skip to Main Content

মনোযতন I ড্যাডি ইস্যু

জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস। মানুষের জীবনে বাবার উপস্থিতি কখনো আশ্রয়, কখনো অদৃশ্য এক শাসন। কখনো কখনো বাবাকে ঘিরে কারও কারও মনে ভর করে ভয়ানক ভীতি; যা ড্যাডি ইস্যু নামে পরিচিত। সেই ভয়ের মানচিত্র খোঁজার আর তা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় জানাচ্ছেন সুবর্ণা মেহজাবীন

নির্ভরতা আর নিশ্চয়তার নাম হওয়া উচিত যার, সেই ‘বাবা’ নামক মানুষটার আশপাশে এলেই পাঁচ বছর বয়সী রাফির চোখে আতঙ্ক ভেসে ওঠে। চুপ হয়ে যায় সে। মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। সামান্য ভুল হলেই জোটে ধমক, কোনো দিন চড়, আবার কোনো দিন ঠান্ডা গলায় শুনতে হয় ভয়ংকর এক বাক্য—‘তুই কিছুই পারবি না!’ রাফি এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। শিক্ষক বলছেন, সে কারও সঙ্গে কথা বলে না, নিজের মতামত প্রকাশ করতে চায় না; তার চোখে সব সময় একটা অদ্ভুত লেগে থাকে। মা হয়তো কিছুটা বুঝতে পারেন, তবু চুপ থাকেন। কারণ, ‘বাবা মানেই ভয়’—এই বিশ্বাস তো আমাদের সমাজের গভীরে বসে আছে বহুকাল ধরে।
ঘরের ছায়াতেই দগ্ধ শৈশব
বাড়ির ছাদ, তার ছায়া আর সেই ছায়ার নিচে আশ্রয়—এই শব্দগুলো সাধারণত নিরাপত্তা ও স্নেহের অনুভূতি জাগায়। কিন্তু সেই আশ্রয় যদি হয় শাসনের নামে আতঙ্ক তৈরি করা এক পিতা, তাহলে তা ডেকে আনতে পারে নির্মম অভিজ্ঞতা। অনেক সন্তানই বাবাকে শ্রদ্ধার চেয়ে ভয় পায় বেশি। এই ভয় শুধু শারীরিক শাস্তির কারণে নয়; মানসিক চাপ, অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং আবেগহীন আচরণের মাধ্যমেও জন্ম নেয়। শিশুর চোখে বাবা যদি এক ‘শক্তিমান’ অথচ ভালোবাসাহীন রূপে থাকেন, তাহলে সেটি একদিকে অনুপ্রেরণা হতে পারে, অন্যদিকে রূপ নিতে পারে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক জটিলতার উৎসে।
ব্যাধির বীজ কি এখানেই
বাবাকে ভয় পাওয়া কোনো নির্দিষ্ট মানসিক রোগ নয় ঠিকই; তবে যদি এই ভয় দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং দমনের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তা নানা রকম মনোরোগের জন্ম দিতে পারে। বাবার সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে যদি ভয় কাজ থাকে, তাহলে শিশু তার অতি প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার জায়গা হারিয়ে ফেলে। এই অনিরাপত্তা থেকেই তৈরি হয় নানা কগনিটিভ ডিসটরশন; মানে, শিশুটি নিজেকে ভুলভাবে মূল্যায়ন করতে শুরু করে। যেমন ‘আমি ব্যর্থ’, ‘আমি কিছুই পারি না’, ‘আমাকে কেউ ভালোবাসে না’ ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিং-এর শিশু ও কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হুমায়রা শাহজাহান হৃদি বলেন, ‘শিশু যদি বাবাকে ভয় পায়, সেই ভয় তাকে আত্মপ্রকাশে বাধা দেয়। সে নিজের ভুল বলতে, নিজের চাওয়াগুলো প্রকাশ করতে ভয় পায়। এভাবে একজন শিশুর ভেতরের দুনিয়া ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে।’
ভয়ে চুপ
যখন শিশুর মনে শৈশব থেকেই বাবার প্রতি ভয় জন্ম নেয়, তখন তার প্রথম যে জিনিস হারিয়ে যায়, তা হলো আত্মবিশ্বাস। নিজের মতপ্রকাশ করতে না পারা, আবেগ দেখাতে সংকোচবোধ, সৃজনশীলতার অভাব—সবই এই ভয়ের জালে গাঁথা। এই ভয় শিশুর মধ্যে সামাজিক সংকোচ তৈরি করে, যার কারণে সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে ভয় পায়। যেকোনো চ্যালেঞ্জকে সামনে পেতে চায় না; মনে মনে গেঁথে নেয়—‘আমি পারব না’ ধরনের আত্মপ্রতারণামূলক বিশ্বাস। ডা. হৃদি জানান, বাবা যদি শিশুর সামনে নেতিবাচক কথা বলেন কিংবা অপমানসূচক শব্দ ব্যবহার করেন, সেগুলো শিশুর মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়। এই ভয় একসময় এমন স্তরে পৌঁছায়, যেখানে শিশুর আবেগ, অনুভূতি সব চেপে বসে। সে নিজের ভুল স্বীকার করতে শেখে না, প্রয়োজন বোঝাতে পারে না, এমনকি ভালো লাগা প্রকাশেও কুণ্ঠা বোধ করে।
ট্রমা বিস্তার
এই অভিজ্ঞতা মনোরোগ চিকিৎসায় অ্যাডভার্স চাইল্ডহুড এক্সপেরিয়েন্স (এসিই) নামে পরিচিত। যখন কোনো শিশু আবেগগত, মানসিক কিংবা শারীরিক দমন-নির্যাতনের মধ্যে বড় হয়, তা তার মস্তিষ্কের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর প্রভাবে তৈরি হয় আবেগীয় ভারসাম্যহীনতা, আচরণগত সমস্যা, এমনকি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার প্রবণতা। ভয় থেকে তৈরি হওয়া এই মানসিক ক্ষত তাকে পরিণত বয়সে বিষণ্নতা, সমাজবিমুখতা, এমনকি আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
প্যাসিভ অ্যাগ্রেশন
ডা. হুমায়রা শাহজাহান হৃদি জানান, বাবার রাগ ও প্রভাবে সন্তান যখন চুপ করে যায়, তখন তার ভেতরে জমে থাকে একধরনের প্যাসিভ অ্যাগ্রেশন। বাইরে থেকে শান্ত আর ভদ্র মনে হলেও ভেতরে জমে থাকা সেই ক্ষোভ একদিন অন্যভাবে বেরিয়ে আসে। বাবার আদেশ না মানা, ইচ্ছাকৃত ভুল করা কিংবা সম্পর্ক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া—সবই হতে পারে সেই নীরব প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ। অনেক সময় বাবা-মা সেটিকে বেয়াদবি ভেবে ভুল করেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, সেটিই ওই শিশুর আত্মরক্ষার কৌশল। সমস্যা হলো, এই দমিয়ে রাখা ক্ষোভ বড় হয়ে অনেক সময় সহিংস রূপ নেয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে হঠাৎ রেগে যাওয়া, সম্পর্ক ধ্বংস, এমনকি শারীরিক হিংস্রতায়।
প্রজন্মগত ছায়া
এই সমস্যা শুধু শৈশবেই সীমাবদ্ধ থাকে না। যেসব শিশু শৈশবে বাবার ভয় আর নির্যাতনের মধ্যে বেড়ে ওঠে, তারা বড় হয়েও সেই ছায়া থেকে মুক্ত হতে পারে না। বন্ধু, জীবনসঙ্গী, এমনকি নিজের সন্তানের সঙ্গেও তারা সম্পর্ক গড়তে ভয় পায়। যার কারণে অনেক সময় তারাও পরবর্তীকালে নিজের সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত কঠোর কিংবা পুরোপুরি উদাসীন হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ আবার সেই সন্তানও পড়ে যায় মানসিক অনিরাপত্তার আবর্তে। এভাবেই এক প্রজন্মের ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে পরের প্রজন্মে। একে বলে জেনারেশনাল ট্রমা, যা প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা মানসিক ক্ষত।
তিরস্কারেও বিপদ
বাবা যদি শিশুকে নিয়মিত বকা দেন, তার ছোটখাটো ভুলকে বড় করে তুলে উপহাস করেন, নিজের হতাশা বা ক্ষোভ তার ওপর চাপিয়ে দেন, তাহলে শিশুটি মনে করে—‘আমার কিছুই ঠিক না।’ এর মধ্য দিয়ে তার ভেতরে জন্ম নেয় আত্মতুচ্ছ বোধ, যেখানে সে বাস্তবতা বিচার না করেই নিজেকে অযোগ্য ভাবতে শেখে। এই আত্ম-অবিশ্বাস কেবল মনে নয়, আচরণেও পায় প্রকাশ। কখনো সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়, কখনো হঠাৎ রেগে ওঠে, আবার কখনো নিজের প্রমাণ দিতে গিয়ে হয়ে পড়ে আত্মঘাতী বা অস্বাভাবিক। ডা. হুমায়রা হৃদি বলেন, ‘শিশুর সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়তে হবে, যেখানে সে জানবে—ভুল করলে ভালোবাসা কমে না; বরং বুঝবে, ভুলটা শেখারই একটা ধাপ।’
গবেষণার তথ্য
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, সাড়ে সাত হাজার শিশুর মধ্যে যারা ৩ বছর বয়সে হস্টাইল প্যারেন্টিং বা প্রতিকূল অভিভাবকত্বের শিকার হয়েছিল, ৯ বছর বয়সে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল দেড় গুণ বেশি। এসব সমস্যার মধ্যে ছিল উদ্বেগ, আক্রমণাত্মক আচরণ, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মহত্যার প্রবণতা। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) বলছে, শুধু শারীরিক শাস্তিই নয়, বাবা যদি শিশুর প্রতি সহানুভূতিশূন্য হন, নিয়মিত চিৎকার করেন কিংবা আবেগ প্রকাশে বাধা দেন, তবু তা শিশুটির মানসিক স্থিতিশীলতায় বড় ক্ষতি বয়ে আনে। এমন শিশু ভবিষ্যতে শুধু মানসিক রোগেই ভোগে না; কর্মজীবন, সম্পর্ক, এমনকি আত্মপরিচয় নিয়েও অনিশ্চয়তায় পড়ে।
বাবারা এমন কেন
সব বাবাই এমন, বিষয়টি তা নয়; বরং উল্টো। তবু কিছু বাবা ঠিকই আছেন, যাদের কারণেই ড্যাডি ইস্যুর সূত্রপাত। এর প্রথম কারণ, সংস্কার। এখনো সমাজে প্রচলিত আছে, ‘বাবা মানেই রাগী; শাসন করলেই সন্তান মানুষ হয়।’ এই ভুল বিশ্বাস প্রজন্মের পর প্রজন্মে রপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অনেক বাবা নিজ ছোটবেলায় এ ধরনের আচরণের শিকার হয়েছেন; ফলে ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা জানেন না। তাদের ধারণা, ‘শাসন মানেই ভালোবাসা।’ তৃতীয় কারণ, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। অনেক বাবা জানেনই না, তার গলার জোর, চোখরাঙানি কিংবা হঠাৎ রেগে ওঠা সন্তানের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করছে।
সমাধান সন্ধান
এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরকার সচেতনতা ও আচরণগত পরিবর্তন। বাবা-মা দুজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য অথরিটেটিভ অথচ ইমপ্যাথেটিক প্যারেন্টিং, যেখানে নিয়ম থাকবে ঠিকই; তবে সঙ্গে আরও থাকবে সম্মান, ভালোবাসা আর সন্তানের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। বাবা যদি সন্তানের বন্ধু না-ই হন, অন্তত এমন একজন হওয়া চাই, যার পাশে সন্তান নিরাপদ বোধ করে। ভুল করলে বিচার নয়, ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সন্তানকে বোঝাতে হবে, ভুল করা মানেই শেষ নয়। তার চেষ্টা আছে, আর সে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। এমনটাই পরামর্শ দিয়েছেন ডা. হুমায়রা শাহজাহান হৃদি।
তিনি আরও জানান, শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা বাবা-মায়ের। শিশুর সামনে শক্ত না হয়ে মানবিক হতে পারলে সন্তানটির আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে। ভয় দিয়ে হয়তো সাময়িক নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব; কিন্তু তা সুফল আনবে না।
শিশুর চোখে বাবা একজন সুপারহিরো। কিন্তু সেই মহানায়ক যদি সব সময় রাগ, ধমক আর চুপচাপের মুখোশ পরে থাকেন, তাহলে সেই ছবিই শিশুটির মনে স্থায়ী হয়ে যাবে। পরে সেই ভয়টাই হয়ে দাঁড়াবে ভারী এক মানসিক বোঝা, যা সে বয়ে বেড়াবে জীবনজুড়ে। অথচ শিশুর চোখে বাবার মুখটা ভয়ের নয়, ভালোবাসার আশ্রয় হওয়াই কল্যাণকর।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top