skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I মাংসপ্রেমী নিরামিষপ্রেমী দ্বৈরথ

মাংসভোজী না নিরামিষভোজী—কে বেশি নৈতিক, কে বেশি পরিবেশবান্ধব, আর কে বেশি স্বাস্থ্যসচেতন? এই তর্ক শুধু ফেসবুক বা ইউটিউবের কমেন্ট সেকশনেই সীমাবদ্ধ নয়; গবেষণাগারেরও বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ

কেউ বলেন, ‘মাংস ছাড়া খাওয়া কি হয়!’ কারও আবার মত, ‘একটা প্রাণী মারতে তোমার বুক কাঁপে না?’ একদল বলছে, নিরামিষ ভোজন মানেই সুস্থ জীবন; অন্যদিকে মাংসপ্রেমীরা বলছেন, মানুষ মাংস খাওয়ার জন্যই প্রাকৃতিকভাবে তৈরি। আর এসব বিতর্কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা, বাংলাদেশিরা—যাদের রান্নাঘরে যেমন আছে ঝাল ঝাল গরুর মাংস, তেমনি নিরামিষ ভাজির ঘ্রাণ।
নিরামিষের প্রতি বিরূপতা
সম্প্রতি ফিনল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ভাসার এক গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘ফুড কোয়ালিটি অ্যান্ড প্রিফারেন্স’ জার্নালে। গবেষকেরা বলছেন, অনেক সময় মাংস খাওয়ার অভ্যাসে থাকা মানুষজন নিরামিষভোজীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন হিংসার কারণে! তারা নিরামিষভোজীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা, নৈতিক অবস্থান আর পরিবেশবান্ধব জীবনের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। কারণ, সমাজে এমন একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে, যিনি নিরামিষ খান, তিনি বোধ হয় একটু বেশি আদর্শবাদী, ভদ্র বা সচেতন মানুষ।
গবেষণায় ৩ হাজার ৬০০ ইউরোপিয়ানকে বিভিন্ন ধরনের শপিং লিস্ট দেখানো হয়। যেখানে কেউ গোশতের দোকানে যাচ্ছেন, কেউ মিশ্র খাদ্য নিচ্ছেন, আবার কেউ কেবলই নিরামিষ। দেখা গেছে, নিরামিষ অবলম্বনকারীকে কল্পিত ক্রেতাদের অনেকে ‘অস্বস্তিকর’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে দেখেছেন। কেউ কেউ আবার বলেছেন, ‘এরা সব সময় আমাদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে জাজ করে।’ ফলাফল—মানসিক বিদ্বেষ। বিশেষ করে যারা প্ল্যান্ট-বেজড মিট বা মিট সাবস্টিটিউট খাচ্ছেন, তাদের প্রতি মানুষের একটা বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, নিরামিষভোজীরা যেন নিজেদের সব সময় মোরালি সুপিরিয়র ভাবে, যা অন্যদের মধ্যে রাগ ও সংকোচের জন্ম দেয়।
খাবার কি শুধু পেটের দায়
অনেকেই ভাবি, খাবার মানে শুধু স্বাদ, অভ্যাস বা পুষ্টি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, খাবার এক বিশাল সামাজিক পরিচয়ের অংশ। আপনি কী খান, সেটা আজকাল আপনার শ্রেণি, রাজনৈতিক মানসিকতা, এমনকি সচেতনতা বা পরিবেশবান্ধবের পরিচয় ফাঁস করে দেয়।
বলা হয়, চলতি নতুন প্রজন্ম ফুড কনশাস। কার্বন ফুটপ্রিন্ট, অর্গানিক ফুড, ফুড ওয়েস্ট—এসব টার্ম এখন দৈনন্দিন কথাবার্তার অংশ। নিরামিষভোজীরা প্রায়ই মনে করেন, তাদের খাবারের পছন্দ পরিবেশ, প্রাণী ও মানবিক নীতির পক্ষে। আবার মাংসপ্রেমীদের কারও কারও ধারণা, ভেজানিজম বা ভেজ জীবনধারা আসলে একধরনের ন্যাকামো বা মধ্যবিত্তীয় শ্রেণিচেতনার অভিব্যক্তি!
চিত্রে স্বদেশ
আমাদের দেশেও খাবার নিয়ে টানাপোড়েন কম নেই। যদিও আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠই মাংসাশী, তবু এমন নিরামিষভোজী রয়েছেন, যারা ধর্মীয় কারণে, পারিবারিক ঐতিহ্য বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবোধ থেকে নিরামিষ খাবার গ্রহণ করেন। সনাতন ধর্মে নিরামিষ খাওয়ার একটি সাংস্কৃতিক পরম্পরা রয়েছে। আবার অনেক বৌদ্ধ এবং কিছু খ্রিস্টান পরিবারেও নিরামিষে ঝোঁক দেখা যায়। তবে বাংলাদেশের নিরামিষভোজীরা ইউরোপের নিরামিষভোজীদের মতো সরব বা সংগঠিত নন।
অন্যদিকে মুসলিম ধর্মীয় উৎসব বা প্রাত্যহিক রান্নায় মাংসের ব্যবহার ব্যাপক। কোরবানির ঈদ কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠান, গোশত যেন উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। এই প্রেক্ষাপটে নিরামিষ খাবার অনেকের কাছে অপূর্ণ বা আধা খাবার মনে হতে পারে। তবে শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা ও ফিটনেস নিয়ে বাড়তে থাকা আগ্রহ নিরামিষ ভোজনের দিকে অনেককে টানছে। এখন অনেকে সপ্তাহে এক দিন ‘মিটলেস মানডে’ মানছেন। কেউ কেউ আবার সম্পূর্ণ ভেজিটেরিয়ান ডায়েট অনুসরণ করছেন শরীর ঠিক রাখার তাগিদে। কিন্তু এখানেও সমস্যাটা আসে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
নিরামিষভোজীদের প্রতি বিদ্রূপ
সামাজিক মাধ্যমে, আড্ডায় কিংবা রান্নার অনুষ্ঠানে আমরা প্রায়ই এমন সব মন্তব্য শুনি, ‘ঘাসপাতা খেয়ে বাঁচা যায় নাকি!’ কিংবা ‘এই সব ভেজ খেলে শক্তি আসবে কেমন করে?’ কেউবা বলে বসেন, ‘তুমি তো গরুর খাবার খাও!’ মজার ছলে বলা এমন সব কথা অনেক সময় নিরামিষভোজীদের মানসিকভাবে আঘাত করে। তারা নিজেদের অপাঙ্‌ক্তেয় মনে করতে পারেন। গবেষণা বলছে, এই সামাজিক বঞ্চনা নিরামিষভোজীদের কখনো কখনো একাকী করে তোলে।
ছাড় নেই মাংসপ্রেমীদের
অবশ্য সমালোচনার থলে কেবল নিরামিষভোজীদের দিকে ছোড়া হয় না। নিরামিষপন্থীরাও অনেক সময় মাংসাশীদের ‘অনৈতিক’, ‘নির্মম’ কিংবা ‘পরিবেশের শত্রু’ বলে সমালোচনা করেন। তাদের ধারণা, প্রাণী হত্যা করে খাওয়া শুধু অমানবিক নয়, বরং জলবায়ুর জন্যও ক্ষতিকর। গবেষণা বলছে, গোশত উৎপাদনের জন্য কার্বন নিঃসরণ, জমি ব্যবহার এবং পানির অপচয় বেশি হয়। ফলে অনেক নিরামিষভোজী নিজেদের পরিবেশরক্ষক মনে করেন এবং মাংসাশীদের ওপর একধরনের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ফলাতে চান।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
বিশ্বজুড়েই ধর্মীয় আচার-আচরণ খাবারের পছন্দ-অপছন্দকে প্রভাবিত করে। ইসলাম ধর্মে হালাল পশুর গোশত খাওয়ার অনুমতি আছে। তবে অপচয় ও সীমা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। হালাল পদ্ধতিতে পশু জবাই ও খাওয়ার বিষয়টি ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সনাতন ধর্মে গরু পূজনীয়; ফলে অনেক হিন্দু নিরামিষভোজী। আবার কিছু অঞ্চলে মাছ-মাংস খাওয়ারও চল আছে। বৌদ্ধধর্মে প্রাণহানিবিরোধী অবস্থান থাকায় নিরামিষের প্রতি ঝোঁক দেখা যায়। এই ধর্মীয় পার্থক্য থেকে অনেক সময় সামাজিক দূরত্ব তৈরি হয়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা যেমন একদিকে নিরামিষভোজীদের জন্য সম্মান তৈরি করে, অন্যদিকে মাংসাশী খাদ্যপদ্ধতিও খুবই সাধারণ ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত।
নিরামিষ বনাম মাংস—কেন এই বিরোধ
আসলে এই তর্ক শুধু খাদ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আত্মপরিচয়, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং এমনকি সামাজিক শ্রেণির প্রতিচ্ছবিও হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য আমাদের সামাজিক পরিচয়ের বড় অংশ। আপনি কী খান, সেটা কেবল স্বাদের বিষয় না; বরং একটি বার্তা—আপনি কে, কেমনভাবে ভাবেন, কী বিশ্বাস করেন।
নিরামিষপন্থা কি সত্যিই সুস্থতার পথ
গবেষণায় দেখা গেছে, নিরামিষভোজীরা সাধারণত স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি সচেতন হন। তারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা—এসব রোগে কম আক্রান্ত হন। তবে একেবারে প্রাণিজ প্রোটিন না খেলে ভিটামিন বি১২, আয়রন, ওমেগা-৩-এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই একপেশে নিরামিষ নয়, বরং পরিকল্পিত খাদ্যতালিকায় স্বাস্থ্যবান থাকা সম্ভব।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখন হেলথ-কনশাস হয়ে উঠছেন। অনেকে সপ্তাহে এক দিন নিরামিষ খাচ্ছেন; কেউবা মাংসের বদলে ডিম-দুধে ভরসা রাখছেন। শহরে এখন অনেক রেস্টুরেন্টেই নিরামিষ বিকল্প থাকছে।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য—কে এগিয়ে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০১৫ সালে ঘোষণা দিয়েছিল, প্রসেসড মিট (যেমন সসেজ, হ্যাম) খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। আবার একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিরামিষভোজীরা সাধারণত হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও স্থূলতার ঝুঁকিতে কম পড়েন। তবে অতিরিক্ত কার্বস বা তেলেভাজা নিরামিষ খেলে সমস্যা হতে পারে।
এদিকে, পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, পশুপালন থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, জমির ব্যবহার বাড়ে এবং পানির অপচয় ঘটে। ফলে নিরামিষভোজনকে অনেকে পরিবেশবান্ধব মনে করেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে কৃষি খাত থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের ১৪.৫% আসে পশুপালন খাত থেকে।
বিতর্ক পেরিয়ে
এই বিতর্কের শেষ নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পছন্দের স্বাধীনতা। কেউ নিরামিষ খেলে তাকে নিয়ে রসিকতা করা এবং কেউ মাংস খেলে তাকে পশু হন্তারক ভাবা—এই দুই চরমপন্থা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। বিশ্ব যখন সাসটেইনেবল ফুড চেইন নিয়ে ভাবছে, তখন আমাদের দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। যার যা খেতে ভালো লাগে, সে তা খাবে। খাদ্যচিন্তা হওয়া উচিত সচেতনতা ও সহনশীলতার ভিত্তিতে।

 সুবর্ণা মেহজাবীন
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top