skip to Main Content

যাপনচিত্র I আদা-বাটা প্রেম

মৌসুমী হামিদ। তারকা অভিনেত্রী। সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে জড়িয়েছেন চলচ্চিত্রকার ও প্রযোজক আবু সাইয়িদ রানার সঙ্গে। জানা যাক এই যুগলের একান্ত জীবনের গল্প

সিলেটি গানের কথা জুড়ে, ১৪ জানুয়ারি বিয়ের ছবি আপলোড করেন আবু সাইয়িদ রানা। তবে মৌসুমী হামিদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়েন এর দুদিন আগেই। পরিচয় দুই বছর আগে, একটি ওয়েব সিরিয়ালে কাজের সুবাদে। সেখানে রানা ছিলেন ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার। তার মানে, একজন ক্যামেরার সামনের, আরেকজন পেছনের মানুষ।
৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার মৌসুমী বছর দুয়েক আগে বলেছিলেন, নিজের সমান উচ্চতার কাউকে পেলে বিয়ে করবেন! বরের শারীরিক উচ্চতা আধা ইঞ্চি কম হলেও মানসিক উচ্চতা এই সম্পর্কের নেপথ্য কারণ। বললেন, ‘রানার হাসি ও কৌতূহলী চাহনি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তার পরিপক্বতার একধরনের গভীরতা আছে। মজার ব্যাপার হলো, সে বয়সে আমার চেয়ে ছোট—এটা শুরুতে বুঝতেই পারিনি!’ একই প্রসঙ্গে রানার ভাষ্য, ‘মৌসুমীকে স্ক্রিনে যেভাবে দেখতাম, তার চেয়ে ব্যক্তি সে সম্পূর্ণ ভিন্ন! ওর সততা ও সরলতা অসাধারণ। কোনো রাখঢাক বা কৃত্রিমতা নেই।’
প্রকৃতির প্রতি এই নবযুগলের চরম অনুরাগ। রানা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভূতত্ত্ব বিভাগে। টানা চার বছর ব্যাঙ ও সাপ নিয়ে গবেষণা করেছেন। সেই বিষয়ে তার আছে কিছু ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক জার্নাল। শিক্ষার প্রয়োজনে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে হয়েছে প্রচুর। পরিচয়ের পর দেখলেন, দুজনের প্রকৃতিপ্রেম একীভূত! সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘটা করে ডেটে যাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো খুব একটা ঘটেনি; বরং হুট করে দেখা করা, আড্ডা দেওয়া, ঘোরাঘুরিই বেশি পছন্দ দুজনের। এখন পর্যন্ত দেশে এমন ছয়-সাতটি পাহাড়-জঙ্গলে দাবড়ে বেড়িয়েছেন একসঙ্গে। রানা বলেন, ‘বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার ভেতর ট্রেকিং করে পালংখিয়াংয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাই ধরুন। জঙ্গলে থেকেছি, তবে তার আগের প্রতিকূল ৯ ঘণ্টা মৌসুমীর সঙ্গে তিনটি পাহাড় অতিক্রম করার সময় বোঝা হয়ে গেছে, একজন মানুষের সততা কতটুকু।’
এই নবদম্পতির ঘুম ভাঙে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। চা পানের মাধ্যমে দিন শুরু। রান্নার কাজ মূলত নববধূই সামলান। তবে সকালে একেকদিন একেকজন চা বানান আর ঘর পরিষ্কার কিংবা গোছানোর কাজ সারেন বর। বাসায় ধূপ জ্বালানোর রেওয়াজ আছে তাদের। ব্রাঞ্চ সারেন ১১-১২টায়। মেনুতে কখনো কখনো আগের দিনের থেকে যাওয়া ভাত; তেল বা পেঁয়াজ ভাজা যোগে। সঙ্গে ডিমভাজি কিংবা অন্য কিছু। তবে সাধারণত চা, টোস্ট বিস্কুট, পাউরুটি টোস্ট, ডিম পোচ দিয়েই সারেন ব্রাঞ্চ। শুটিং থাকলে বাসায় দিনের প্রথম আহারপর্ব সারার সুযোগ মেলে না মৌসুমীর। তবে সকালে কিছু বাছাই করা গানবাজনা শোনার প্রবণতা আছে তাদের। যেমন মুর্শিদাবাদী প্রজেক্টের ইয়োগি গান। মৌসুমীকে অনুষ্কা শংকর, এস্তাস টনির মতো শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রানাই।
রাতে নিজেদের আবাসিক এলাকায় একসঙ্গে হেঁটে বেড়ান। এ ক্ষেত্রে রানার চেয়ে মৌসুমীর ধারাবাহিকতা বেশি। তার আছে গাছ সংগ্রহের শখ। মজার ব্যাপার হলো, হাঁটার সময় কোথাও কোনো গাছ পছন্দ হলে, মালিকের অনুমতি মিললে, সোজা বাসায় নিয়ে আসেন। এমনকি বান্দরবান ভ্রমণে গিয়ে, সেখান থেকে গাছ আনতেও দ্বিধা করেননি। অভিনেত্রী জানান, জীবনের এক পর্যায়ে হতাশা ও একাকিত্ব কাটিয়ে উঠতে গিয়েই বাগানচর্চার সূত্রপাত তার।
স্বামী-স্ত্রী দুজনই আড্ডাবাজ। রানার বেড়ে ওঠা রাজধানীর মুগদায়। সেখানকার বন্ধুদের পাশাপাশি কর্মস্থল নিকেতনের বন্ধুদের সঙ্গেও জমান আড্ডা। তবে ব্যক্তি হিসেবে তিনি কিছুটা অন্তর্মুখী। ক্ষণে ক্ষণে নির্জনতাও প্রিয় দুজনের। এর মধ্য দিয়ে অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রয়াস রয়েছে উভয়ের; বিশ্বাস করেন, আত্মার উন্নয়ন ঘটাতে বা মানুষ হিসেবে আরও উন্নত হতে পারলে জীবনের সার্থকতা।
বাসার অধিনায়ক মৌসুমী। হোম ইন্টেরিয়রে ছিমছাম ফার্নিচারেই আস্থা; বড় ফার্নিচার তেমন পছন্দ নয়। ওয়ার্ম লাইট ভালো লাগে। এককথায়, বাসায় সিমপ্লিসিটির ছাপ স্পষ্ট। স্টাডি রুমে বই সাজানোর পরিকল্পনা আছে। বিখ্যাত কিছু চিত্রকর্মের প্রতিলিপি দেয়ালে ঝোলানোর ইচ্ছে আছে রানার।
পোশাকের প্রশ্নে মৌসুমীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। তবে পরিধেয় নিয়ে নিজেকে খুব একটা সচেতন দাবি করেন না। গরম আবহাওয়ায় জিনস, ট্রাউজার, টি-শার্ট প্রিয়। পছন্দের রং সাদা, কালো, লাল ও নীল। কমফোর্টকে প্রাধান্য দেন। অনেক সময় হাতের কাছে যা পান, তা-ই পরে নেন। ইদানীং এক কালারের কাপড়ে আস্থা। কাকতালীয়ভাবে, রানা আগাগোড়াই মনোক্রমাটিক! অধিকাংশ সময় আরামদায়ক পোশাক যেমন ট্রাউজার, পায়জামায় দেখা যায় তাকে। পছন্দের রং সবুজ, নীল ও হলুদ। মৌসুমীর প্রিয় অ্যাকসেসরিজ আংটি। রানা হাতে ব্রেসলেট, গলায় লকেট পরেন মাঝেমধ্যে। ইচ্ছে আছে নথ পরার। বিয়েতে মৌসুমী পরেছিলেন লাল বেনারসি খাদি শাড়ি। তাতে বাড়তি নকশা বা কারুকাজ রাখেননি। রানা পরেছিলেন পাঞ্জাবি, কটি ও পাগড়ি।
অবসরে গান, সিনেমা আর বই দুজনকেই টানে। ফোক থেকে মেটাল—সব জনরাই শোনেন রানা। স্থানীয় মিউজিশিয়ানদের মধ্যে আসির আরমান, আহমেদ হাসান সানী, মুয়ীয মাহফুজ পছন্দের। এ ছাড়া র‌্যাপ শোনেন বেশ; স্টোয়েক ব্লিস থেকে আলী হোসেন, তাওরা সাফা, সম্রাট পর্যন্ত অনেকেরই। কাশ্মীরের র‌্যাপার এমসি ক্যাশবেক, এস্তাস টনি, মুজিবাবা, স্যাম গেরেট, দ্য সং অব দ্য বাটারফ্লাইও ভালো লাগে। পছন্দের ফিল্মমেকার ঋত্বিক ঘটক। ভূতত্ত্ববিদ না হয়ে দৃশ্যচিত্র নির্মাণের পথে হাঁটা ধরার নেপথ্য প্রেরণা ঋত্বিকই। ‘অযান্ত্রিক’ দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছিলেন; সেই ঘোর কাটেনি এখনো। এ ছাড়া ঋত্বিকের লেখা ‘সিনেমা অ্যান্ড আই’ বইটি থেকে উপলব্ধি করেছেন অনেক বিষয়। আন্দ্রেই তারকোভস্কি, জ্যঁ-লুক গোদার, বেলা তার, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, আলফ্রেড হিচকক প্রমুখের চলচ্চিত্রও প্রেরণা জোগায় তাকে। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকেন মৌসুমী। তবে তাকে বিশেষ আন্দোলিত করেছে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘বাড়িওয়ালি’। এ ছাড়া অনুরাগ কাশ্যপ, আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমায়ও মুগ্ধ তিনি। দুজনেই বাংলাদেশি নির্মাতা নূরুল আলম আতিকের কাজ দেখেন একটু ভিন্ন চোখে। তার নির্মিত ‘টেলিভিশন মজিদ’ ও ‘চতুর্থমাত্রা’ মুগ্ধ করেছে তাদের।
মৌসুমীর পছন্দের অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত, টাবু, বিজয় ভার্মা। পছন্দের সংগীতশিল্পী আহমেদ হাসান সানী, আসির আরমান, স্মুচেস ব্যান্ডের মিছিল, রেহমান অ্যান্ড ডুয়ো। প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ, সদর উদ্দিন আহমেদ চিশতী, আরজ আলী মাতুব্বর। রানার পছন্দ আহমদ ছফা, শহীদুল জহির, ফ্রান্ৎস কাফকার সাহিত্যকর্ম। পড়তে চান ফ্রেডরিখ নিটশে, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, জাক লাকাঁ, লিও তলস্তয়, ফিওদর দস্তয়েভস্কির লেখা। দুজনই বিশ্বকাপ এলে ভাসেন ফুটবল জোয়ারে। প্রিয় দল আর্জেন্টিনা। পছন্দের খেলোয়াড় লিওনেল মেসি।
রান্না মৌসুমীর কাছে অনেকটা ধ্যানের মতো। রান্না করে কাছের মানুষদের খাওয়াতে ভালোবাসেন। এমনকি রানা যেদিন প্রথম তার বাসায় এসেছিলেন, সেদিনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সেই মুহূর্তে তিনি আদা বাটছিলেন। এ জন্যই নিজেদের সম্পর্ককে মজার ছলে ‘আদা-বাটা প্রেম’ বলে ডাকেন তারা! পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের মতে মৌসুমীর রান্না করা সেরা আইটেম মাছ ও মাছের ঝোল এবং ইলিশ-পোলাও।
কার্লি কালো লম্বা চুলেই মৌসুমীকে সব সময় দেখা যায়। জানালেন, জীবনে কখনো চুলে কালার করাননি। মেকআপে মিনিমালিস্টিক। চেষ্টা করেন ভালো ব্র্যান্ডের পণ্য বেছে নেওয়ার। বেজ মেকআপে ডার্মা কালার বেছে নেন সব সময়। পছন্দের পারফিউম ব্র্যান্ড শ্যানেল; ফুটওয়্যার ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস। অন্যদিকে, রানা ভবিষ্যতে চুলে অ্যাকুয়া গ্রিন কিংবা ব্লু কালার করাতে আগ্রহী। দুজনেরই ট্যাটু করার ইচ্ছা আছে।
রাতে ঘুমানোর আগে মিউজিক শোনা চাই তাদের। জাহ্নবী হ্যারিসনের লাইক আ রিভার, মুর্শিদাবাদী প্রজেক্টের ইয়োগী, রাতের রাগ প্রভৃতি এ সময়ে পছন্দ।
জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে একসময় পয়েন্টলেস ফিলোসফিতে আটকে ছিলেন রানা। এখন মনে করেন, আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে, জীবনে জড়িত মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবা জরুরি। সাম্য ও নির্জনতাকে কানেক্ট করা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নির্জনতা থেকে স্পিরিচুয়াল জার্নি শুরু বলে বিশ্বাস করেন। মনে করেন, ফ্রিডম উইদ দ্য ফ্রেমওয়ার্কে চললে যেকোনো অবস্থাতেই বোহিমিয়ান লাইফের অনুভূতি পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে, মৌসুমী মনে করেন এনার্জি সীমিত। তাই কাইন্ডনেসকে ডিজার্ভিং জায়গায় প্রয়োগ করা শ্রেয়। প্রতিদিন নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে ছাড়িয়ে যেতে চান। মানবিক ও সহানুভূতিশীল হতে পারা তার কাছে অপরিহার্য। ব্যক্তিস্বার্থে সম্পর্ক গড়া কিংবা কেনা-বেচার তিনি ঘোরবিরোধী।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন; মৌসুমী হামিদের সৌজন্যে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top