ফিচার I ক্লিটসকাহিনি
কালো রঙের সুচালো বুট কিংবা ফুটবলের জুতা নান্দনিক ফুটবলের প্রধান এক অনুষঙ্গ। বিশ্বের সবচেয়ে এ জনপ্রিয় খেলার সূচনা থেকে শুরু করে আধুনিক ফুটবলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই কালো বুট। যদিও নান্দনিক এই অনুষঙ্গ শুধু কালো রঙের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে আজ সাদা, লাল কিংবা সবুজের মতো হরেক রঙে রূপ নিয়েছে। তারপরও কালো রঙের জুতাটিই এখনো সবার অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।
কিন্তু ফুটবলের এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি কীভাবে এলো, তা অনেকেরই অজানা। এবার ফুটবলের বুটের বিবর্তনের ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক একঝলকে।
ইতিহাসের প্রথম বুট পায়ে দেওয়া ব্যক্তিটি অবশ্য কোনো পেশাদার ফুটবলারের নাম ছিল না। তিনি হলেন ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি। এটা আশ্চর্যজনক যে বিয়ে থেকে শুরু করে শিকার, রাজকীয় অনুষ্ঠান আর সবশেষ ফুটবল, রাজার পায়ে শোভা পেত ১৫২৬ সালে রাজকীয় পোশাকশালা থেকে সরবরাহ করা এই জুতা।
জুতাটি তৈরি করা হয়েছিল চামড়া থেকে এবং হাতে সেলাই করে। আর এর নির্মাতা ছিলেন কর্নেলিয়াস জনসন, যাকে মূল্য হিসেবে দেওয়া হয়েছিল মাত্র চার শিলিং। ওই সময়ে রাজা হেনরির ফুটবলের প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা ছিল না। কারণ, তখনকার সময়ে এটা ভদ্রলোকের খেলা বলে বিবেচিত ছিল না। তখন ফুটবল মানে ছিল কিছু নিয়ম আর অসংখ্য ফাউল।
এর তিন শ বছরের বেশি সময় পর ইংল্যান্ডে ফুটবল খেলা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর সে সময়ে একটি কারখানার শ্রমিকেরা লম্বা ফিতার ফুটবল বুট তৈরি করতেন। এ বুট পায়ে দিয়ে খেলার সুবিধা ছিল, এটার নিচে নখের মতো অংশ ছিল। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়েরা খুব সহজে কাছে ঘেঁষতো না বল চুরির জন্য।
এর ফলে ১৮৬৩ সালে ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বুটের নিচে নখের মতো বিপজ্জনক অংশটি বুট থেকে বাতিল করে।
১৮৮০ সালের শেষ দিকে চামড়ার বোতামের বস্তু সকার বুটের নিচে লাগানো শুরু হয়। ১৮৯১ সালে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তাদের রুল বইতে উল্লেখ করে যে, ফুটবলের জুতায় আধা ইঞ্চির বেশি কোনো চামড়া কিংবা ধাতব বস্তু থাকতে পারবে না। সে সময়ের এই জুতাই এখন সবার কাছে সকার বুট নামে পরিচিত।
ফুটবল বুটের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসে ১৯২০ সালে। এবং ওই সময়ে কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের জুতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তৈরি করা শুরু করে। এ শিল্প পুরোপুরিভাবে পরিবর্তন হয় ১৯২৪ সালে যখন অ্যাডল্ফ এবং রুডল্ফ ড্যাসলার ভ্রাতৃদ্বয় মিলে জার্মানির হার্জোগেনারাচে জুতার কারখানা স্থাপন করে।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম জুতাটি অবশ্য বরফের মধ্যে খেলা ববসেøডারের জন্য প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু ড্যাসলার ভ্রাতৃদ্বয়ের একজন অ্যাডল্ফ যিনি অ্যাডি নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি ফুটবলকে ভালোবাসতেন। এর ফলে দ্রুতই ফুটবলের জন্য উন্নত মানের জুতা তৈরি শুরু হয়, যা ছিল আবহাওয়া উপযোগী।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সকার বুট নৈপুণ্যবর্ধনের চেয়ে খেলোয়াড়ের নিরাপত্তার জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে ফুটবল খেলা পরিবর্তন হয়, যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি অনুসারে জুতার ডিজাইনেও ভিন্নতা আসে।
ওই সময়ে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে সুন্দর ফুটবল সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ছন্দ আর পায়ের কারিকুরি ফুটবলের আলাদা স্থান দখল করে যা ‘জাগো বনিতো’ নামে পরিচিতি পায়। এতে হালকা এবং পায়ের সঙ্গে সহজে মানিয়ে যায় এমন জুতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, এর আগে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের খেলোয়াড়েরা খালি পায়ে খেলতেই অভ্যস্ত ছিল এবং সেভাবেই বেড়ে উঠেছিল। যেখানে ইউরোপে ওই সময়ে বুটের ব্যবহার বেশ পরিচিত ছিল।
এ নাটকীয় পরিবর্তনগুলো ফুটবল বুট তৈরিতে প্রভাব ফেলে। কিন্তু ডেসলার ভ্রাতৃদ্বয় ১৯৪৮ সালের দিকে তাদের ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটায়। দুই ভাইয়ের মতে মিল না হওয়ায় তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় এবং দুটি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। যার আলাদা মালিকানায় ছিলেন দুই ভাই।
অ্যাডল্ফ প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাডিডাস, যা তার নামের সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়। অন্যদিকে, আরেক ভাই রুডল্ফ একই শহরে প্রতিষ্ঠান করেন পিউমা। মাঠের প্রতিযোগিতাও এত বড় ছিল না যতটা না ছিল দুই ভাইয়ের ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতা।
১৯৫০ সালের শুরুর দিকে দুই ভাইই দাবি করেন, তারা প্রথম সকার বুটের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। কিন্তু অ্যাডি ১৯৫৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে জুতার নতুন বৈশিষ্ট্য এনে অ্যাডি তার ভাইকে ছাড়িয়ে যান।
গ্রুপ পর্বে হাঙ্গেরির কাছে ৮-৩ গোলে হারা পশ্চিম জার্মানি ফাইনালেও একই প্রতিপক্ষের কাছে ছিল বড় আন্ডারডগ। ওই সময়ে আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে অ্যাডি ড্যাসলার জার্মান দলের জন্য কালো রঙের নিচে চামড়ার স্পাইক দেওয়া বুট তৈরি করেন। আর তাতেই বাজিমাত। আন্ডারডগ জার্মানি ফাইনালে হাঙ্গেরিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায়। জার্মানির এ জয় ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে মিরাকল হিসেবে এখনো স্মরণীয়।
হালকা, বেশি নমনীয় এবং বেশি বল নিয়ন্ত্রক কালো সকার বুট ওই সময়ে প্রস্তুতের পর্যায়ে ছিল কিন্তু ফাইনালে অ্যাডির লক্ষ্য ছিল জার্মান দলের জন্য ভালো জুতা তৈরি। তিনি সেটা পেরেছিলেন এবং তার কারণেই ওই সময়ের আন্ডারডগ জার্মানি তাদের প্রথম বিশ্বকাপ জয় করে।
এরপরে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ৭৫ শতাংশ খেলোয়াড় অ্যাডিডাসের তৈরি বুট পরে মাঠে নামে, যেখানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পিউমার বুট পরেন শুধু ব্রাজিলের পেলে।
১৯৭০ সালের সকার বুটের আরও বড় বাজার সৃষ্টি হয়। পিউমার বুট পায়ে খেলা ব্রাজিলের পেলে ওই বছর তার দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন সদ্যই তৈরি করা পিউমা কিং পরে।
হামেল ছিল তখনকার সময়ের প্রতিষ্ঠান কিন্তু তারা সচরাচর বুট তৈরি থেকে দূরে থেকে কালো বুটের ঐতিহ্য ভেঙে দেয়। জার্মান প্রতিষ্ঠানটি ওই সময়ে এভারটনের অ্যালান বল এবং ডার্বি কাউন্টির অ্যালান হিনটনকে তাদের বুট পরার জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন। এর পরপরই বিভিন্ন রঙের বুট তৈরি শুরু হয়।
১৯৭৯ সালে অ্যাডিডাস কোপা মুন্ডিয়াল নামের বুট প্রচলন করে যা কিনা সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বুট। এটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারুর চামড়া।
কোপা মুন্ডিয়াল, পিউমা কিং কিংবা অন্যান্য সকার বুট কৃত্রিম ঘাসের মাঠে খেলার মতো উপযুক্ত ছিল না। ফলে পরবর্তী সময়ে উন্নত মানের রাবার বুট তৈরির দিকে মন দেয় অনেক প্রতিষ্ঠান।
ইতালিয়ান প্রতিষ্ঠান ডায়াডোরা ১৯৭৭ সালের বুট তৈরি শুরু করে। এরপর ১৯৮০ সালে আমব্রো প্রথম ইংলিশ কোম্পানি হিসেবে বুট তৈরি শুরু করে। একই সময়ে সকার বুট তৈরি শুরু করে ইতালির লোটো এবং স্পেনের কেলমে।
বছরজুড়ে সবার দৃষ্টি ছিল আরও হালকা এবং বেশি নমনীয় সোলের বুট তৈরির দিকে। কালো বুটের চেয়ে আরও বেশি ভালো বুট তৈরি করতে গিয়ে ১৯৮০ সালে সাবেক খেলোয়াড় ক্রেইগ জনসন ভালো নিয়ন্ত্রণ এবং পছন্দের শট দেওয়ার জায়গা আছে এমন বুট খোঁজা শুরু করেন। এ ধরনের বুট শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে অ্যাডিডাস প্রচলন করে, যার নাম ছিল ‘অ্যাডিডাস প্রিডেটর’।
ড্যাসলার ভ্রাতৃদ্বয়ের সকার বুট তৈরির পর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে যখন নাইকি বুট তৈরি শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিগনের প্রতিষ্ঠানটির দৃষ্টি ছিল রানিং শুর দিকে। কিন্তু তারা এটি সকার বুটের দিকে নিয়ে যায় এবং একটি মাইলফলক তৈরি করে।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ সামনে রেখে তারা নাইকি টিয়েম্পো নামের বুটের প্রচলন করে এবং বড় দলগুলোকে তা ব্যবহারের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে যাদের মধ্যে ছিল ওই আসরের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। এ ছাড়া পাওলো মালদিনির মতো সেরা খেলোয়াড়কে তারা চুক্তিবদ্ধ করেছিল নিজেদের বুট পরতে।
এরপর আসে সাদা রঙের বুট। ১৯৯৫ সালে ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানের মার্কো সিমনে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালের অ্যাজাক্সের বিপক্ষে প্রথম এই রঙের বুট পরে মাঠে নামেন।
১৯৯৮ সালে নাইকি তাদের মারকারিয়াল বুট প্রচলন করে। এর পুরোটাই ছিল সিনথেটিকের তৈরি এবং ওজন ছিল মাত্র দুই শ গ্রাম।
গত বিশ বছরে সকার বুটের ক্ষেত্রে দুটি বড় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। একটি হলো কতটা স্টাইলিশ এবং অপরটি হলো ওজনে কতটা হালকা করা যায় তার প্রতিযোগিতা।
১৯৯০ সালের শেষ দিকে ঐতিহ্যবাহী স্টাডসের জায়গায় বুটের নিচে ব্লেডের প্রচলন হয়। এতে করে বুটের দৃঢ়তা আরও বাড়ে। প্রস্তুতকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ব্লেডের কারণে কৃত্রিম ঘাসে সকার বুট বেশি কার্যকর হয়।
যদিও স্টাডস ডিজাইন এবং এর ভিন্নতা খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যে বড় ভূমিকা রাখে। তারপরও প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল ওজন কমানোর দিকেই বেশি নজর দেয়। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে সকার বুটের ওজনও কমে আসে। যেখানে ১৯২০ সালে বুটের ওজন ছিল ২০ আউন্স, সেখানে বর্তমানে এসে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি বুটের ওজন মাত্র ৬ আউন্স। এর সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সও বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক।
প্রদীপ দেবনাথ
ছবি: সংগ্রহ