skip to Main Content

রম্যরস I আপনার মূল্য কত -সুমন্ত আসলাম

ধরুন, কারও গালে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে আপনার। দু গালে হলে ভালো হতো, তবে আপাতত এক গালে হলেই চলবে। কিন্তু কাকে মারা যায়? এদিক-ওদিক তাকালেন, খুঁজে পেলেন না কাউকে। আরও কয়েকবার এদিক-ওদিক দেখলেন, তবু কাউকে পেলেন না আশপাশে। রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কিছু একটা ভাবতে লাগলেন আনমনে। হঠাৎ গাল চুলকাতে লাগল আপনার, বুঝতে পারলেন, বাঁ গালে একটা মশা বসেছে। আপনি কিছু করার আগেই একটা থাপ্পড় পড়ল আপনার গালে। চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলেন, আপনার স্ত্রী দাঁড়িয়ে। চেহারাটা কঠিন করে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে; এতে অকস্মাৎ থাপ্পড় খাওয়ায় কঠিন রূপান্তরিত আপনার চেহারা কেমন সরল হয়ে গেল, কিছুটা আলাভোলাও। আপনার স্ত্রী চেহারাটা আরও কঠিন করে বলল, ‘একটা মশা বসেছে গালে, রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে গেছে, তবু মারার নাম নেই! নিজের গালের মশাও মারতে পারো না তুমি!’
মুখটা হাসি হাসি করে আপনি বললেন, ‘নিজের গাল তো! আচ্ছা, মশাটা মারতে পেরেছ?’
‘না। মাঝে মাঝে নিজের গালে নিজেকেই মারতে হয়, না হলে অন্যরা মেরে যায়!’
বাজারে গিয়েছিল স্ত্রী, ব্যাগটা রিকশায় তুলে বাড়ির দিকে চলে গেল। তার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন আপনি। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলেন, আরও একটা মশা বসেছে গালে। ঠাস করে গালে থাপ্পড় মারলেন। মশাটা মরেছে এবার। চ্যাপ্টা হয়ে লেগে আছে হাতের সঙ্গে।
আরও একটা নিশ্বাস ছাড়লেন আপনি, আর বুঝে গেলেন, নিজের গালে নিজেই থাপড়াতে হয়, তাতে কাজ হয়। অন্যে থাপড়ালে কাজ তো হয়ই না; বরং ব্যথা লাগে, অপমানও হয়।


বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে আজ। রাস্তাটা ফাঁকা, অন্ধকারও। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। এবড়োথেবড়ো পানি জমেছে এখানে-ওখানে। আগারগাঁওয়ের রাস্তাটা পার হতেই তিনটা ছেলে এসে হাজির হলো আপনার সামনে। ফুটপাতের কোনায় মোটা কড়ইগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল তারা, দেখা যায়নি।
তিনজনের মধ্যে লম্বাজন বলল, ‘আশা রাখি, আপনাকে সব খুলে বলতে হবে না। যা আছে বের করুন। কুইক।’
ছেলেটার মুখের দিকে ভালো করে তাকানোর আগে হাতের দিকে তাকালেন আপনি। রাতের আধো অন্ধকারেও বেশ ঝকঝকে দেখাচ্ছে ছুরিটা। নিজের পকেটে হাত দিলেন আপনি—মোবাইল, মানিব্যাগ দিয়ে দিলেন তাদের।
আপনার কাঁধের ব্যাগের দিকে তাকাল তারা। ওটা খুলে কিছু একটা বের করতে যাচ্ছিলেন আপনি, তার আগেই পুরো ব্যাগটা কেড়ে নেওয়ার মতো নিজেদের হাতের নিল একজন।
আপনার হাতের দিকে তাকাল তারা এবার। ঘড়িটা দিয়ে দিলেন তাদের।
নিঃশব্দে এসেছিল তারা, চলে গেল শব্দহীনভাবেই।
বিরস বদনে বাসায় ফিরলেন আপনি। আপনার চেহারাটা দেখে বউ মুচকি হেসে বললেন, ‘মন খারাপ? আজও ব্যাগটা অফিসে রেখে এসেছ, না? তুমি ইদানীং ভুলোমনা হয়ে গেছ! গোসল করার সময় আমাদের বিয়ের আংটিটা বেসিনে রেখেছিলে, গোসল শেষে ওটা আর নাওনি। পড়েও তো যেতে পারত বেসিনের ভেতর।’
মন খানিকটা ভালো হয়ে গেল আপনার। সোনার যা দাম, ৫০-৬০ হাজার টাকার সোনা আছে ওই আংটিতে। ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে, আংটিটা আজ পরে যেতে ভুলে গেছেন আপনি!
মাঝে মাঝে তাই ভুল করাও ভালো।


সন্ধ্যায় বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ। বউ বলল, ‘চলো না ছাদে যাই, ভিজি। কত দিন বৃষ্টিতে ভিজি না। গরমও যা পড়েছে, চলো, ভিজলে ভালো লাগবে।’
বউ হাত টেনে ধরল আপনার। কিছুটা অরাজি ছিলেন আপনি। হাতটা আরও একটু চেপে ধরল বউ, ‘চলো না, পাশের বাসার ভাবি আর ভাই তো বৃষ্টি হলেই ছাদে চলে যায়।’
পাশাপাশি দুই পরিবারের পারিবারিক তুলনা চলে আসার সম্ভাবনা আছে, তার আগেই ছাদে চলে গেলেন দুজন। আপনি যতটা না ভিজছেন, তার চেয়ে দেখছেন—একটা মেয়ের কী আনন্দ কেবল বৃষ্টিতে ভিজতে! সংসারে কত আনন্দ! আকাশের দিকে হাত তুলছে সে, দুদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে, মাথার চুলগুলো ঝাঁকিয়ে নিচ্ছে বারবার, খানিকটা নাচার ভঙ্গিও করছে একটু পরপর।
রাতে কেমন যেন অনুভব করতে লাগলেন আপনি—ম্যাজম্যাজ করছে শরীর, জ্বর জ্বর ভাব। মাঝরাতে জেঁকে বসল জ্বর। পরদিন আর অফিসে যাওয়া হলো না আপনার। সারা দিন বাসায় কাটালেন, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করলেন। বউ এটা বানিয়ে আনে, একটু পর আরেকটা বানিয়ে আনে। পাশে বসে গায়ে হাত রাখে, মাথার চুলে বিলি কাটে, দুচোখ আলতো বুলিয়ে দেয় হাতের আঙুলে।
কেমন নির্ভার লাগে আপনার! ফুরফুরে মনে হয় সময়। কত দিন এ রকম অলস অবকাশ কাটানো হয় না! চনমন করে ওঠে মন, ঝকঝকে হয়ে যায় চোখ, আয়েশি হয়ে যায় শরীর।
বউয়ের দুহাত নিজের দুহাতে চেপে ধরলেন। ভাবলেন—মাঝে মাঝে ছোটখাটো এমন অসুখ করা খারাপ কিছু না। পরস্পরকে সময় দেওয়া যায়, ভালোবাসাময় করা যায় খানিকটা জীবন!


চাররাস্তার মোড়ে ফুটপাতে অনেকগুলো দোকান বসেছে আজ। কেউ মুরগি নিয়ে বসেছে, কেউ হরেক রকম সবজি; কেউ শুঁটকি, কেউ কাঁঠাল। কোনায় একজন কচুশাক নিয়ে বসেছেন, মানুষটার বয়স বেশ বেশি রকমের বেশি।
বাজারে কত কী বিক্রি হয় ইদানীং। সেদিন লতা ধরনের সাদা একটা গাছ বিক্রি করলেন একটা মানুষ। গাছটা নাকি ডায়াবেটিসের জন্য খুব উপকারী। আরেক দিন কতগুলো হাড়-পা-ডানা দেখলেন একটা পাত্রে, ওগুলো কালো হয়ে যাওয়া তেলে ডোবানো। এগুলো নাকি বাতের ব্যথায় খুবই কার্যকর। বিক্রিও হলো বেশ।
মাথায় অন্য রকম একটা চিন্তা এসে গেল আপনার। পাশের দোকান থেকে সাদা একটা কাগজ কিনলেন, একটা কলম চেয়ে নিয়ে কিছু লিখে কাগজটা গলায় ঝোলানোর ব্যবস্থা করলেন। তারপর দাঁড়িয়ে পড়লেন ওই ফুটপাতের দোকানগুলোর পাশে।
মায়ের সঙ্গে আট-দশ বছরের একটা ছেলে যাচ্ছিল আপনার সামনে দিয়ে। স্কুলে যাচ্ছিল সে। আপনাকে দেখেই থমকে দাঁড়াল সে, হাত টেনে ধরল মায়ের। আপনার গলায় ঝোলানো প্রায় বুকের কাছে নেমে আসা কাগজটা দেখল ভালো করে। তারপর বলল, ‘এই কাগজে লেখা আছে—আমাকে বিক্রি করা হবে।’ আপনার আরও একটু কাছে চলে এলো ছেলেটা, ‘নিজেকে বিক্রি করবেন আপনি?’
কিছুটা গদগদ হয়ে মাথা উঁচু-নিচু করতে করতে আপনি বললেন, ‘জি।’
‘আপনার শরীরের মাংস কি খাওয়া যায়?’
‘না।’
‘আপনাকে দিয়ে কি ঘর সাজানো যাবে?’ মা জিজ্ঞেস করলেন।
‘না।’
‘আপনি কি বাড়ির কাজকর্ম; মানে ঘর মোছা, থালাবাসন ধোয়া, বাথরুম পরিষ্কারের কাজ করতে পারবেন?’
‘না।’
‘আংকেল, আপনি কি ড্রাইভারের কাজ পারেন? আমাদের একটা ড্রাইভার দরকার।’
‘না, আমি গাড়ি চালাতে পারি না।’
‘পুডিং কিংবা ফ্রুট কেক বানাতে পারেন?’
‘না, আমি কোনো কিছু রান্নাও করতে পারি না।’
‘অঁ।’ মা-ছেলে দুজনই প্রায় একসঙ্গে শব্দটা করে চলে গেল সামনের দিকে।
তিনটা ছেলে আর দুটো মেয়ে যাচ্ছিল আপনার সামনে দিয়ে। পাঁচজনই অদ্ভুত একটা হাসি দিল আপনাকে দেখে। মুখ থেকে চিবানো চুইংগাম বের করে একজন আপনার শার্টে লাগিয়ে দিল, একজন পেটে গুঁতো দিল বুড়ো আঙুল দিয়ে, একটা মেয়ে তো চোখ দুটো সরু করে বলেই ফেলল—সান্ডা সান্ডা।
বয়স্ক একটা মানুষ এসে সামনে দাঁড়ালেন আপনার। চমৎকার কোট-টাই পরেছেন, পায়ে ঝকঝকে কালো জুতো। সাদা ধবধবে চুলে ভরা পুরো মাথা। আলতো করে একটা হাত রাখলেন আপনার বাঁ কাঁধে, চাপ দিলেন মৃদু, দু ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি এনে বললেন, ‘মাই সান, তোমার দাম কত?’
‘জানি না।’
‘তুমি কত দূর পথ একা হেঁটেছ?’
‘খুব বেশি না।’
‘কখনো একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছ—গাছ আমাদের কত আপন?’
‘কখনো তেমন করে দাঁড়ানো হয়নি।’
‘এই বয়সে কতগুলো মানুষের কষ্টের সাথি হয়েছ?’
‘মনে করতে পারছি না।’
‘নিজেকে কখনো জিজ্ঞেস করেছ—তুমি কে?’
‘না।’
‘সম্ভবত এই জন্যই তুমি জানো না—তোমার মূল্য কত?’ বয়স্ক মানুষটা আরও একটু হাসলেন, ‘যদি নিজের মূল্যই না জানো, তাহলে নিজেকে বিক্রি করবে কীভাবে? মানুষ তোমাকে দামই-বা দেবে কীভাবে?’
ঘণ্টাদুয়েক পর আপনি দেখলেন, আপনার চারপাশে যেসব দোকানদার জিনিসপত্র নিয়ে বসেছিল, তারা সব বিক্রি করে ফেলেছেন, তারা চলে যাচ্ছেন। এমনকি ফার্মের মুরগির পা-ডানা নিয়ে যে মহিলা বসেছিলেন, তিনিও বিক্রি করে দিয়েছেন সব।
চারপাশ ফাঁকা, আশপাশে কেউ নেই।
এবং আপনি বুঝে গেলেন, অনুধাবন করলেন—এ পৃথিবীতে সবকিছুর দাম আছে, মরা গরুর চামড়ার দাম আছে, ভেঙে যাওয়ার পাতিলের দাম আছে, মরচে পড়া লোহার দাম আছে, কেবল আপনার দাম নেই, মানুষের দাম নেই!


সারা দিন পরিশ্রম করে বাসায় ফিরলেন আপনি—ক্লান্ত, অবসন্ন। দরজা খুলে দিলেন আপনার স্ত্রী। হাতের ব্যাগটা হাতে নিলেন তিনি। জামাটা খুলতে সহায়তা করলেন, তারপর ওটাও হাতে নিলেন। বাসায় পরার ড্রেসটা এগিয়ে দিয়ে বাকিগুলোও নিয়ে রেখে দিলেন যথাস্থানে। হাত-মুখ ধোয়ার কথা বলে চলে গেলেন কিচেনে।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে সোফায় বসতেই স্ত্রী আবার এসে হাজির, এক হাতে চা, আরেক হাতে পানি। ট্রেতে দুটো সবজির পাকোড়াও। পানি খেলেন আপনি, পাকোড়াও দিলেন মুখে। চায়ে চুমুক দিতেই আপনার পাঁচ বছরের মেয়েটা দৌড়ে এলো আপনার কাছে। দুপুরে ঘুমিয়ে ছিল সে। ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবান, তুমি কখন এসেছ?’ পাশ ঘেঁষে বসল আপনার, আরেক পাশে আপনার স্ত্রী। ঠিক ওই মুহূর্তে আপনি বুঝে গেলেন, জেনে গেলেন—পৃথিবীর আর কারও কাছে না হোক; আপনার স্ত্রী, আপনার সন্তানের কাছে আপনার মূল্য অসীম, জগতের সবকিছুর চেয়ে দামি, সবকিছুর মোট মূল্যের চেয়ে মূল্যবান।
দুহাত দিয়ে দুই আপনকে, প্রাণপ্রিয় স্ত্রী আর সন্তানকে জড়িয়ে ধরলেন আপনি, এবং টের পেলেন—চোখ দুটো ভারী হয়ে গেছে আপনার, ভিজে উঠেছে চারপাশ; সেই জল গিয়ে ঢুকল বুকে, ঠান্ডা হয়ে গেল অনন্ত বাস, গোপন হৃদয়!

ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top