skip to Main Content

টেকসহি I সুনীল সমুদ্র সন্ধান

৮ জুন। ওয়ার্ল্ড ওশানস ডে। দেশীয় ও বৈশ্বিক সমুদ্র বাস্তবতার চিত্র জানাচ্ছেন সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু

এক বিশাল নীল রাজ্য, যেখানে সূর্যের আলো পানির গহিনে খেলে যায় অদ্ভুত ছন্দে, তিমির গান ছড়িয়ে পড়ে মাইলের পর মাইল। এই রাজ্য আমাদের চেনা হলেও এর গভীরতা, সৌন্দর্য ও রহস্য এখনো বহুলাংশে অচেনা। সমুদ্র শুধু প্রাকৃতিক নয়, এটি একান্তভাবে কাব্যিকও, যেখানে প্রাণ ও ইতিহাস মিলেমিশে হয়ে যায় একাকার। কিন্তু এই চেনা সমুদ্রেই আজ ফুটে উঠেছে বিপদের এক অচেনা মানচিত্র। অতিরিক্ত দূষণ, উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সমুদ্র আজ শুধুই বিস্ময়ের উৎস নয়; বরং বয়ে এনেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।
এই বাস্তবতায়, প্রতিবছরের ৮ জুন পালিত হয় ওয়ার্ল্ড ওশানস ডে বা বিশ্ব মহাসাগর দিবস। এই দিবস স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা যতই ভূপৃষ্ঠের বাসিন্দা হই না কেন, আমাদের নিশ্বাস, খাদ্য, আবহাওয়া, এমনকি জীবনের ধারাবাহিকতা গভীরভাবে নির্ভর করে আছে নীল মহাসমুদ্রের ওপর। সমুদ্র শুধু পরিবেশের অংশ নয়, এটি বাঁচিয়ে রাখে আমাদের অস্তিত্ব। তাই ৮ জুন কেবল সচেতনতার জন্য নয়, বরং দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতেও গুরুত্বপূর্ণ। যাতে আমরা এই বিপন্ন নীল রাজ্য রক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গড়ে তুলতে পারি টেকসই পৃথিবীর ভিত।
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত আর্থ সামিটে কানাডার প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মহাসমুদ্র দিবস ধারণাটির জন্ম। তবে জাতিসংঘ একে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ২০০৮ সালে। উদ্দেশ্য—বিশ্ববাসীকে সমুদ্রের ব্যাপারে সচেতন করা, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব বোঝানো এবং টেকসই ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো।
মহাসমুদ্র তথা যেকোনো সমুদ্রই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাদ্য, জ্বালানি, পরিবহন, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু দূষণ, অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মহাসমুদ্র এখন হুমকির মুখে। চলতি বছর বিশ্ব মহাসমুদ্র দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘সমুদ্র ও জলবায়ুর সুরক্ষায় পরিবর্তনের অনুঘটক হয়ে ওঠা’। যা সমুদ্র ও জলবায়ু সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে এবং এর গভীরে লুকিয়ে থাকা জটিলতা ও সম্ভাবনাগুলোকে আবিষ্কার করতে আমাদের আহ্বান জানায়। দিবসটি শেখায়, সমুদ্র শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; বরং এমন একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া, যার প্রতিটি ওঠানামা আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়।
জলবায়ুর সঙ্গে সমুদ্রের সম্পর্কও ওতপ্রোত। যার সঙ্গে জড়িত জেলেদের জীবন ও জীবিকা। প্রাচীনকালে বাঙালি জেলেরা বলতেন, ‘সমুদ্র যার, সম্পদ তার’। অথচ যুগে যুগে সমুদ্রকে দেখা হয়েছে শোষণের খনি অথবা সীমান্ত দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র হিসেবে। এই যেমন ইতিহাসের পাতা ওলটালে বেরিয়ে আসে পর্তুগিজদের বিভিন্ন নৌযুদ্ধের গল্প। আরও অসংখ্য যুদ্ধের গল্প তো আছেই। কিন্তু সময় বদলেছে। ৮ জুন যখন বিশ্বব্যাপী সমুদ্র দিবস পালিত হয়, তখন নতুন এক সম্ভাবনার কথাই উঠে আসে। যার নাম সুনীল অর্থনীতি কিংবা ব্লু ইকোনমি। এটি এমন এক ধারণা, যা আমাদের সমুদ্রসম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও জীবিকা নিশ্চিত করতে বলে।
বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল সমুদ্রসীমা নিয়ে এক সম্ভাবনাময় ‘ব্লু ফ্রন্টিয়ার’। ২০১২ ও ২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সমুদ্রের এই বিশাল মালিকানা বাংলাদেশের ঘরে এসেছে। তাই সকল সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতে এখন প্রয়োজন এই সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো।
ব্লু ইকোনমির মূল দর্শন পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন। ধারণাটি প্রথম তুলে ধরেন বেলজিয়ামের প্রফেসর গুন্টার পাউলি; যার লক্ষ্য কেবল মুনাফা নয়, বরং প্রকৃতি ও মানবিক ভারসাম্য রক্ষা করে সমুদ্রসম্পদ কাজে লাগানো। বিশ্বের মোট খাদ্যের ১৬, জ্বালানির ৩২ ও খনিজের ৪০ শতাংশ আসে সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশ ২০১২ ও ২০১৪ সালে বিরোধ নিষ্পত্তি শেষে একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকা অর্জন করে, যা দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বর্তমানে দেশের জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ আসে সামুদ্রিক সম্পদ থেকে, যা সুনীল অর্থনীতিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে শনাক্ত করছে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২৬টি সম্ভাবনাময় ব্লু ইকোনমি খাত চিহ্নিত করেছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মৎস্য ও চিংড়ি চাষ, জাহাজ নির্মাণ ও রিসাইক্লিং, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, সমুদ্র পর্যটন, খনিজ আহরণ, সমুদ্র পরিবহন, বায়ু ও জোয়ার-ভাটা ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন এবং সমুদ্রবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা। সরকারের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ব্লু ইকোনমি সেল এবং গৃহীত হয়েছে মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট, ২০১৮।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গৃহীত হয়েছে সুনীল অর্থনীতি কাঠামো তৈরির প্রকল্প এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমুদ্রসম্পদবিষয়ক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সব ঠিকঠাক চললে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমিকে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। তবে সম্ভাবনাময় খাতে চ্যালেঞ্জও বেশি থাকে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি, প্রযুক্তির অভাব, পর্যাপ্ত গবেষণা ও তথ্যের সংকট, আধুনিক সমুদ্রনীতির অভাব এবং সমন্বয়হীনতা উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা সমুদ্রসম্পদ বিষয়ে গবেষণা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা করবে—এই আশাই করা হচ্ছে।
সমুদ্র পৃথিবীর ২৫ শতাংশের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে চমৎকার এক প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটির বেশি মানুষের আমিষের উৎসও সমুদ্র। ২০৩০ সালের মধ্যে সমুদ্রভিত্তিক শিল্পে প্রায় ৪ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্র আজ রূপ নিচ্ছে ভিন্ন বাঁকে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে উপকূলীয় এলাকা। সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে প্রবাল প্রাচীরগুলো ধ্বংস হচ্ছে, সামুদ্রিক প্রাণী অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে, কিছু কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশে এই পরিবর্তনের প্রভাব আরও স্পষ্ট। সাইক্লোনের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে; লবণাক্ততা বেড়ে সংকট তৈরি হচ্ছে কৃষি ও পানীয় জলে। বাংলাদেশের প্রাণশক্তি সুন্দরবনের মতো অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদও আজ হুমকির মুখে।
পৃথিবীর ৭০ শতাংশ জুড়ে সমুদ্রের বিস্তার। এই বিশাল জলরাশির পৃষ্ঠতলের নিচে আছে তিমি, ডলফিন, হাঙর, অক্টোপাস, রঙিন প্রবাল, মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও কোটি কোটি অণুজীব। বিশ্বের সমুদ্রগুলো আজ আর শুধু রহস্যময়তা ও জীববৈচিত্র্যের আধার নয়; হয়ে উঠেছে প্লাস্টিকের ডাস্টবিন। ইউএনডিপির তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৩৩ বিলিয়ন পাউন্ড প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে, যা প্রতি মিনিটে ২ ট্রাকভর্তি আবর্জনার সমান। ভাসমান প্লাস্টিককে খাবার ভেবে গিলে ফেলছে সামুদ্রিক কচ্ছপ, ডলফিন ও সামুদ্রিক পাখির মতো প্রাণীরা; ফলে অকালমৃত্যু ঘটছে লক্ষ লক্ষ প্রাণের। শুধু প্রাণীরাই নয়, এই প্লাস্টিক শেষে ফিরে আসছে আমাদের খাবারের টেবিলে। মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়ে মাছের দেহে জমে থেকে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে, যার রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি। প্লাস্টিক দূষণ এখন আর শুধু পরিবেশগত ইস্যু নয়; এটি একটি মানবিক সংকট।
অবশ্য এই সংকটের মধ্যেও সমুদ্র রক্ষায় কিছু উদ্যোগ আশাজাগানিয়া। ডাচ উদ্ভাবক বোয়ান স্ল্যাটের ওশান ক্লিন আপ প্রকল্প প্লাস্টিক দূষণ কমাতে কার্যকরভাবে কাজ করছে। ইউ-আকৃতির প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ধীরে ধীরে বর্জ্য সরিয়ে পুনর্ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশবান্ধব মেরিটাইম নীতিমালা গ্রহণ, সুনীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ, ইকো-ট্যুরিজমে উৎসাহ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে মনোযোগ বেড়েছে। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সুনীল অর্থনীতির গুরুত্ব আরও বাড়বে। ফলে সমন্বিত পরিকল্পনা, গবেষণা, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে একটি কার্যকর উন্নয়ন কৌশলে রূপ দিতে পারে।
তাই সমুদ্রকে রক্ষা করতে নেওয়া চাই বৈশ্বিকভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ। যেখানে নিশ্চিত হবে আইন প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গবেষণাভিত্তিক প্রযুক্তির প্রয়োগ। সাগর-মহাসাগর বাঁচলে তবেই টিকবে মানবজাতি; আর তাতেই অটুট থাকবে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top