skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I সৌদিতে সিনেমার মজমা-বিধান রিবেরু

[শেষ কিস্তি]

পরদিন, ১০ নভেম্বর ২০২৪, তেমন কাজ নেই। বাকি কেবল সমাপনী অনুষ্ঠান। অবশ্য শেষ দিন হলেও নির্ধারিত আলাপ, সেমিনার ও স্ক্রিনিং চলবে। আমরা কয়েকজন ঠিক করলাম, দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে হালকা শপিং করব। এরই ভেতর বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করেছে। যেমন মাঝরাতেই অনেকে হোটেল ছেড়েছেন, ভোরেও। আমি যখন সকালে নাশতার টেবিলে, ততক্ষণে মারসেলো, এলেনা, হোশেম—ওরা হয় বিমানবন্দরে, নয়তো ইতিমধ্যে উড়াল দিয়েছেন। দেখা হলো কেবল বোজিদার ও পাওলার সঙ্গে।

রিয়াদে মরুর বুকে সূর্যাস্ত

দুপুর নাগাদ হোটেল রুমে গড়াগড়ি ও লেখালেখি করে, খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা কয়েকজন বেরোলাম শপিংয়ে। আমার সঙ্গে পাওলা, ডিয়ানা ও ওলা। রিয়াদের একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে গিয়ে কেনাকাটা সারার পর ওরা বললেন, হোটেলে ফিরবেন, এরপর শহর ঘুরতে বের হবেন। আমি বললাম, শেষ দিন ভেন্যুতে না গেলেই নয়। তা ছাড়া ছবি দেখাবে, সেটাও দেখব। কাজেই হোটেলে ফিরে শুধু জিনিসপত্র রুমে রেখে নামতেই দেখি গাড়ি প্রস্তুত। আমার মতো ভেন্যুতে যাবেন মাদাগাসকার থেকে আসা রাতসার এবং আরেকজন ভদ্রমহিলা। দ্বিতীয়জনের সঙ্গে প্রথম দিন পরিচয় হলেও ভুলে গেছি। বললাম, ‘তোমার সঙ্গে ঠিকঠাক পরিচয় হয়নি।’ জানালেন, তার নাম ডেরিন আজাও; থাকেন নাইজেরিয়ায়। কালো কুচকুচে বিনুনি করা চুল দুলিয়ে ডেরিন বললেন, ওর কিন্তু আমাকে মনে আছে। নাইজেরিয়া শুনেই বললাম, নলিউড তো বেশ ভালো করছে আফ্রিকান অঞ্চলে। কমার্শিয়ালি খুব সাকসেসফুল ইন্ডাস্ট্রি।
‘লায়নহার্ট’ (২০১৮) ছবিটার কথা বললাম। ডেরিন বললেন, ‘তুমি এটা দেখেছ?’ ‘হ্যাঁ, ফ্যামিলি ড্রামা জনরার ছবি।’ ওদের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে এরপর অনেক কথাবার্তা হলো। বললেন, ভিডিওগ্রাফির যুগে ওদের ইন্ডাস্ট্রি বুম করে। খুব সস্তায় একটি প্রোডাকশন তৈরি করা যায়। মূলত ড্রামা, কমেডি, রোমান্স দিয়েই ওরা বাজার মাত করেছেন প্রথম। চলচ্চিত্র মুক্তির দিক থেকে বিশ্বে বলিউডের পর নলিউড দ্বিতীয়। নব্বইয়ের দশক থেকে নলিউডের উত্থান শুরু। এখন এই ইন্ডাস্ট্রিকে বলা হয় আফ্রিকার কালচারাল ও ইকোনমিক পাওয়ার হাউস। আমাদের বাংলাদেশ নিয়েও ডেরিন জানতে চাইলেন। বললাম, গোটা কয়েক বাণিজ্যিক ছবি, দুই-একটা মধ্যমা (মিডল) সিনেমা আর স্বাধীন চলচ্চিত্র ছাড়া এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ঝুলিতে তেমন কিছু নেই। তবে আমরা ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব করে আসছি প্রায় তিন দশক ধরে। এই উৎসবের ব্যাপারে ডেরিন শুনেছেন।
রাতসার পুরো আলাপটাই শুনলেন। আমরা আবিষ্কার করলাম, তিনজনই আজ ভেন্যুতে যাচ্ছি ‘স্কেলস’ (২০১৯) ছবিটি দেখার জন্য। পৌঁছে দেখি, ছবি শুরু হয়ে গেছে। আমরা বসলাম, শাহাদ আমীন পরিচালিত ছবিটি দেখার জন্য। সাদাকালো চলচ্চিত্র। আরব অঞ্চলের এক জেলেপাড়ার গল্প। হায়াত নামের একটি মেয়ে ধীরে ধীরে মাছে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। পরিবার ও জেলে নৌকায় এক আবদ্ধ জীবন কাটাচ্ছিল হায়াত। একপর্যায়ে সমুদ্র শুকিয়ে যায়। কিন্তু হায়াত যখন পুরোপুরি মৎস্যকন্যা হয়ে উঠল, তার চোখের পানিতে আবার ভরে উঠল শুষ্ক ভূমি। হায়াত সাঁতার কেটে চলে গেল মুক্ত পরিবেশে। ডিসটোপিয়ান গল্পটি আমার মন্দ লাগেনি। ডেরিনকে একটু দ্বিধান্বিত দেখলাম। জানতে চাইলেন, আমি কিছু বুঝতে পেরেছি কি না। বললাম, যতটুকু বুঝেছি, এই ছবি নারী স্বাধীনতার কথা বলছে। এর মুক্তি ২০১৯ সালে। আর সৌদিতে ২০১৮ সাল থেকে নারীরা স্বাধীনতা পেতে শুরু করেছেন। রূপকধর্মী ছবি। ডেরিনও একমত হলেন।
এই ছবি শেষ করে ঠিক করে রেখেছিলাম একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখব। মাঝে একটু সময় পেয়ে লাউঞ্জে বসেছি। এ সময় আমার পাশে এসে বসলেন মার্কিন একাডেমিক আলিয়া। ওর কথা আগেও বলেছি, ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত। আলিয়াকে বললাম, ওমর আমিরালাই পরিচালিত ‘এভরিডে লাইফ ইন আ সিরিয়ান ভিলেজ’ (১৯৭৪) ছবিটি দেখব একটু পর। বললেন, এই ছবি নিজের ক্লাসরুমে বহুবার চালিয়েছেন; কাল্ট মুভি, ক্লাসিক। খুবই ভালো প্রামাণ্যচিত্র। ওর কথা শুনে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। আমি গুটিগুটি পায়ে স্ক্রিনিং হলের দিকে এগোলাম। চারদিকে কেমন বিদায়ের সুর। তবু আরব মরুতে ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রসংগীত তার আনন্দবার্তা দিয়ে চলেছে। নাইজেরিয়ার ডেরিনও আমার সঙ্গে ঢুকলেন। ছবি শুরু হলো। প্রামাণ্যচিত্রটিতে একটা ধ্রুপদি ঢং রয়েছে। সিরিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী, কৃষক, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ—এদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক ছবিটি দেখতে দেখতে আপনি সিরিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে বাধ্য।
১৯৬৩ সালের ৮ মার্চ সিরিয়ায় আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি-সমর্থিত সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। সেই ক্যুদেতাতের পর ওমরের এই ছবিই প্রথম সমালোচনা হাজির করে, কৌশলে, সরকারের কৃষি ও ভূমি সংস্কারনীতি নিয়ে। নির্মাতা ওমর প্যারিসে পড়ালেখা করতে যান ১৯৬৬ সালে। চার বছর পর দেশে ফিরে ছবিটি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ছবিটির ভেতর যেভাবে কনটেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে সাউন্ডট্র্যাক ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। কৃষকের দুরবস্থা, আধুনিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবকে বাতাসের হু হু শব্দ অথবা গ্রামীণ বাঁশির সুর যেন আরও বাস্তব করে তোলে। ভালো লাগল ছবিটি।
শেষ দিন ডেরিন, রাতসার ও আয়িন ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না। কারণ, অর্ধেক লোক বাড়ির পথ ধরেছেন, অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর দু-একজন গেছে রিয়াদের কিংডম টাওয়ারে। আমি চিন্তা করলাম, সম্মেলনে এসেছি, শেষ দিনটি উপস্থিত না থাকলে চলে না। তাই সমাপনী দিনে দুটি ছবি দেখলাম অন্তত। পরে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছবি দুটির কথা লিখলাম। পাওলা রিপ্লাই দিয়ে বললেন, ‘স্কেলস’ ছবিটি ভেনিস ক্রিটিকস উইকে দেখানো হয়েছিল। পাওলা জুরি ছিলেন। বললেন, ভালো ছবি। আমার কাছেও মনে হয়েছে, রূপকধর্মী ছবিটি মন্দ নয়। তবে একটা বিষয় মনে উঁকি দিয়ে যায়, এই যে নারী স্বাধীনতা নিয়ে এত সৌদি চলচ্চিত্র হচ্ছে, এগুলো আবার সরকারের অ্যাজেন্ডাভুক্ত নয় তো? অবশ্য হলেও সমস্যা দেখি না। প্রপাগান্ডা ছবি মানেই খারাপ বা বাজে—এই চিন্তারও সীমাবদ্ধতা আছে।

ফিপ্রেসির ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ শাওকির সঙ্গে লেখক

বের হওয়ার আগে শেষবারের মতো পুরো ভেন্যু ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখি, এত দিন অনেক কিছুই আবিষ্কার করা হয়নি। যেমন শিশুদের জন্য আলাদা জোনটাতে ঢোকাই হয়নি। প্রদর্শনীটি দেখা হয়নি। গিফট শপে ঢোকা হয়নি। গিফট শপে ঢুকে একটা টড ব্যাগ কিনতে চাইলাম। ভেতরে থাকা তরুণী বললেন, ‘স্যার, এটা উপহার, আপনাদের জন্যই রাখা।’ বিনে পয়সায় একখানা সুন্দর ঝোলা পেলাম, এফসিসির নামাঙ্কিত, বেশ সুন্দর। এরপর অদূরেই একটি খোলা জায়গায় দেখলাম আরব বাদক ও গায়ক দল। তারা ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র বাজিয়ে গান গাইছে। ডেরিন আর আমি কিছুক্ষণ গান শুনে বহির্গমনের দিকে পা বাড়ালাম। এর আগে বিদায় নিলাম শাওকির কাছ থেকে। দায়িত্বে থাকা ছেলেমেয়েগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আজ বাংলাদেশি ভাইটিকে খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। যাহোক, গাড়ি চলতে শুরু করল হোটেলের দিকে। ফিরতি পথে চলচ্চিত্রবিষয়ক নানাবিধ কথার ফাঁকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে দিলাম ডেরিনকে।
হোটেলে ফিরে দেশে কথা সেরে সোজা বিছানায়। পরদিন সারা দিনই ফ্রি। ঠিক করে রেখেছিলাম, সারা দিন লিখব। সকালে উঠে নাশতা সেরে লিখতে বসেছি, দেখি ফাতিমা বার্তা পাঠিয়েছেন, আমাকে নিয়ে রিয়াদে ঘুরতে চান। বললাম, ‘লিখতে বসেছি, এখন উঠব?’ ফাতিমা লিখলেন, ‘কেন? খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?’ ভাবলাম, খুব একটা ক্ষতি হবে না; কিন্তু যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ লিখব সারা দিন, তাই লিখবই। বেচারা ফাতিমাকে হতাশ করতে হলো। ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বুঝিয়ে বললাম। কী বুঝলেন জানি না; নিজেই সরি-টরি বললেন, আমাকে জোর করার জন্য।
শেষ দিনটায় যেন সময় কাটতে চাইছে না। দুপুরে হোটেলের বুফেতে খেতে গিয়ে দেখি, কেউ নেই আমাদের দলের। কেবল ভারত থেকে আসা দুজন বসে আছেন। একজন রীতা দত্ত, আরেকজন ভিকে জোসেফ। জোসেফ এই সম্মেলনে কথা বলেছেন গুরু দত্তের ছবি ‘পিয়াসা’ (১৯৫৭) নিয়ে। আর রীতা বলেছেন ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় মিউজিক্যাল ফিল্মের বিবর্তন নিয়ে। ওনাদের সঙ্গে শেষ দিন আর কথা হয়নি। পরে অবশ্য রীতা আমার কাছ থেকে একটা লেখা চাইলেন, ভারতীয় এক ওয়েবসাইটের জন্য। কথা দিলাম, দেব।
১২ নভেম্বর রাত পৌনে দুটায় ফ্লাইট। কাজেই রাত দশটায় হোটেল ছাড়তে হবে। সব গুছিয়ে নিচে এসে বসেছি। দেখি এক বাংলাদেশি তরুণ এগিয়ে আসছেন: ‘স্যার, আপনাকে শুরু থেকে দেখছি, কিন্তু ব্যস্ত বলে কাছে আসিনি।’ ছেলেটির নাম রায়হান। জানালেন, ওর বাবাও সৌদিতে কাজ করেন, জেদ্দায়। পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। গাড়ি ব্যবস্থাপকদের কাছ থেকে, রায়হানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম বিমানবন্দরের দিকে। রাতের রিয়াদ সর্বদাই প্রাণোচ্ছল, আলোঝলমলে। নগরের গণ্ডি পেরিয়ে দেখলাম, একটু একটু করে বিরানভূমি উঁকি দিচ্ছে। অন্যান্য দেশে বিমানবন্দর সাধারণত শহর থেকে একটু দূরেই হয়। ঢাকার মতো নয়। রিয়াদের কিং খালিদ বিমানবন্দরে যেতে যেতে মনে হলো, এই মরুর নিশি আমার পাঁচ দিনের স্মৃতিকে বালিচাপা দিয়ে সযতনে রেখে দিয়েছে। বিদায় বেলায়, আরব্য রজনীতে মনে পড়ল রবিকে: ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি/ আরব বেদুয়িন!/ চরণতলে বিশাল মরু/ দিগন্তে বিলীন।/ ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি,/ জীবনস্রোত আকাশে ঢালি/ হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি/ চলেছি নিশিদিন।’

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top