যাপনচিত্র I পরিবারই পৃথিবী
শবনম বুবলী। ঢালিউডের জনপ্রিয় তারকা। চোখধাঁধানো সৌন্দর্য আর ভুবনমোহিনী হাসির অধিকারী এই অভিনেত্রীর একান্ত জীবন কেমন?
যেদিন শুটিং থাকে না, সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে দিন শুরু করেন তিনি। খানিকটা বিরতি দিয়ে পানি পান করেন দফায় দফায়। সকাল থেকেই একমাত্র সন্তান শেহজাদ খানকে নিয়ে সময় কাটে তার। নিজেই সন্তানকে স্কুলে দিয়ে এসে ৯টা-১০টার দিকে সারেন ব্রেকফাস্ট। মেনুতে থাকে পাতলা রুটি অথবা তেল ছাড়া পরোটা, ডিম অথবা শুধু ওটস। খাবারে অতিরিক্ত তেল এড়িয়ে চলেন। ব্রেকফাস্টের পর কোনো কাজ না থাকলে গৃহস্থালি টুকটাক কাজ নিজেই করেন।
অনেকের হয়তো জানা নেই, শবনম বুবলী বেশ ভোজনরসিক এবং পরিবার ও কাছের মানুষদের জন্য রান্না করতে পছন্দ করেন। বিদেশে বেড়াতে গেলে বিভিন্ন দেশের কুজিনের স্বাদ নিতে ভালোবাসেন। সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে ফিউশন রেসিপির প্রচেষ্টা থাকে তার। স্পাইসি স্বাদ পছন্দ করেন বলে খাবারের সঙ্গে কাঁচা মরিচ থাকা আবশ্যক। এমন স্বাদের জন্যই মেক্সিকান কুজিন বুবলীর বিশেষ পছন্দের। এ ছাড়া টার্কিশ, থাই, লেবানিজ ও দেশি কুজিন পছন্দ। মধ্যাহ্নভোজে পাতে রাখেন ভাত, স্পাইসি চিকেন, মাস্টার্ড অয়েল দিয়ে তৈরি আচারি বিফ, দেশীয় নানা ধরনের ভর্তা, ডালের মতো খাবার। অলস দিনে কঠোর ডায়েট মেইনটেইনের একদম পক্ষপাতী নন তিনি। রাতে অবশ্য ভাত এড়িয়ে চলেন; পাতে থাকে স্যালাদ ও স্টিমড ফিশ।
লাঞ্চের পর সন্তানকে নিয়ে আসতে স্কুলে যেতে হয়। সন্তানের স্কুল ছুটির আগে কফি পান করে অথবা অপেক্ষারত অন্যান্য অভিভাবকের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান। ক্লাস শেষের পর ছেলের রিডিং সেশনে অথবা প্লে গ্রাউন্ডে সময় দেন। বিকেল থেকে সন্ধ্যায় একেবারেই ‘মি টাইমে’ চলে যান বুবলী, যেখানে পুরোটা জুড়ে থাকে মুভি ওয়ার্ল্ড। ক্ল্যাসিক থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বিভিন্ন সিনেমা ও টিভি সিরিজ দেখেন। টার্কিশ সিরিজ বিশেষ পছন্দ। বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ ও ভাষার সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকেন। সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’, ‘রোমান হলিডে’ ও ‘দ্য নোটবুক’। পছন্দের অভিনয়শিল্পী অড্রে হেপবার্ন, কেট উইন্সলেট, টম ক্রুজ, রাসেল ক্রো, শাহরুখ খান, শ্রীদেবী, শাবানা, শাবনূর, সালমান শাহ, রাজ্জাক, জাফর ইকবাল, শাকিব খান প্রমুখ। অবসর সময়ে গান শোনেন মন-মর্জির ওপর ভর দিয়ে; তবে নব্বইয়ের দশকের ক্ল্যাসিক সফট-মেলোডিকে প্রাধান্য দেন। মেলডিক গিটার ও পিয়ানো ইনস্ট্রুমেন্টালও ভালো লাগে তার।
দেহযতনের ক্ষেত্রে ইয়োগা ফ্রিক বলা যায় তাকে। শুটিং থাকলে সকালে ৪০ মিনিট ইয়োগা সেরে নেন। বুবলী বলেন, ‘১৫ বছর ধরে ইয়োগা করছি, যা আমার শরীর নমনীয় এবং মন প্রশান্ত রাখতে সাহায্য করে।’ শুটিং বা বাড়তি ব্যস্ততা না থাকলে জিমে নিয়মিত যান; ট্রেডমিল, সাইকেল, ক্রসট্রেইনারের মতো ইনস্ট্রুমেন্টে বেসিক কার্ডিওর এক্সারসাইজ সারেন।
বুবলী ভ্রমণপিয়াসি। সময় পেলেই পরিবার নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন দেশ অথবা দেশের বাইরে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, তুরস্ক, ইতালি, সুইজারল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ ঘুরে দেখেছেন। বিশেষ পছন্দ যুক্তরাষ্ট্র; কেননা, সেখানেই তার সন্তান শেহজাদের জন্ম। এ ছাড়া সে দেশে একটি লম্বা সময় থেকেছেন তিনি। তাই মার্কিন মুলুকের সঙ্গে অনেক আবেগতাড়িত এবং পরিবারের সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর স্মৃতি রয়েছে তার। অন্যদিকে, কুজিনের জন্য থাইল্যান্ড এবং ইতিহাস বিজড়িত জায়গা হিসেবে ইতালি বিশেষ পছন্দ। জানালেন, তুরস্কের ইফতারের স্বতন্ত্র মেনু, বিশেষ করে কাবাব থেকে শুরু করে বিরিয়ানির মুখরোচক স্বাদ যেন এখনো লেগে আছে জিহ্বায়! ভ্রমণের জন্য নির্জন স্থানকে প্রাধান্য দেন তিনি। অন্যদিকে, সমুদ্রের তুলনায় পাহাড় তাকে অধিক টানে।
পোশাকের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড নিয়ে মাথা ঘামান না; প্রাধান্য পায় কমফোর্ট। শাড়ি, ওয়েস্টার্ন, সালোয়ার-কামিজসহ বিভিন্ন ড্রেসে দেখা যায় তাকে। তবে সালোয়ার-কামিজেই হাজির হন বেশি। অবশ্য বিশেষ কোনো উপলক্ষ থাকলে শাড়ি অথবা গাউন চাপান গায়ে। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে ট্রেন্ডে গা ভাসাতে এই তারকা নারাজ। সাদা অথবা হালকা যেকোনো রং প্রিয়। অর্নামেন্টসে মিনিমালিজমের পক্ষপাতী; তবে ফিংগার রিং প্রায়শই পরেন। ঘড়ি, পারফিউম, পার্স ও মেকআপের ক্ষেত্রে আছে পছন্দের ব্র্যান্ড। ঘড়ির ক্ষেত্রে কারটিয়ের, কোচ; পারফিউমে শ্যানেল, ডিওর অ্যাডিক্ট, গুচি; পার্সে এলভি, ভারসাচি; আর স্কিন ভালো রাখতে মেকআপের ক্ষেত্রে এসটি লাউডার, শ্যানেল ও ডিওর পছন্দ। বুবলীর হোম ইন্টেরিয়রে দেয়াল, ফার্নিচার, পর্দা—সবকিছুতেই সাদার আধিক্য। বাসায় ক্ল্যাসি ও ভিন্টেজের একধরনের ছোঁয়া ছড়ানো; দেয়ালজুড়ে চিত্রকর্ম।
সময় পেলে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা দেখতে পছন্দ করেন। প্রিয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ। ফুটবল বিশ্বকাপ এলে ব্রাজিলের পক্ষেই বাজি ধরেন। ফুটবলে স্পেন ও ইতালিরও সমর্থক তিনি। প্রিয় খেলোয়াড় ব্রাজিলের রোনালদিনহো, রোনালদো, কাফু ও রবার্তো কার্লোস। ব্রাজিল সমর্থন করলেও খেলা ও ব্যক্তি-স্বভাবের কারণে লিওনেল মেসির অনুরাগী তিনি।
বুবলী বললেন, ‘আমার তেমন কোনো সেলিব্রিটি ক্রাশ নেই। ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল ব্যারিস্টার হওয়ার। তখন থেকে আইনজীবীদের ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরন, ভাষণ পছন্দ।’ স্বপ্ন পূরণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে এমবিএ সম্পন্ন করে ভর্তি হন ব্রিটিশ স্কুল অব ল’তে; যদিও সেখানে পড়ালেখার অধ্যায় আর শেষ করা হয়নি। তবে জানালেন, সেখানে শিক্ষক হিসেবে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে পেয়েছিলেন, যিনি তার পছন্দের ব্যক্তিত্ব। এরও আগে থেকে পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে আছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
কাজের বাইরে ব্যক্তি হিসেবে বুবলী অন্তর্মুখী। চাইলেই বাসায় থেকে সারা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন! বন্ধু প্রসঙ্গে উল্লেখ করলেন দুই বড় বোনের কথা, যদিও তারা বর্তমানে পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন। সন্তান প্রসঙ্গে বললেন, ‘এককথায় সে আমার অক্সিজেন। মা-বাবা—উভয়ের কাছ থেকে পেয়েছে কথা কম বলার স্বভাব। আমার কাছ থেকে পেয়েছে কেয়ারিং ও পরিবারের প্রতি সাপোর্টিভ থাকার বৈশিষ্ট্য। বয়সের তুলনায় সে বেশ ম্যাচিউর। খেলনা দিয়ে না খেলে বরং এক বসায় বই পড়ে শেষ করা পছন্দ তার। কার্টুন না দেখে ডকুমেন্টারি দেখতে ভালোবাসে। বলে রাখি, পরিবারই কিন্তু আমার কাছে পৃথিবী।’
তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রসরতায় সোশ্যাল মিডিয়ার যে দাপট, তা থেকে নিজেকে খানিকটা সরিয়ে রাখেন জনপ্রিয় এই চিত্রনায়িকা। ফ্যান-ফলোয়ারদের জন্য একেবারেই যতটুকু না করলে নয়, ততটুকু সময়ই অ্যাকটিভ থাকেন। নিজেকে খানিকটা সেকেলে দাবি তার। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, ডায়েরি লেখা, পুরোনো গান শোনা, পুরোনো সিনেমা দেখা—সকল পুরোনোতেই একান্ত আগ্রহ।
বুবলী বলেন, ‘জীবনটা সহজ। সহজ এই জীবনকে সহজভাবেই দেখতে হবে। ইতিবাচক থাকতে হবে। কেননা, ইতিবাচকতার বিকল্প নেই। সহজ কথায়—এই ছোট জীবনে যতটা সহজভাবে বেঁচে থাকা যায়, মানুষকে ভালোবাসা যায়, মানুষকে সাহায্য করা যায়। মানুষকে সাহায্য কেবল বড় পরিসরে বা আর্থিকভাবে করা যায়, তা আমি মনে করি না; বরং মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলে, সুন্দর আচরণ করে ভালো রাখা সম্ভব। আরেকটি ব্যাপার, মানুষের প্রশংসা করা চাই মন খুলে।’
ফুয়াদ রূহানী খান
মেকওভার: পারসোনা
লোকেশন: লো মেরিডিয়েন
ছবি: রনি বাউল