skip to Main Content

স্বাদশেকড় I রসাল রসগোল্লা

স্বাদ অতুলনীয়। ইতিহাস নানা বিভ্রান্তিতে ভরা হলেও এর গ্রহণযোগ্যতা অসামান্য

রসগোল্লা সম্পর্কে নথিভুক্ত ইতিহাস যথেষ্ট নয়। লোককাহিনি সূত্রে বিশ্বাস করা হয়, সপ্তদশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে বর্তমান বাংলাদেশে এর উদ্ভাবন; পরে ১৮৬৮ সালে নবীন চন্দ্র দাসের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তা পায়। যদিও ড্যান্ডি রামায়ণ অনুসারে, ওডিশায় ১৫০০ সাল থেকে রসগোল্লার অস্তিত্ব ছিল; নরম ও কোমল ছানা প্রক্রিয়াকরণের এই মহিমা ভারতীয়দের কাছে উন্মোচন করেছিলেন পর্তুগিজ উপনিবেশবাদীরা। এই কৌশলে দক্ষ কারিগরদের তৈরি করা ছানা পর্যাপ্ত ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে চিনির সিরাপে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর সঠিক সংমিশ্রণ গরম করলে মেলে বিশেষ পনির বল, যেটি রসগোল্লা নামে খ্যাত।
পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশায় রসগোল্লার উদ্ভাবন ঘিরে রয়েছে দুটি ভিন্ন ভিত্তি। ভারতের এই দুই প্রদেশই নিজ নিজ ঐতিহ্যবাহী খাদ্যসংস্কৃতির জন্য প্রসিদ্ধ। এগুলোর সংলগ্ন রাজ্যগুলো ভারতের পূর্বাঞ্চলের নদীতীরে অবস্থিত, যেখানে সেচের কাজ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেসব স্থানে রয়েছে বিস্তীর্ণ সবুজ জমিন। ফলে ব্যাপক হারে পশুপালনের রেওয়াজ। বিশেষ করে দেশটির পূর্বাঞ্চলে গবাদি প্রাণীর দুধের পর্যাপ্ততা এবং মিষ্টির প্রতি শৌখিনতা বেশ কিছু দুগ্ধজাত খাবার উদ্ভাবনে ভূমিকা রেখেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক পটভূমিতে নজর বুলিয়ে দেখা যায়, এখানকার রসগোল্লার মৌলিক কাঁচামাল ছানা। কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রণীত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ লোকপ্রিয় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী, ধর্মগুরু মহাপুরুষ ও সমাজসংস্কারক চৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬-১৫৩৩) সময়কালে ছানার অস্তিত্বের কথা নথিভুক্ত রয়েছে। ছানায় তৈরি মিষ্টি বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে অর্ধ সহস্রাব্দের বেশি সময় জায়গা করে রেখেছে। এ ধরনের তিনটি মিষ্টি—ছানা চাটকা, ছানা পিঠা ও ছানা মন্ডার উল্লেখ রয়েছে শ্রীহরিদাস দাস সংকলিত ‘শ্রীশ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণব-অভিধান’-এও। তবে এই তিন ছানাজাত মিষ্টান্নের সঙ্গে অবশ্য রসগোল্লার সম্পর্ক নেই! রসগোল্লার বর্তমান রূপটি পরবর্তীকালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে রসগোল্লার উৎপত্তির নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের ওলন্দাজ ও পর্তুগিজ উপনিবেশবাদীরা। মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত উচ্চমানের ছানা প্রক্রিয়াকরণ ও সংশ্লেষণের প্রযুক্তি তাদের কাছ থেকেই আসা। ডাচ পনির উৎপাদন প্রক্রিয়া শুধু তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ছানা প্রক্রিয়াজাতকরণে খুব ছোট পরিসরে চালু হয়েছিল। ভারতীয় খাদ্যপণ্যের ওপর বিদেশি প্রভাবের প্রথম প্রমাণ মেলে ১৬১০ সালে। ছানা বা এটি থেকে প্রাপ্ত পণ্যের ওপর বিদেশি প্রভাবের আগে এই উপমহাদেশে এর বাণিজ্যিকীকরণ বা ভক্ষণের নজির মেলেনি। ছানাভিত্তিক পণ্যগুলো খাওয়ার অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হওয়ার কারণ ছিল, এটি এমনভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হতো, যা নষ্ট দুধের পণ্য হিসেবে চিহ্নিত। পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় অবস্থিত ফুলিয়ায় হারাধন ময়রা নামে এক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ভুলবশত আদি রসগোল্লা তৈরি করেন। ধারণা করা হয়, সেটি ১৮৪৬-৪৭ সালের কথা। পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্র ধরে ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রণব রায় ‘বাংলার খাবার’ [১৯৮৭] বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘কৃত্তিবাসের জন্মস্থান ফুলিয়া গ্রামে রসগোল্লার জন্মভূমি। ঐ গ্রামের হারাধন ময়রা রানাঘাটের পালচৌধুরী মহাশয়দের মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিত। তাহার শিশুকন্যা কাঁদিতেছিল। তাহাকে সান্ত¡নার জন্য উনানের ওপর তৈরি রসে ছেনা ফেলিয়া দেখিল উৎকৃষ্টসামগ্রী তৈয়ার হইয়াছে। পালচৌধুরী জমিদারেরা উহার “রসগোল্লা” নামকরণ করেন।’ সেটিই পরিমার্জিত হয়ে জনপ্রিয়তা পায় নবীন চন্দ্র দাসের হাতে, এমনটাই বিশ্বাস খাদ্য-ইতিহাসবিদদের অনেকের।
সফলভাবে রসগোল্লার উদ্ভাবনে বিজ্ঞান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োগ করেছিলেন নবীন চন্দ্র দাস। ডাচ ও পর্তুগিজদের উদ্ভাবনী সব প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ছানার প্রচলিত ভান্ডারকে এক করা সত্ত্বেও, অবিভক্ত বাংলায় ও তার বাইরে মিষ্টান্নকারীরা এটিকে একটি সুস্বাদু মিষ্টিতে রূপান্তর করতে পারছিলেন না। বুদ্‌বুদ চিনির সিরাপে ছানা ক্যারামেল মিশ্রিত ক্রাম্পে রূপান্তরিত হওয়ার পাশাপাশি বৃত্তাকার কাঠামো পেতে ব্যর্থ হচ্ছিল। ব্যর্থ এই প্রচেষ্টার একটি উদাহরণ হতে পারে, ছানার বাদামি পোড়া একধরনের মিষ্টান্ন, যাকে ইতিহাস গ্রন্থে ডেলা-রসগোল্লা বলা হয়।
নবীন চন্দ্র দাস ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৮ সালের মধ্যে, তিন বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশেষে রসগোল্লা নামক এই দারুণ সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরি করেছিলেন, যেটি সম্পূর্ণরূপে ছানা দিয়ে তৈরি এবং একটি স্পঞ্জের গঠন ও বৈশিষ্ট্য বহন করে। তার অসাধারণ উদ্ভাবন শুধু বাঙালি পরিচয়ের সমার্থক হয়ে ওঠেনি, বর্তমানে ভারতের ‘ন্যাশনাল সুইট ডিশ’-এর মর্যাদা পেয়েছে। তিনি প্রায় দেড় শ বছর ধরে ‘রসগোল্লার কলম্বাস’ হিসাবে সমাদৃত হয়ে আসছেন।
কেমন ছিল তার রসগোল্লার রেসিপি? তিনি কেসিন (দই) দিয়ে অল্প কয়েকটি টুকরো তৈরির পর সেগুলো গরম চিনির সিরাপে সেদ্ধ করেছিলেন। এর চূড়ান্ত রূপ হলো একটি সুস্বাদু, মসৃণ মিষ্টি—যার একধরনের বিশেষ স্বাদ রয়েছে। এটি মূলত রসগোল্লা উদ্ভাবনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ইতিহাস। তবে ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে ধর্মীয় লোককাহিনিকেও বিবেচনায় রাখা চাই।
সেই প্রসঙ্গে আসা যাক ওডিশায় রসগোল্লার উৎপত্তির ঐতিহাসিক পটভূমিতে। মিষ্টান্নটি সেখানে ‘রসগোলা’ নামে পরিচিত। অনেক আগে থেকেই ওডিশার রসগোলার একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। কারণ, এটি পুরীতে অবস্থিত বিশ্বের বিখ্যাত জগন্নাথ (হিন্দু দেবতা) মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত। নীলাদ্রি বিজে (ধর্মীয় উৎসব) মন্দিরের আচার অনুযায়ী, শ্রী জগন্নাথের পক্ষ থেকে রসগোলাভোগ ঐতিহ্যগতভাবে দেবী লক্ষ্মীকে নিবেদন করা হয়। মূলত এই কাজ করেন সেবকেরা। জগমোহন রামায়ণ বা ড্যান্ডি রামায়ণ হচ্ছে একধরনের ধর্মীয় গীত, যা পুরী জগমোহন মন্দিরে গাওয়া ও রচিত হয়েছে, তাতে রসগোলার উল্লেখ পাওয়া যায়। জগমোহন রামায়ণের ‘অজোধ্যা কাণ্ড’তে ছানা, রসগোল্লা ও অন্যান্য ছানাভিত্তিক মিষ্টিজাতীয় পণ্যের ব্যাপক উল্লেখ মেলে। তাতে বলা হয়েছে, ভগবান রামকে ফিরিয়ে আনার পথে তার দুই ভাই ভরত ও শত্রুঘ্ন ঋষি ভরদ্বাজের সংস্পর্শে আসেন এবং সেই সময়ে ঋষি ভরদ্বাজ তাদের ছানাপুরি, ছানালাড্ডু, রসগোলা ও রসবালি নামে বিভিন্ন ছানাভিত্তিক পণ্য উপহার দেন। ‘উৎকল ভ্রমণম’ গ্রন্থে রসগোলার বেশ কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। ফকির মোহন সেনাপতি সেই দিনগুলোতে ওডিশায় রসগোলার ব্যবহার স্বীকার করেছিলেন।
কবি দামোদর পট্টনায়ক কটকের (ওডিশা) প্রশংসিত ঐতিহাসিক মেলা বালি জাহার (ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে যাত্রা) বর্ণনা করেছেন এবং মিষ্টির দোকানে রসগোল্লার গৌরবময় উপস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন।
এদিকে, রসগোল্লার সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক দিকে নজর বোলালে দেখা যায়, বহুকাল ধরেই ভারতীয় সমাজে দুগ্ধভিত্তিক মিষ্টি খাবার বিশেষ করে রসগোল্লা দিয়ে মিষ্টি মুখ একটি শুভ দিক হিসেবে বিবেচিত। এই উপমহাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান অথবা নতুন কিছু উদ্বোধনের সময় এটি অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক আচার হিসেবে গণ্য হয়। আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ওডিশার জগন্নাথ মন্দিরের চ্যাপন ভোগ হলো ভগবান জগন্নাথ, বলরাম এবং দেবী সুভদ্রার কিংবদন্তি নৈবেদ্য; রসগোলাও চ্যাপন ভোগের অন্তর্ভুক্ত।
দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এই ঐতিহ্যের নথিভুক্ত প্রমাণ রয়েছে। লোককাহিনি অনুসারে, দেবী লক্ষ্মীর সম্মতি ছাড়াই ভগবান জগন্নাথের ৯ দিনব্যাপী রথযাত্রা তাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে এবং তিনি ভগবান জগন্নাথ ও তার কাফেলাকে গৃহে প্রবেশে বাধা দেন। রাগ প্রশমিত করার জন্য ভগবান জগন্নাথ তাকে রসগোলা প্রদান করেন। ঐতিহ্যগতভাবে এটিকে জগৎ মাতার সম্মান লঙ্ঘনের জন্য মহাপ্রভুর দেওয়া রসগোল্লা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাচিনাকা নামের এই আচার নীলাদ্রি বিজে পালনের অংশ, যা রথযাত্রার পরে মন্দিরে দেবতাদের প্রত্যাবর্তনকে চিহ্নিত করে। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজায় রসগোল্লা হলো নৈবেদ্যের একটি উপাদান, বিশেষত বাবু সংস্কৃতির (অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে) সময় থেকে বিজয়া দশমীতে (আশ্বিন মাসের দশম দিন, হিন্দু লুনি-সৌর ক্যালেন্ডারের সপ্তম মাস) এই মিষ্টান্ন হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি সমাজে হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে সকল ধর্মের প্রায় সব বিয়ের অনুষ্ঠানে শাশুড়িরা রসগোল্লা দিয়ে মেয়ের জামাইকে বরণ করার রেওয়াজ রয়েছে।
আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে রসগোল্লাকে একটি পবিত্র খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে কারণে এটি বিভিন্ন ধরনের আচার যেমন ভাইফোঁটা, আইবুড়োভাত, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন এবং জামাইষষ্ঠীতে পরিবেশন করা হয়।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top