skip to Main Content

কভারস্টোরি I বারো হাতের বয়নবৃত্তান্ত

বাংলার সংস্কৃতি, আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের এক অপরূপ রূপকথা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এই একখণ্ড কাপড়ে। দিনবদলের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তার আকর্ষণ এখনো অমলিন বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিশেষ করে বাঙালির ওয়্যারড্রোব আর মনের কোণে। পুরোনোকে বর্জন না করে, পরিবর্তনে-পরিশীলনে পরাক্সমুখ না হয়ে শাড়ি আজও টিকে আছে স্বগরিমায়, সে কেমন করে? প্রাচীন ভাস্কর্য, মন্দির গাত্র, গুহাচিত্র হয়ে রমণী অঙ্গে শোভিত বস্ত্রখণ্ড পরবর্তীকালে কীভাবে শাড়ির রূপ পেল, সে রহস্যেরই কিয়দংশ জাহেরা শিরীনের লেখায়

বিশ্বজুড়ে হাজার ধরনের বৈচিত্র্যময় নকশা ও প্যাটার্নের সেলাই করা পোশাকের কোনো কমতি নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেলাই না করা দীর্ঘ একখণ্ড কাপড়েই যেন আটকে আছে সব আকর্ষণ। তাই আজও তা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শাড়ি। সভ্যতার শুরু থেকে আজ অব্দি পোশাকটির মর্যাদা, গুরুত্ব ও চাহিদা একই রকম। প্রায় পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন এই বস্ত্রখণ্ড। যা ছিল আজকের শাড়ির আদিরূপ, তা আজও একই রকম তাৎপর্যপূর্ণ, যা অন্যান্য পোশাকের ক্ষেত্রে বিরল।
শিকড় সন্ধানে
আবহমান বাংলার এই শাড়ির শুরুটা কবে থেকে? কবে থেকে প্রচলন? এর উত্তর হয়তো মিলতে পারত ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু পাল আমলের আগে বাঙালির ইতিহাস কি স্বচ্ছভাবে জানা যায়? হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন, ‘বাঙলার ইতিহাস এখনো অত পরিষ্কার হয় নাই যে কেহ নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারেন বাঙলা ঈজিপ্ট হইতে প্রাচীন অথবা নতুন। বাঙলা নিনেভা ও বেবিলন হইতে প্রাচীন অথবা নতুন’ [বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন, সপ্তম অধিবেশন]। শাড়ি নিয়েও একই কথা বলতে হয়। ১৯৭৬ সালে অল ইন্ডিয়ান ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের ২৮তম অধিবেশনে পোশাক সম্পর্কে কৃষ্ণা দাস তার প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘The origin of clothing is lost in the mist of antiquity. Scantily clad Indian culture is older than history.’
শাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা পরোক্ষ, অপূর্ণ ও অপ্রতুল। শাড়ির আদি ও উৎস জানতে হাতড়ে বেড়াতে হয় পুরোনো লেখামালা, মূর্তি বিগ্রহ, স্থাপত্য, পোড়ামাটিশিল্প আর বিচ্ছিন্ন কিছু সাহিত্য উপাদান। তবে অনেকের মত, যখন থেকে সুতা তৈরির পদ্ধতি জেনেছে মানুষ, সেদিন থেকে শাড়ি তৈরিরও প্রথম পর্ব শুরু। বস্ত্র বোনার পদ্ধতি প্রথম কারা উদ্ভব করে, তা সঠিকভাবে প্রমাণিত না হলেও এক টুকরো বস্ত্রে শরীর জড়িয়ে রাখা দিয়ে শাড়ি পরার প্রথম ধাপটি নিঃসন্দেহে শুরু হয়েছিল এ উপমহাদেশেই। হেরোডোটাস এবং পরবর্তী লেখকেরা সুতা থেকে তৈরি এই বস্ত্র বা বস্ত্রখণ্ডকে অদ্ভুত জিনিস বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এমনকি আলেক্সান্ডারের সঙ্গে এ উপমহাদেশে ঘুরতে আসা গ্রিক পর্যটক ও লেখকেরা দীর্ঘ কাপড় দিয়ে শরীর আবৃত করে রাখা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। পরিধানটি কী? কোথা থেকে পায় এ দেশের মানুষ এই বিচিত্র, অদ্ভুত পরিধেয়? তাদের ভাষ্যে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে বস্ত্রখণ্ডটি। বলা হয়, সিন্ধু সভ্যতার লোকেরাই প্রথম বস্ত্র বুনতে শুরু করে। কারণ, ২৮০০-১৮০০ খ্রিস্টপূর্বের এই সভ্যতাতেই প্রথম বস্ত্রের আবিষ্কার। মহেঞ্জোদারোর খননকার্যে একটি মূর্তি মেলে। ষোলো ইঞ্চি উচ্চতার মূর্তিটির শরীরের কোমরের অংশে জড়ানো ছিল একটি বস্ত্রখণ্ড। ধারণা করা হয়, সেটিই বর্তমান শাড়ির আদিরূপ। তারপর যুগে যুগে নানা ভাস্কর্য, গুহাচিত্র, প্রাচীন সাহিত্য ও কাব্যগ্রন্থেও বারবার উঠে আসে শাড়ির নাম। বাদ পড়েনি মহাকাব্যের যুগও। রামায়ণ, মহাভারতেও এর নাম উচ্চারিত হয়েছে বহুবার। আবার সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজদরবারের চিত্রে বিভিন্ন স্টাইলে শাড়ি পরিহিত নারীদের ছবি মেলে। গুপ্ত আমলের ইলোরা অজন্তার প্রাচীন চিত্রাবলিতে দেখা যায় শাড়িজাতীয় পোশাক। এ গেল দু হাজার বছরের তথ্য। তারও আগের খোঁজ পেতে হলে লেগে যেতে হবে শাড়ি শব্দের উৎপত্তি অন্বেষণে। আর্যদের সময়ে শব্দটি আছে সাট্কা অথবা শাটী নামে। সাট্‌কা পালি শব্দ। আর শাটী সংস্কৃত। নানাভাবে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে, হাজার হাজার বছর আগে এই দ্রাবিড়দের দেশেই শাড়ি প্রথম উদ্ভাবিত হয়। অল ইন্ডিয়ান ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সে কৃষ্ণা দাস তার পঠিত নিবন্ধে বলেন, ‘In ancient India the use of garment by women is noticed from the indus valley civilisation’। যা শুনে নির্দ্বিধায় বলা যায়, আজকের শাড়ির ইতিহাস এই বাংলার আকাশ মাটি আলো বাতাসেই নিহিত। এর মূল এ ভূখণ্ডেই গ্রথিত।
মতান্তরে-রূপান্তরে
এক বা দুখণ্ড বস্ত্র। এই টুকরো কাপড়ই কালক্রমে আজকের শাড়িতে রূপ নিয়েছে। তবে এ নিয়ে নানা মত প্রচলিত। ঐতিহাসিক ড. চার্লস ফ্যাব্রির মত, মেয়েরা তখন পাল্লা দিয়ে ধুতি পরতেন; খালি পায়ে, খালি গায়ে থাকতেন। তবে প্রাচীনকালে মেয়েদের পরা সেই বস্ত্রখণ্ড তখনকার দিনের ছেলেদের পরিহিত বস্ত্রের অবিকল ছিল। অবশ্য ফ্যাব্রির এ তথ্য যথার্থ নয়। ছেলেদের পরিধেয় ছিল মেয়েদের বস্ত্রের তুলনায় খাটো। শাড়ির সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। পরার ধরনও ছিল আলাদা। সেই সঙ্গে পাড় আর আঁচলের যোগ পুরুষের পোশাক থেকে নারীর পোশাককে আলাদা করে। শাড়ির ক্ষেত্রে সম্ভবত এটিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর এই বৈশিষ্ট্য শুধু শাড়িতেই দেখা যায়।
ধাপে ধাপে এগোনো শাড়ি পরার কায়দা পাল্টেছে যুগে যুগে। আদিকালে শাড়ি নামের বস্ত্রখণ্ড মেয়েরা পরতেন কোমর জড়িয়ে, অনেকটা সমকালীন পুরুষের পরার মতোই। যদিও পুরুষদের মতো মেয়েদের পরিধেয়তে কোনো কাছা থাকত না। বহরেও অত খাটো ছিল না শাড়ি। পুরুষদের মতোই সেকালে মেয়েদের দেহের ঊর্ধ্বাংশে কোনো আবরণের চল ছিল না। ক্রমে অবস্থাপন্ন ঘরে ও নগর অঞ্চলে উত্তরবাসের প্রচলন হয়। অধোবাসে উত্তরবাসের সংমিশ্রণে যে পোশাক, তা পরিচিত হতে শুরু করে ভদ্রবেশ বলে। অধোবাসের মতো উত্তরবাসও ছিল খণ্ড কাপড়, সেলাই ছাড়া। উত্তরবাসের খণ্ড কাপড় দিয়েই বক্ষাবরণের কাজ চলেছে, সেই সঙ্গে অবগুণ্ঠনের। পরবর্তীকালে সম্পন্নদের মধ্যেও মাথা ঢাকার জন্য আলাদা কাপড় ব্যবহৃত হয়েছে। গরিব অথচ ভদ্রঘরের মেয়েরা উত্তরবাসের প্রয়োজনবোধ করতেন; তবে তার জন্য ভিন্নভাবে কাপড়ের টুকরার ব্যবস্থা করতে পারতেন না বলে অধোবাসের কিছু অংশ টেনেই ঘোমটা দিতেন। তার নাম সেওটা। পাল আমলে মেয়েদের বসনের ওপর জড়ানো অংশের নাম ছিল আধনাই (আধখানা)। সেই সেওটা ও আধনাই আজকের আঁচল। অধোবাসের অংশবিশেষ টেনে মাথায় দেওয়ার যে কায়দা, আজকের শাড়ির সঙ্গে মিল আছে তার। শাড়ির টানা অবিচ্ছিন্ন অংশই আঁচল। আদিকালের বসনের মতো আজকের শাড়িও একখণ্ড বস্ত্র। দশ, এগারো কি বারো হাত। অধোবাস ও শিরোচ্ছাদনের সেই আলাদা দুই বা তিন খণ্ডই এক হয়ে একটি অখণ্ড রূপ নিয়ে হয়েছে আজকের শাড়ি।

নাম দিয়ে যায় চেনা
পরথমে পৈরাইল শাড়ি নাম গঙ্গাজল।
নউখের উপরে তুলিলে শাড়ি করে টলমল॥
সেই শাড়ি পইরা কন্যা শাড়ির পানে চায়।
অইল না তার মনের মত দাসীদের পৈরায়॥
তারপর পৈরাইল শাড়ি নাম মুক্তামণি।
সাত রাজার ধন ল্যাগগ্যাছে শাড়ির গাঁথুনি॥
সেই শাড়ি পৈরাইয়া কন্যা শাড়ির পানে চায়।
দিল মনা না খুশি হইল খুলাইয়া ফালায়॥
তারপর পৈরাইল শাড়ি তার নাম কেঁও।
শাড়ি মধ্যে আক্কিয়া থুইছে বিয়াল্লিশ গাঁও॥
আরেক শাড়ি তুল্লা রাখছে আসমানতারা নাম।
লতাপাতা আঁকছে কত নসিবিন্দা কাম॥

অতীতে লোকগীতিকায় বিয়ে উপলক্ষে কনে সাজানোর গানে পাওয়া যায় অনেক রকম শাড়ির নাম। আরও ছিল অগ্নিফুল, উদয়তারা, ময়ূরপাঙ্খা, মেঘভম্বুর, যাত্রাসিদ্ধি, শ্রীরামখানি, লক্ষ্মীবিলাস, মুক্তামণি, গঙ্গাজলি, বসন্তবাহার, পবন বাহার, আগাডুরি, কনকলতা আর নীলাম্বরীর উল্লেখ।
পোশাকের রাজ্যে শাড়িই একমাত্র, যার রূপবৈচিত্র্যের মতো নামও বিচিত্র। রাধা যখন কৃষ্ণাভিসারে যেতেন, তখন তার পরনে থাকত রুপালি জরিকাজের মেঘবরণ শাড়ি। কবি রাজশেখর যার নাম দিয়েছিলেন মেঘাম্বরী। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময় (কৌটিল্যের কালে) চার রকম শাড়ি তৈরি হতো—দুকূলা, কুসুম, কার্পাসিকা ও পত্রোনা। এসবের বেশির ভাগই তৈরি হতো উত্তরবঙ্গ, ঢাকার বিক্রমপুর এলাকা, সিলেট ও আসাম অঞ্চলে। এ তথ্য মেলে আর সি মজুমদারের ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ গ্রন্থের প্রথম পর্বে। প্রাচীনকালে নারীরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন শাড়ি ব্যবহার করতেন। এসব শাড়ির নামে বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। যেমন প্রথম মা হলে বা হতে গেলে পরিবার বা প্রিয়জন থেকে যে শাড়ি উপহার হিসেবে মিলত, তার নাম অধ্যয়া। এর রং হতো লাল। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মেয়েরা পরতেন নীল পাড়ে হলুদ শাড়ি। নাম ব্রশতী। পদ্মলতা শাড়ি পরতেন কেবল বিবাহিতরাই। নববধূকে পরানো হতো দুমাথাযুক্ত মৎস্য ও ফুলের নকশা তোলা ‘মৎস্য পুষ্প’ শাড়ি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আজ অব্দি মাছ-ফুল আঁকা নকশা মঙ্গল চিহ্নের স্মারক।
কবি জসীমউদ্‌দীনের ‘পূর্ববঙ্গের নকশী কাঁথা ও শাড়ি’ প্রবন্ধে ময়মনসিংহ এলাকার চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার শাড়ির নাম উল্লেখিত আছে। কাদিরের শাড়ি, জামের শাড়ি, ফরাসি শাড়ি, জলে-ভাসা, এক পাছুল্লা, কাচ পাইড়, কালপিন, গাল পাইড়, ফুরানি, বাশি পাইড়, চোদ্দরসী, কাঁকড়ার ছোপ, আয়না ফোটা, সোনাঝুরি, গোলাপ ফুল, কুসুম ফুল, রাসমঙ্গল, কলমিলতা, মধুমালা…আরও কত মায়াময় কাব্যিক সব নাম।
বাংলাদেশের বুক থেকে
সময়টা তখন প্রাক্-শিল্পবিপ্লবের। পৃথিবীর সেরা বস্ত্রশিল্প কেন্দ্রের কাতারে নাম উঠে আসে বাংলাদেশের। বুনিয়াদ অবশ্য অনেক আগের। ইতিহাস বলে খ্রিস্টের জন্মেরও আগে। ঢাকা, কাপাসিয়া, সোনারগাঁও, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, খুলনা, কুমিল্লা প্রসিদ্ধ ছিল বস্ত্রশিল্পের বরাতে। সোনারগাঁয়ে যে মসলিন উৎপাদিত হতো, তার উল্লেখ মেলে ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থে [গোলাম হোসাইন সলিম, ১৭৮৮]। আরও জানা যায় সরকার ঘোড়াঘাটে (দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও মালদহ নিয়ে গঠিত) গঙ্গাজলী বস্ত্র উৎপাদনের খ্যাতির গল্প। একসময় সাদুল্লাপুর, নিশিন্তপুর, আমিনপুর বিখ্যাত ছিল পাবনাই পাইড় কাপড় তৈরির জন্য; যা সূক্ষ্মতায় মসলিনকে টক্কর দিতে সমর্থ ছিল সে সময়। খ্যাতি ছিল নোয়াখালীর যুগদিয়া, লক্ষ্মীপুর আর কলিন্দার। কুমারখালী, সাতক্ষীরার শাড়ির সুনামও ছিল মুখে মুখে। কুমিল্লার সরাইলে তৈরি তানজেলের বয়ান মেলে হান্টার ও বার্ডউডের গ্রন্থে। তাতে আরও লেখা আছে মগ রমণীদের সুতি ও রেশমি বস্ত্র বয়নের কথাও। এ ছাড়া ঢাকায় নানা ধরনের কাপড় বোনা হতো। টেলরের মতে, ১৮৪০ সালে এই অঞ্চলের বস্ত্রশিল্প যখন ধ্বংসের মুখে, তখনো ঢাকায় ৩৬ রকমের কাপড় বোনা হতো। তাই তো ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘বাংলার মসলিন বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন তৈলেই কিনতেন একদিন
চরকার ঘর্ঘর শ্রেষ্ঠীর ঘর-ঘর
ঘন ঘন সম্পদ আপনায় নির্ভর!’
মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ রাজত্ব হয়ে, শিল্পায়নের ধাক্কা সয়ে এখনো স্বগরিমায় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শাড়িগুলো। সে কোন জাদুবলে?
মসলিন
হাতেতে লইলে শাড়ি মুইষ্ঠেতে মিলায়
মিরতিকাতে থুইলে শাড়ি পিঁপড়ায় লইয়া যায়…
ময়মনসিংহের এ লোকগীতির বর্ণনা কল্পনাপ্রসূত নয়। ঐতিহ্য আর ইতিহাসের মিলমিশে তৈরি অপূর্ব এক সৃষ্টি। মসলিন। পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মানের সুতিবস্ত্র। যা তৈরি হতো শুধু ঢাকাতেই। আকাশের মতো নির্মল, স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আর পাখির পালকের মতো হালকা মসলিনকে বলা হতো ‘বোনা বাতাস’ (woven wind)। আরেক নাম ছিল ‘হাওয়ার ইন্দ্রজাল’ (Web of the woven wind)। এ নিয়ে প্রচলিত মুখরোচক গল্পও রয়েছে মেলা। উইলিয়াম বোল্টের ‘কনসিডারেশন অন ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ারস’ গ্রন্থে যার বর্ণনা রয়েছে। যার একটি মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা জেবুন্নিসাকে ঘিরে। একটি মসলিন বস্ত্র সাতবার পেঁচিয়ে শরীরে জড়ানোর পরও সম্রাটের কাছে এই বলে বকুনি খেয়েছিলেন যে, কেন তিনি কোনো পোশাক না পরেই প্রকাশ্যে এসেছেন! দ্বিতীয় গল্প অনুসারে একবার ঘাসের ওপর মসলিন শুকাতে দেওয়ার পর ঘাসের সঙ্গে কাপড়টাও গরু খেয়ে ফেলে। রুষ্ট হয়ে নবাব আলীবর্দী খান গরুর মালিককে ঢাকা থেকে বের করে দেন। মিহি মসলিন শাড়ির জন্য সুতাও হওয়া লাগত অত্যন্ত মিহি। এ সুতা তৈরি করতে পারতেন শুধু সেই সব মেয়ে, যাদের আঙুল ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বেটলর বলেন, যেকোনো রকম মানসিক অস্থিরতা কিংবা দুশ্চিন্তার মধ্যে সুতা কাটা যেত না। শিশির ভেজা আবহাওয়ায় সুতা কাটা হতো। শিশির না থাকলে একটি পাত্রে পানি রেখে তৈরি করা হতো বাষ্পীয়মণ্ডল। প্রখর সূর্যের তাপে সেই সুতা ছিঁড়ে যেত। দুই মাসের শ্রমে তৈরি হতো এক তোলা সুতা। এক রশি সুতার দৈর্ঘ্য ছিল ১৭৫ হাত। এ জন্যই তো ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে, ‘With all our mechines and wonderful inventions we have hitherto been unable to produce a fabric which for fineness and utility can equal the woven air of Dacca’।
জেমস টেলরের বর্ণনা অনুসারে, ঢাকা জেলার প্রতিটি গ্রামে কমবেশি তাঁতের কাজ চললেও উৎকৃষ্ট ধরনের মসলিন তৈরির জন্য কয়েকটি স্থান প্রসিদ্ধ ছিল। এগুলোর মধ্যে প্রথম চারটির অবস্থান বর্তমান ঢাকাতেই, বাকি দুটো ময়মনসিংহে। ডোরাকাটা, মসৃণ, ছককাটা, রঙিন—রং আর বুননপ্রণালি অনুযায়ী মসলিনকে ভাগ করা হতো। সূক্ষ্মতা, ব্যবহারিকতা আর বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন নাম ছিল মসলিনের। মলমল, আব-ই-রাওয়ান, শবনম, শরবন্দ, তনজেব, নয়নসুখ, বদনখাস…আরও কত কী! বেশির ভাগ নামই ফার্সি আর আরবি শব্দ থেকে উদ্ভূত। আঠারো শতকের শেষ থেকেই অন্ধকারাছন্ন হতে থাকে ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ। তার প্রভাব প্রকট আজ অব্দি। সেই ধারাবাহিকতায় অবলুপ্ত মসলিন আজ জাদুঘরে প্রদর্শনীর, ইতিহাসের তথ্য আর গবেষণার বিষয়।
জামদানি
এর ইতিহাসও মসলিনের মতো একই সঙ্গে স্বচ্ছ ও অস্পষ্ট। সঠিক তথ্যের জন্য নির্ভর করতে হয় বিদেশি গবেষক ও পর্যটকদের বিচ্ছিন্ন বর্ণনা, স্থানীয়ভাবে কিছু শ্রুত কাহিনি আর প্রবীণ তাঁতিদের অস্পষ্ট স্মৃতির ওপর। কবে, কখন জামদানি শাড়ি তৈরি শুরু হয়, তার হিসাব তাই একটু গড়বড়ে। তবে জামদানি যে ইতিহাসখ্যাত মসলিনের অঙ্গশিল্প বা একটি প্রজাতি, তা নিয়ে মতভেদ নেই। এ একান্তভাবে ঢাকার নিজস্ব কাঁচামালে তৈরি এবং এই শহরের তাঁতশিল্পীদের মৌলিক শিল্পবোধ ও ধ্যানধারণার সৃষ্টি। তাই পৃথিবীর আর কোনো দেশের তাঁতিদের দিয়ে এ শাড়ি তৈরি সম্ভব হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ শাড়ির শিল্পীরা সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই। শুধু ঢাকার নিকটবর্তী ডেমরা ও রূপগঞ্জ উপজেলার কিছু অঞ্চলে বংশানুক্রমে এই গুণী কারিগরদের বসবাস। এ শিল্পীদের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে জামদানি তৈরির চেষ্টা বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, পারিবারিক পরিমণ্ডলের অভাব। আর শীতলক্ষ্যার পানি থেকে উত্থিত বাষ্প জামদানির সুতা প্রস্তুত এবং কাপড় বোনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রভাবক। পরিবেশ আর প্রকৃতির প্রভাব যে লোকশিল্প সৃষ্টির মূল, তার দারুণ উদাহরণ।
ইতিহাস বলে, ইরানি বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুসংখ্যক তাঁতির সহযোগিতায় জামদানির বুনন শুরু হয় ঢাকায়। মসলিন শাড়িতে নকশার প্রয়োজনেই এর সূচনা। মোগল আমলে, বিশেষ করে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত শিল্পকর্মের ওপর যে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, তার প্রত্যক্ষ ফল জামদানি শাড়ি। এটি তৈরিতে মলমলের মতো কিছুটা চিকন সুতার ব্যবহার শুরু মোগল আমলেই। এর আগে কখনো তা তৈরি হয়নি। যা দিয়ে রাজকীয় পোশাক তৈরি হতো মোগলের জন্য। আর শাড়ি হিসেবে জামদানির ব্যবহার শুরু ব্রিটিশ আমলে। যার জনপ্রিয়তা শীর্ষে ওঠে পঞ্চাশের দশকের শেষে। এ কদর অটুট থাকে ষাটের দশকজুড়ে। একাত্তরের পর বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থায় রং আর সুতার দুষ্পাপ্র্যতার পাশাপাশি বাজার সংকোচনের ফলে জামদানি শাড়ি তৈরিতে ভাটা পড়ে। আশির দশকে এর আকর্ষণ পুনরুদ্ধার হয়, যা আজ অব্দি ঊর্ধ্বমুখীই বলা চলে।
নকশা হচ্ছে জামদানি শাড়ির প্রাণ। অতীতে পাখির পালকের মতো হালকা, অতি সূক্ষ্ম আর স্বচ্ছ এই শাড়িতে ফুল বা বুটি—যে নকশাই তোলা হোক, তা যেন পানির ওপর ভেসে থাকার মতো মনে হতো। যে নকশা সাধারণ কাগজে এঁকে নেওয়া হতো না, জামদানিশিল্পীরা মন থেকেই চিন্তা করে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তুলতেন শাড়ির জমিনে। শাড়ির সাধারণ টানা-ভরনার অতি সূক্ষ্ম, স্বচ্ছ সুতার জমির ওপর একটু মোটা সুতা দিয়ে নকশাগুলো ফোটানো হয়। জামদানিতে সাধারণত ফুল, লতা, গাছ, বুটি আর জ্যামিতিক নকশার প্রাধান্য বেশি। নকশা অনুযায়ী চিহ্নিত হতো শাড়ির নাম। শাড়িজুড়ে পান্নার মতো ছোট ছোট হাজার বুটি দেওয়া শাড়ি পান্না হাজার নামে পরিচিত ছিল। বুটিদার শাড়িতে থাকত ছোট ছোট ফুলের নকশা। ফুলওয়্যারের বিশেষত্ব সোজা সমান্তরাল রেখা ধরে ফুলের সাজানো নকশা। কোনাকুনি নকশা হলে তার নাম আবার তেরেসা। শাড়ির পাড়ে ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুলতা, গোলাপচর, কাটিহার, কলকা পাড়, কাঠ পাড়, আঙুরতলা ছিল জনপ্রিয়। শাড়ির জমিনে গোলাপফুল, জুঁইফুল, পদ্মফুল, তেসরা, কলার ফানা, আদার ফানা, সাবুদানা, মালা ছিল তখন জামদানিপ্রেমীদের অন্তঃপ্রাণ। এ নকশা আঁকার কোনো পদ্ধতি নেই। শুধু শিল্পীদের মুখস্থ বুলিই ছিল সূত্র।
‘হইরে বাড়ে
গ্যাডে বাড়ে
গ্যাডের খেও বাধে গ্যাডে
গ্যাডের খেও বোধে প্যাচে
প্যাডে বাড়ে’।
টাঙ্গাইল শাড়ি
এ শাড়ি তৈরি হতো টাঙ্গাইলের বাজিতপুর ও পাথরাইলের বিশেষ শ্রেণির তাঁতির হাতে। বংশানুক্রমে কাজ করে আসা এই অঞ্চলের তাঁতিদের সৃষ্টিতে সুস্পষ্ট বাংলার শাশ্বত রূপ। সরু, মোটা, ডুরে কাটা, নানান চমকপ্রদ রঙের সঙ্গে টুকটুকে লাল আর গাঢ় ঘিয়ে রঙের মিশেল তো বাঙালি আবেগকে উসকে দেয়। টাঙ্গাইলের শাড়িতে হাতি, শঙ্খ, মাছ, পাখা, পাখির চিত্রল—এগুলো হচ্ছে আদিকালের নকশার মোটিফ। সম্প্রতি সংযোজন ঘটেছে শঙ্খ, ঘট, কলকা ইত্যাদির। নকশার ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের শাড়িতে কিছুটা জামদানির প্রভাব মেলে, বিশেষ করে জমিনে অলংকৃত বুটির কাজে। এই শাড়ির ডিজাইন বা অলংকরণে যে বিশেষ দিক লক্ষণীয়, তা হলো পাড়ের ডিজাইন এবং তার সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে রঙিন সুতার সাহায্যে জমিনের ডোরা কাটা নকশা। অতীতে এই শাড়ির পাড় অলংকরণের জন্য ব্যবহৃত হতো পাকানো সুতা। বর্তমানে এই দোতার সুতার সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে রেয়ন, আর্ট সিল্ক, কৃত্রিম আর মেটালিক জরি।
রাজশাহী সিল্ক
এর মাখন-মসৃণ জমিনের পরতে পরতে আভিজাত্য পরিস্ফুট। টলেমি, প্লিনি প্রমুখ প্রাচীন লেখকের ভাষ্য চীন রেশমের আদিবাস। কিন্তু জেমস টেলর আবার ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী। তার অনুমান, রেশম উদ্ভাবনের গৌরব বাংলাদেশের। এর যথার্থতা প্রমাণের দলিল-দস্তাবেজও কম নেই। এই উপমহাদেশে চীনের পাঁচ হাজার বছর আগের সাহিত্যে রেশমি-পশমি বস্ত্রের উল্লেখ মেলে। রামায়ণ, মহাভারত, মনুসংহিতায় এর নাম পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও রেশমি এ বস্ত্রের বহুবার উল্লেখ আছে। অগ্নিপাট, কাঞ্চাপাট, কলাপাট, তসর প্রভৃতি নামে। পট্টবস্ত্রও কিন্তু পাটের শাড়ি নয়, ছিল রেশমি শাড়ি। আইন-ই-আকবরীতে জানা গেছে, ঘোড়াঘাট রেশম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। টমাস বাউরির ‘আ জিওগ্রাফিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব কান্ট্রিজ রাউন্ড দ্য বে অব বেঙ্গল, ১৬৬৯ টু ১৬৭৯’ বইয়ের অনুচ্ছেদে এ দেশে রেশম বস্ত্রের ব্যবহারের প্রাচুর্যের কথা বলা হয়েছে। সে শতাব্দীর পরিব্রাজক বার্নিয়ারের ভাষ্যেও উঠে এসেছে একই কথা। ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থে জানা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে যশোর রেশম উৎপাদনে খ্যাতি লাভ করেছিল। এ ছাড়া রেশম হচ্ছে ফার্সি শব্দ। এর বাংলা নাম গরদ। কৌষেয়, পট্ট, অংশপট্ট, কীট্টতন্তু, কীটজ প্রভৃতি নামে সংস্কৃত গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর কোনোটার সঙ্গেই চীনের নামের কোনো মিল নেই।
কালের পরিক্রমায় ইংরেজ কোম্পানির অত্যাচারে এ দেশের বয়নশিল্পের যে ক্ষতি হয়, তা সমানভাবে কার্পাস ও রেশমশিল্পের ওপর বর্তায়। ১৯৪৭ সালের পর এর পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে সেরিকালচার বোর্ড স্থাপিত হয়। সামগ্রিকভাবে বিশেষজ্ঞদের মত, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রাজশাহী সিল্কের ভাগ্য খোলতাই হয়। অতীতে সিল্কের জন্য গুটি পোকাই ছিল ভরসা। একটা রাজশাহী সিল্ক শাড়ির জন্য প্রায় ছয় হাজার গুটি পোকার প্রয়োজন পড়ত। পোকা থেকে সুতা তৈরি হতো দুই পদ্ধতিতে। এর মধ্যে কাটঘাট হচ্ছে সনাতন প্রক্রিয়া। কাঠের তৈরি সুতার মেশিনে। আর মেশিন রিলিং হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতি। সিল্ক মূলত দুই জাতের—দেশি ও সংকরিত। দেশিটার রং হলদে, যা খারি করে নিলে ক্রিম হয়ে যায়। এর চাহিদাই বেশি। রাজশাহী সিল্কের শাড়ি ও সুতার নব্বই ভাগ তৈরি হতো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট ও শিবগঞ্জ এলাকায়। ভোলাহাট তো রাজশাহী সিল্কের ম্যানচেস্টার নামেও পরিচিত ছিল। এ ছাড়া মিরগঞ্জ, নাটোর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, মানিকগঞ্জ আর ময়মনসিংহেও মিলত রাজশাহী সিল্ক এবং তাঁতে তৈরি শাড়ি।

দায়-স্বীকার:
আবরণে-আভরণে ভারতীয় নারী—চিত্রা দেব
শাড়ির ইতিহাস—মালা দত্ত রায়
শাড়ি—হোসনে আরা শাহেদ
বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)—নীহাররঞ্জন রায়

মডেল: বিদ্যা সিনহা সাহা মিম
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সানায়া কুটর
জুয়েলারি: রঙবতী
স্টাইলিং ও ফ্যাশন ডিরেকশন: মাহমুদুল হাসান মুকুল
ছবি: সালেক বিন তাহের

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top