকালের আবহাওয়া চারদিকে।
আম-কাঁঠালেরও মৌসুম এখন এ দেশে। ভাবা যায় জানুয়ারি মাসে পাকা আম, কাঁঠাল খেতে পাচ্ছি! গ্রামের বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে বড় বড় আম—সবুজ, হলুদ কিংবা সিঁদুরে রঙের। ট্যাক্সি আমাকে মূল সড়ক ছেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল সৈকতের একটি রিসোর্টে। আফ্রিকার মণিমাণিক্যের খোঁজে এসেছি আর দুটো দিন থাকব না, তা তো হয় না!
দিয়ানি সমুদ্রসৈকতকে বলা হয় আফ্রিকার সবচেয়ে ঐশ্বর্যমণ্ডিত সৈকত, মাথায় তার জমকালো মুকুট। এই সমৃদ্ধির মুকুট পরিয়েছেন আমার মতো বিমুগ্ধ ভ্রমণার্থীরাই! ভারত মহাসাগরের এক কোনায় জায়গা করে নিয়েছে দিয়ানি। নামটি আমার বেজায় পছন্দ। কোথায় যেন একটি সুর ঝনঝন করে বেজে উঠছে এ নামের সঙ্গে—আনি আনি দিয়ানি…। এখানে আরব সংস্কৃতির প্রভাব বেশ; ওমান সালতানাত বহু বছর শাসন করেছে দক্ষিণের মোম্বাসা ও এর আশপাশের অঞ্চল।
আমি ট্যাক্সি ভাড়া করে এসেছি মোম্বাসা থেকে। ট্যাক্সিচালকের নাম পিটার। ভীষণ নম্র, ভদ্র। অবশ্য কেনিয়ার জনসাধারণকে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি বা কোথাও কোনো অপরাধকর্মের খবরও কানে আসেনি। রাস্তাঘাট ঝকঝকে পরিষ্কার। রাস্তায় কোনো গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে না। যেন এক স্বপ্নপুরী। অনেকে আফ্রিকা সম্পর্কে না জেনে ভয়াবহ সব কথা বলে। আসলে সবই ভুল।
দিয়ানিতে আমি থাকব সমুদ্রসৈকতের কোলঘেঁষা এক রিসোর্টে। সমুদ্রের ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ শুনতে আমার ভালো লাগে। চব্বিশ ঘণ্টা এই আওয়াজ শোনার ব্যবস্থা করে এসেছি।
পিটারের ট্যাক্সি আমাকে সমুদ্রসৈকতেই নামিয়ে দিল। এখন দুপুর গড়াচ্ছে। এত দীর্ঘ সৈকতে কেউ নেই। সামনে বেলি ফুলের মতো সাদা ধবধবে বালির তট আর তার ওপর আছড়ে পড়ছে বিভিন্ন রং। সবুজ, পান্নাসবুজ, নীল, গাঢ় নীল—আরও কত রং যে একের পর এক ঢেউ খেলিয়ে যাচ্ছে।
রিসোর্টে ব্যাগ রেখে ছুটলাম সাগরের কাছে। দুপুরের কড়া রোদে সাগরের রং সবচেয়ে বেশি খোলে, মাতামাতি করে। এই রং হারিয়ে যাবে বিকেলে। রিসোর্টে আমার রুম থেকে সাগর দেখা যায়; কিন্তু আমাকে আরও কাছে যেতে হবে। এখন সৈকতে দু-একজন ট্যুরিস্ট ছাড়া আর কেউ নেই। মনের আনন্দে সমুদ্রের রং গায়ে মাখার এ মোক্ষম সময়। জলের রং কাছ থেকে দেখায় নীলকান্তমণি, আবার দূরে গেলে হয়ে যায় নীলা। এই সাগরের লীলা বোঝা দায়! তার চেয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করা, শীতল হওয়া শ্রেয়। জলের বুকে জায়গা করে নেওয়া ভালো।
কেনিয়ার অন্যান্য জায়গায় এখন রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে, দিনেও ঠান্ডা থাকে। কিন্তু মোম্বাসা আর দিয়ানির আবহাওয়া উষ্ণ; জলে ঝাঁপিয়ে বেড়ানোর মতো মনোরম।
সমুদ্রের কাছে যত দিন আছি, ঠিক করেছি প্রতিদিন মাছ খাব। অন্যান্য সমুদ্রসৈকতের মতো ভিড় না থাকায় সাগরপারে দোকানপাট প্রায় নেই বললেই চলে। এ এক অপরূপ নির্মল সমুদ্রসৈকত, যে শুধু তার রূপ দেখাবে বাড়তি উপদ্রব ছাড়া।
সাগরে স্নান সেরে চলে গেলাম গ্রামের দিকে। আমি তো ভেতো বাঙালি! গ্রামের কোনো এক রেস্তোরাঁয় বসে মাছ-ভাত খাব। পেয়েও গেলাম। এখানে স্থানীয়দের সঙ্গে কয়েকজন ইউরোপীয় এসেছেন খেতে। নারকেল দিয়ে মাছ রান্না করা হলো আমার জন্য। মনে পড়ল, নারকেল যোগে মাছের স্বাদ আমি আগে পেয়েছিলাম ইন্দোনেশিয়ায়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় মাছ খেলেও নারকেল দিয়ে, তা-ও আবার এ রকম তুলনাহীন স্বাদ কোথাও পাইনি। অল্প টমেটো, সামান্য লেবুর রস আর অনেকখানি নারকেল, একটু পেঁয়াজ, আদা, রসুন, শুকনো মরিচবাটা দিয়ে রান্না হয়েছে মাছের এই পদ। হালকা কমলা ঝোলে ঝিলিক দিচ্ছে মাছের টুকরো। এর সুগন্ধ, স্বাদ প্রতিবার নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, মাছ ছাড়া জীবনে আর কোনো খাবারই চাওয়া নেই আমার!
আহার শেষে এখানকার হস্তশিল্পের বাজারে ঘুরে বেড়ালাম। আফ্রিকা সমৃদ্ধ তার চিত্রকলা আর হস্তশিল্পের জন্য। যেহেতু সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ নষ্ট করে কেউ দোকান দেয়নি, তাই মূল সড়কের দুপাশে ছোট ছোট ছাপড়ায় দোকানিরা নিয়ে বসেছেন এ দেশের বিভিন্ন ধরনের কাঠে খোদাই করা মুখোশ, ডেকোরেশন পিস, বসার টুল, শুকনো পাতা বা লতায় তৈরি ঝুড়ি, হ্যান্ডব্যাগ আর বিভিন্ন আকারের অসংখ্য ক্যানভাসে আঁকা রঙিন চিত্র। শামুক-ঝিনুকে তৈরি জিনিসপত্র একেবারে নেই বললেই চলে। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন এ দেশের সরকার ও জনসাধারণ। তাই সামুদ্রিক কোনো প্রাণীকে অকারণে পণ্য করে তোলে না।
বিকেল হতে চলল। আমি এগোলাম সৈকতের দিকে। সাগরতট ধরে বহু বহু দূর অবধি হাঁটব। এখানে তটে দর্শনার্থীদের তেমন ভিড় নেই। একদম নির্জন, কোলাহলহীন সফেদ বালির স্বচ্ছ সাগর। নিরিবিলিতে থাকার জন্য জনমানবহীন এই সৈকতের তুলনা হয় না। দূরে, আরও দূরে সাগর একেক রং দিয়ে স্তর তৈরি করে রেখেছে। এক স্তরে পান্নাসবুজ, পরের ভাগে সবুজ, এরপর নীলকান্তমণি, তারপর নীলা। আর তার ওপর স্বচ্ছ গাঢ় নীল আকাশ। এখানে সাগরের জল নির্মল, আকাশ শুদ্ধ, বাতাসে নেই কোনো ছলচাতুরী।
বিকেলের দিকে উট নিয়ে আসেন উটের মালিক, যদি কোনো ট্যুরিস্ট ওই প্রাণীর পিঠে চড়তে আগ্রহী হন। অনেকে কাছের শহর থেকে এ তটে আসেন সূর্যাস্ত দেখতে। আর অল্প কিছু ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট আসেন নির্জনে কয়েকটি দিন কাটানোর জন্য, সমুদ্রে কিছু সময় জলকেলি খেলতে।
ধীরে ধীরে দিয়ানিতে সন্ধ্যা নামে। এতক্ষণ কোথাও যেন ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট সব ঘাপটি মেরে ছিলেন। বিকেল হতেই তাদের কয়েকজন নেমে পড়লেন সাগরে। অবশ্য সংখ্যায় খুবই কম। এ রকম এক নির্জন সমুদ্রসৈকতে সময় কাটাতে পারব, আমি ভাবতেও পারিনি!
সন্ধ্যায় লালিমা ছড়াতে ছড়াতে সূর্যদেব অস্ত গেলে সাগরকে আরও আপন মনে হলো। তার ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ সুর আরও কাছে এসে পড়ছে। এই সুর, এই ছন্দ এক ঘোর জাগায়; নিয়ে যায় অন্য জগতে। রাত বাড়তে থাকলে, পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলে সমুদ্র যেন পায়ে পায়ে আরও কাছে চলে আসে; সুরের মূর্ছনায় রাতের শেষ প্রহর অবধি মেহফিল সাজায়। সাগর আমার এত কাছে যে মাঝরাতেও তার সান্নিধ্য মেলে।
পরদিন আমার সাগরের অতলে ঐশ্বর্য খুঁজে বেড়ানোর দিন। স্নরকেলিংয়ের সরঞ্জাম রিসোর্টেই রয়েছে। যেকোনো সমুদ্রে স্নরকেলিং করতে হয় অগভীর জলে নেমে। একা একাই সম্ভব। গভীর জলে নামার জন্য রয়েছে অন্য ব্যবস্থা, যার নাম স্কুবা ডাইভিং। সে ক্ষেত্রে সঙ্গে গাইড এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে নামা চাই।
স্নরকেলিংয়ের গিয়ার পরে সমুদ্রতলের জগৎ দেখতে নেমে পড়লাম আমি। প্রথমে দেখা মিলল একটি ছোট আকারের কচ্ছপের। জলের নিচে সাঁতার কাটতে থাকা কচ্ছপ এই প্রথম দেখলাম। জলজ উদ্ভিদও আছে জলের তলে, সবুজ পাখনা মেলে এই বুঝি দুলে দুলে উড়ে যাবে! এ তটে প্রচুর কচ্ছপের দেখা পেলাম। আরেক ডুবে দেখি নীল কালো ডোরাকাটা অ্যাঞ্জেল ফিশ ঘুরছে পাশ দিয়ে। আবারও দিলাম ডুব। এবার দেখি কমলা, সাদা, কালো দাগ কাটা ক্লাউন ফিশ জীবন্ত প্রবালের মাঝ দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। বেশি দূরে যাবার অনুমতি নেই; কারণ, দূরে একা যাওয়া বিপজ্জনক। তাই ডুবে ডুবে জল খাওয়ার মতো তটের কাছাকাছি থেকে ডুবে ডুবে কাছের ছোট ছোট রুপালি মাছ দেখে নিলাম প্রাণভরে। এই করতে করতে, রঙিন সব মাছের খোঁজে গড়িয়ে গেল দুপুর। অথচ নীল-সবুজ সাগরের তল দেখার এখনো ঢের বাকি।
দুপুরের খাবারের মেনুতেও মাছ রাখলাম। তবে দূরে কোথাও না গিয়ে রিসোর্টের রেস্তোরাঁয় আস্ত মাছ ভাজা খেয়ে নিলাম স্যালাদ যোগে। রাতে এরা সমুদ্রের তাজা মাছ ধরে এনে বারবিকিউ করবে। তার প্রস্তুতি চলছে। আমার রুমের বারান্দা থেকে সোজা সমুদ্রে চলে যাওয়া যায়। জলের তোড় বাড়লে কাছে চলে আসতে চায় সাগর। সাগরের সেকি অদ্ভুত টান—মানুষের সান্নিধ্য পাবার! মানুষ যেমন সাগরের টানে দূর দেশ থেকে চলে আসে, তেমনি সাগরও সময়ে-অসময়ে মানুষের কাছে আসতে পারে। এখন অবশ্য সে পান্নাসবুজ রঙে জ্বলজ্বল করছে।
সন্ধ্যা নামতেই শুরু হলো স্থানীয় শিল্পীদের নাচ-গানের আসর। বালির ওপর রঙিন পোশাক পরে স্থানীয় নৃত্য-গীতে আসর মাত। এই রিসোর্টে আমি একমাত্র এশীয়। বাকি সবাই ইউরোপীয়। নাচ-গান উপভোগ আর মৎস্য ভোগে পার হয়ে গেল সোনালি এক সন্ধ্যা। পার হলো আফ্রিকার মাঝে লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্রসৈকতে সময় কাটানোর ক্ষণ।

ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top