skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I ধরিত্রী ধমনি

অগুনতি গ্রহ-নক্ষত্রে গড়া এই সৌরমণ্ডল। তবু পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও বাসযোগ্য জায়গা নেই মানুষের। নেই অন্য কোনো প্রাণসত্তারও; বিজ্ঞান অন্তত এমনটাই বলে। এই ধরিত্রীমাতার প্রতি আমরা আর কত অবিচার, অনাচার করব

পৃথিবী। মানুষের বাসযোগ্য একমাত্র গ্রহ। অগুনতি কাল ধরে এর বুকে অসংখ্য প্রাণের বিচরণ। তাই সৃজনশীল অনেকে একে জননী অভিহিত করেন। মাদার আর্থ, ধরিত্রীমাতা…আরও কত আদুরে শব্দবন্ধনে ডাকা হয়। শুনতে মধুর লাগে। কিন্তু সবচেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন সন্তান হিসেবে এই জননীর প্রতি আমাদের দায়ভার কি আমরা ঠিকঠাক পালন করছি? খালি চোখেই মেলে জবাব—না! কালে কালে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে যত দুর্যোগের কারণে ধুঁকতে হয়েছে, এর কোমল বুক যতবার হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত এবং এখনো হচ্ছে, তার নেপথ্যে শুধু প্রাকৃতিক কারণগুলোই নয়, মানবসৃষ্ট ঘটনাগুলোও রেখেছে এবং রেখে চলেছে বড় ভূমিকা। আর তা স্বভাবতই নেতিবাচক, বলা বাহুল্য। তাই মানুষসহ সকল জীবন্ত সত্তার জন্য পৃথিবী তার বুকে সাজিয়ে রেখেছে যে মমত্বের বাগান, তাতে ঝড় বয়ে যাচ্ছে হরদম; আর তা শেষ পর্যন্ত মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকির হুংকার ছড়াচ্ছে।

দুই
২২ এপ্রিল ১৯৭০। ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলোর রাস্তায় নেমে এসেছিলেন প্রায় দুই কোটি মানুষ। মানবসৃষ্ট কারণে পরিবেশের যত ক্ষতি হচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানাতে। তাদের এমন ব্যতিক্রমী ও সময়োপযোগী প্রতিবাদকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতেই দিনটিকে আর্থ ডে বা ধরিত্রী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে জাতিসংঘ। করবে নাই-বা কেন, বিজ্ঞান বলে, পৃথিবী এই মহাবিশ্বে একমাত্র নভোমণ্ডলীয় স্থান, যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। এখানে তালিকাভুক্ত প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। যদিও তা মোট প্রাণীর একটি সামান্য অংশ বলেই ধারণা করা হয়। কেননা, ২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা ধারণা দিয়েছিলেন, প্রাকৃতিক বিশ্বে সব মিলিয়ে প্রায় ৮৭ লাখ প্রজাতির বিচরণ রয়েছে। সকল প্রাণসত্তার জীবনধারণ নিরাপদ রাখার আহ্বান ছড়িয়ে দেয় ধরিত্রী দিবস।

তিন
পৃথিবীকে ধাপে ধাপে বিপৎসংকুল করে তোলার পেছনে মানব-আবিষ্কৃত উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিক। সহজে পচনশীল নয়, ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই অপচনশীল এই উপাদানের বহুল ও যাচ্ছেতাই ব্যবহারের কারণে ধরিত্রীমাতার এখন নাভিশ্বাস। বিজ্ঞান বলে, শুধু মানবসভ্যতাই নয়, যেকোনো প্রাণসত্তার জন্যই প্লাস্টিক এক ভয়াবহ ত্রাস! কেননা, এটি মাটি তথা পৃথিবীর সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে বাধাগ্রস্ত করে। আর ফাস্ট ফ্যাশনের এ যুগে, জীবনচর্চায় প্লাস্টিকের পণ্য একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার কারণে এই দূষণ বাড়ছে হু হু করে। তাই প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই তো ধরিত্রী দিবসের এবারের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্লানেট ভার্সাস প্লাস্টিক’।

চার
এই গ্রহকে বাসযোগ্য রাখতে ধরিত্রী দিবস পালনের গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বায়ুদূষণ—বিবিধ কারণে আমাদের বাসযোগ্য বাস্তুতন্ত্র ইতিমধ্যে নানা দুর্ভোগে জর্জরিত। সময় একেবারেই ফুরিয়ে যাওয়ার আগে যদি যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষে বুকভরা নিশ্বাস গ্রহণ আরও দুরূহ হয়ে উঠবে। এই সচেতনতা বাড়িয়ে তোলার আহ্বান জারি রাখে দিবসটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোটাদাগে চারটি বিষয়ে ধরিত্রী দিবসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এর শুরুতেই আসে জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গ। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশদ জানানো হয়, বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি যেভাবে উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে, তা আমাদের এই গ্রহকে এমন এক মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেমনটা সুপ্রাচীন বরফযুগের শেষকাল থেকে, অর্থাৎ গত সাড়ে ১১ হাজার বছরে আর কখনো দেখা যায়নি। জলবায়ুর উষ্ণায়নের কারণে গবেষকেরা বরফের মহাদেশখ্যাত অ্যান্টার্কটিকায় মমি করা ডালপালার সন্ধান পেয়েছেন। বিবিসির প্রতিবেদনসূত্রে জানা যায়, এ ধরনের মমি করা ডালপালা বস্তুত সেই শেষ সময়ের ইঙ্গিতবাহী, যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের অভিন্ন সমাবেশ ঘটেছিল, ফলে অ্যান্টার্কটিকায় অঙ্কুরিত হতে এবং জীবনধারণ করতে পেরেছিল উদ্ভিজ্জরাজি। বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা জোরের সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের অভ্যস্ত পরিবেশ-পরিমণ্ডলে এমন তীব্র নেতিবাচক পরিবর্তন আসবে, যেখানে প্রাণ বাঁচানো কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না। বাকি তিনটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বন নিধন, পানির ঘাটতি ও বায়ুদূষণ। আতঙ্কের কথা, ২০০০ সাল অবধি সাব-সাহারান আফ্রিকান ফরেস্টের একটি বিরাট অংশ বিনাশ করে ঘটানো হয়েছে কৃষি উন্নয়ন। আমাদের দেশেও প্রতিনিয়ত কমে আসছে বনাঞ্চল ও গাছের সংখ্যা। অন্যদিকে, পৃথিবীর ৭১ শতাংশই যেখানে পানি দিয়ে গড়া, সেখানে সুপেয় পানির অভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে, যা বিস্ময়কর হলেও সত্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, দুনিয়াজুড়ে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মানুষের সামনে দূষিত পানি পানের কোনো বিকল্প নেই! আর বায়ুদূষণের কথা তো বলাই বাহুল্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীজুড়ে শহুরে অধিবাসীদের ৯০ শতাংশই নিশ্বাসের মাধ্যমে টেনে নেয় চূড়ান্ত রকমের দূষিত বায়ু। এককথায়, বুঝে বা না বুঝে সবুজ পৃথিবীকে আমরা এক ভয়ানক ভবিষ্যতের সামনে হাজির করে দিয়েছি। তাই ধরিত্রীমাতাকে আশু যথাযোগ্য শুশ্রূষা দেওয়া একান্ত জরুরি।

পাঁচ
অগুনতি গ্রহ-নক্ষত্রে গড়া এই সৌরমণ্ডল। তবু পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও বাসযোগ্য জায়গা নেই মানুষের। নেই অন্য কোনো প্রাণসত্তারও; বিজ্ঞান অন্তত এমনটাই বলে। এই ধরিত্রীমাতার প্রতি আমরা আর কত অবিচার, অনাচার করব। মানবিক ও বিবেকবান প্রাণসত্তা হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত ধরিত্রীর জন্য ক্ষতিকর যেকোনো কার্যক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা। যথাসাধ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তবেই বাঁচবে মানুষ। আগামী প্রজন্মের জীবন হবে সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক।

সবার বোধোদয় হোক। সচল থাক ধরিত্রীর ধমনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top