skip to Main Content

মনোযতন I ভণিতায় ভোগান্তি

ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডার। অসুস্থতার ভান করে অন্যদের তো বটেই, নিজের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। এই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা চেনার এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় সন্ধান করেছেন আশিক মুস্তাফা

সোশ্যাল মিডিয়া জ্বরে আমরা প্রায় সবাই আক্রান্ত এখন। এখানে কতজনে কতভাবেই না অন্যদের নজর কাড়ার চেষ্টা করেন। বাস্তব জীবনের কথা না হয় বাদই দিলাম! এই যে নজর কাড়ার প্রতিযোগিতা, এর চোখে চোখ রেখে আপনি ধরেই নিতে পারেন, একজন মানুষ দুই রকমভাবে মারা যেতে পারে! প্রথমত মানসিকভাবে; দ্বিতীয়ত শারীরিকভাবে।
মানুষমাত্রই শারীরিকভাবে মরণশীল, সে তো সবাই জানি। কিন্তু মানসিকভাবে মানুষ কখন ও কীভাবে মারা যায়, ভেবে দেখেছেন? এমন মৃত্যুর অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে এবং তা আছেও। তবে মূল কারণ হলো, একজন মানুষ যখন নিজের কাছে নিজে আর জবাবদিহি করতে পারেন না, তখনই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান। এর প্রধান কারণ নিজেই। একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে কোনো কোনো মানুষ নিজেই নিজের পরম শত্রুতে পরিণত হন—কথাটা অবাস্তব মনে হলেও সত্য। এমন পরিস্থিতিতে তিনি শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেও এক অর্থে মৃতই!
নিজেই নিজের শত্রু হয়ে যাওয়ার ক্রিয়া-কর্ম-প্রক্রিয়া নানাভাবে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। এর মাধ্যমে আবার অনেকে অন্যের নজর কাড়ার চেষ্টাও করেন হন্য হয়ে। এই যে নজর কাড়ার তাড়না; তা যখন কাউকে ভয়াবহ রকমে তাড়িয়ে বেড়ায়, তখন যদি তিনি নিজের শরীর নিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন, ভাবতে হবে সেই মানুষ ভয়াবহ মানসিক ব্যাধির পথে হাঁটছেন। কিংবা ব্যাধির গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন!
শরীর নিয়ে খেলা এমনই এক মানসিক ব্যাধির নাম ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডার। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের শরীরের ওপর অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটান। পরিবার, সমাজ কিংবা প্রিয়জনের নজর কাড়ার জন্য বারবার অসুস্থ হওয়ার ভান করেন তিনি। এ জন্য নিজেই নানাভাবে নিজেকে অসুস্থ করে তোলেন। এটি এমনই এক মানসিক ব্যাধি, যার ফলে একজন ব্যক্তির মাঝে বারবার অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার ইচ্ছা কাজ করে। এমনকি তিনি চিকিৎসা নেওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছায় নিজেকে অসুস্থ করে তোলেন। আবার কখনো কখনো হাসপাতালে যাওয়াার জন্য অসুস্থতার ভান করেন; মিথ্যা বলতে থাকেন। তবে মজার বিষয়, এ ধরনের রোগীরা চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মেডিকেল টার্মগুলো সম্পর্কে বেশ ভালো জ্ঞান রাখেন! এ জন্যই তারা খুব সহজে কোনো না কোনো রোগের ভান ধরতে পারেন। এদের রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য নিজেদের যেকোনো ধরনের ক্ষতি করে ফেলতে পারেন, যা অনেক সময় মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে তাদের।
ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডার কী
নিজেকে নিয়ে ভয়াবহ ফাঁদ পাতা এই রোগীরা যেই রোগে আক্রান্ত, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেটি ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডার। ‘ফ্যাকটিসিয়াস’ শব্দটি লাতিন; যার অর্থ, ‘মানুষের তৈরি’। তার মানে বুঝতেই পারছেন, রোগটি রোগী নিজেই নিজ শরীরে তৈরি করেন; নিজের একান্ত ইচ্ছাতেই!
এটি এমন এক মানসিক রোগ, ফলে একজন ব্যক্তি বারবার অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে চান। শুধু তা-ই নয়, এরা রোগের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য ইউরিন পরীক্ষায় অন্যের ইউরিনকে নিজের বলে চালিয়ে দেন! শরীরে ফোড়া বা ক্ষত তৈরি করতে নানা উপায় অবলম্বন করেন। এমনকি মলদ্বারে ইনজেকশন দিয়েও নানা রোগের লক্ষণ তৈরি করতে পারেন।
হাসপাতালের জন্য মায়া
ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অসুস্থতার ভানসহ যেকোনো কাণ্ড ঘটাতে পারেন। তাই একে মুঞ্চউসেন সিনড্রোম বা হাসপাতাল আসক্তি ব্যাধিও বলা হয়। আগেই বলেছি, এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মেডিকেল টার্মগুলোর ওপর ভালো জ্ঞান থাকায় এরা সহজে যেকোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভান ধরতে পারেন। আর তারা নিজেদের ভয়াবহ অসুস্থ বোঝাতে পরিবারের লোকদের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে দিতে পছন্দ করেন না। শুধু তা-ই নয়; এরা যেকোনো অসুখকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তুলে নিজেকে ছুরি-কাঁচির নিচে সঁপে দিতেও দ্বিধা করেন না। এদের রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য নিজেদের যেকোনো ধরনের ক্ষতি করে ফেলতে পারেন, যা অনেক সময় তাদের অকালমৃত্যু ডেকে আনে।

কারণ সন্ধান
ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডারের মূল কারণ মনোবিজ্ঞানীদের কাছে এখনো অজানা। তবে শৈশবের কোনো শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিকতা এবং প্রচণ্ড মানসিক আঘাতকে রোগটির রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মনোজগতে এ রোগ হানা দেওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ কাজ করতে পারে।
 চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি তীব্র রোমাঞ্চ অনুভব করা এবং মনোযোগ ও যত্ন আকাঙ্ক্ষা থাকা।
 চিকিৎসা পেশায় যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে প্রতারণাকে নিজের একধরনের সাফল্য মনে করা।
 পরিবারের অন্য সদস্যদের চাপে রাখতে মনে ভালো লাগা কাজ করা।
 শৈশবে অযত্নে বড় হলে যত্ন পাওয়ার বাসনা লালন করা।
 অতীতের কোনো অপরাধের জন্য নিজেকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে যাওয়া।
 শৈশবে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার রেশ থাকা।
 শৈশবের ইতিহাস অস্থির বা অস্বাভাবিক হওয়া।
 আত্মবিশ্বাস কম থাকা এবং নিজেকে সামাজিক বৈষম্যের শিকার গণ্য করা।
 প্যারেন্টিং ত্রুটিযুক্ত এবং সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া।
 কেউ কেউ স্বভাবগতভাবে অকারণেই এমনটি করে থাকতে পারেন।
 পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, ইমপালস কনট্রোল ডিজঅর্ডার, ওসিডি, ডিমেনশিয়া, মাদকাসক্তিসহ বেশ কিছু সমস্যার লক্ষণ হিসেবেও এমন আচরণ প্রকাশ পেতে পারে।
ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রতি ক্ষেত্রে নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। এ জন্য তৈরি করেন নানা জটিলতা। তবে এ রোগে আক্রান্তরা অসুস্থ ব্যক্তির ভূমিকা বজায় রাখার অনিয়ন্ত্রিত তাড়না অনুভব করেন, যা একধরনের আচরণগত আসক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
সমাধানের উপায়
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক এবং নিউরোলজিস্ট হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডারকে মোটেই ইতিবাচক ভাবা যাবে না। অনেকের ক্ষেত্রে এটা খুবই বিপজ্জনক। তবে এর চিকিৎসার আগে রোগী আসলেই এতে আক্রান্ত কি না, তা শনাক্ত করা চাই। এ ক্ষেত্রে স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; যেমন সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট অথবা ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কারের দ্বারস্থ হওয়া জরুরি। তারা ভুক্তভোগীর আচরণগত মূল্যায়ন, পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা পারিবারিক চিকিৎসা ইতিহাস থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সম্ভাব্য লক্ষণগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে এই রোগী শনাক্ত করেন। শনাক্তের পরেই নিতে হবে চিকিৎসা। তবে রোগীর অবস্থাভেদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, কীভাবে তার কাছ থেকে ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডার দূর করা সম্ভব। তারা হয়তো কাউন্সেলিংয়ের পথে হাঁটতে পারেন। সেই সঙ্গে সাইকোথেরাপির পথও ধরতে পারেন। তবে ফ্যামিলি থেরাপি এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের থেরাপি সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের মনোভাব ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে। এই থেরাপিউটিক সেটিংয়ে পরিবারকে ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণকে প্রশ্রয় না দেওয়ার বা পুরস্কৃত না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। পরিবার যদি এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে, তাহলে শুধু রোগীর চিকিৎসা করে সহজে সুফল পাওয়া প্রায় অসম্ভব।’
‘এ রোগের চিকিৎসায় আরেক কার্যকর পদ্ধতি হলো সাইকোথেরাপি। এই সেশনগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং তা বজায় রাখার ওপর ফোকাস করেন। এ ধরনের সম্পর্ক ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডারের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হতে পারে। মনিটরিং এমন একটি ফর্ম, যা ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডার রোগীর নিজের ভালোর জন্যও নির্দেশিত হতে পারে,’ যোগ করেন তিনি।
ডা. হিমু আরও বলেন, ‘ফ্যাকটিসিয়াস ডিজঅর্ডার একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়াবহ ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে, যদি তিনি প্রকৃতপক্ষে শারীরবৃত্তীয় অসুস্থতার ভেতর দিয়ে চলেন। এমনকি ফাঁদ পাতার জন্য শরীরে যে আঘাতগুলো করেন, যথাসময়ে অস্ত্রোপচার না করলে তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আবার হুটহাট অস্ত্রোপচারে গিয়ে তাদের জিতিয়ে দেওয়া যাবে না! এ জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক নজরদারি। আর যখন তিনি এমন আচরণ করেন, তা বুঝতে পেরেও তার আচরণে তাল দেওয়া যাবে না। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে হবে, যাতে তিনি নিজ আচরণ পরিবর্তন করেন কিংবা ওই পথ থেকে সরে আসেন।’
তবে রোগটি নির্ণয় হলে সমস্যা বেশি বাড়তে না দিয়ে, দ্রুতই বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা গ্রহণ করার ওপর জোর দিয়েছেন ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top