skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I রেড মিট রিডাকশন

রেড মিট খাওয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি মোটামুটি সর্বজনবিদিত! তাই বলে একেবারেই খাওয়া যাবে না? তা নয়। তবে কিছু নিয়ম মানা চাই। রইল পুষ্টিবিদ
নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে অনাবিল আনন্দ। বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে কম-বেশি সবারই চাওয়া—ঈদের মুহূর্তগুলো প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া। ঈদুল আজহায় ত্যাগের প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন ধরনের পশু কোরবানি করা হয়। আমাদের দেশে গরু ও খাসি কোরবানি দেওয়ার চল বেশি। তেহারি, কোরমা, কাবাব, রেজালা, চাপ, কিমা, কোপ্তা ইত্যাদি মুখরোচক খাবার গরু বা খাসির মাংসের হয়ে থাকে; অর্থাৎ ঈদ উৎসবে দিনমান পাতে থাকে রেড মিট।
জটিলতার ঝঞ্ঝাট
ঈদের আনন্দে আমরা অনেকে খাবার গ্রহণে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি হরদম ভুলে যাই। সে ক্ষেত্রে হঠাৎ অতিরিক্ত চর্বি, মসলা ও লবণসমৃদ্ধ রেড মিট গ্রহণে সৃষ্টি হতে পারে শারীরিক নানা জটিলতা।
অ্যাসিডিটি
কোরবানি ঈদের খাবারে ব্যবহার করা হয় অতিরিক্ত তেল, ঘি ও বিভিন্ন ধরনের মসলা। যেগুলো পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। এতে বুক জ্বলা, বারবার ঢেকুর হওয়া ইত্যাদির মতো অস্বস্তি সারা দিন দেখা দিতে পারে।
পেট ফাঁপা
যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আগে থেকেই ছিল, তাদের তো বটেই, অতিরিক্ত রেড মিট খাওয়ার পর যে কারওই হতে পারে পেট ফাঁপা বা ব্লটিংয়ের সমস্যা। আসলে উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার খুব সহজে হজম হতে চায় না, আর হঠাৎ করে অতিরিক্ত পরিমাণে মসলাযুক্ত প্রোটিন ও ফ্যাট গ্রহণে এ ধরনের শারীরিক অসুবিধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
কোষ্ঠকাঠিন্য
কোরবানি ঈদ মানেই গরু বা খাসির মাংস। সে ক্ষেত্রে সপ্তাহখানেক ফাইবারের দেখা মেলে না খাদ্যতালিকায়। সবজি বা ফলের চাহিদা কম থাকায় সহজলভ্যতাও কমে যায় বাজারে। ফলে দেখা যায় সবজি ছাড়া শুধু রেড মিটই হয়ে ওঠে ডায়েটের একমাত্র উৎস। এতে মল শক্ত হয়ে কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।
রক্তচাপ বৃদ্ধি
যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদের ওপর রেড মিট খাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঈদুল আজহায় বাড়িতে বাড়িতে যখন গরু বা খাসির মাংসই চলে, তখন হাইপারটেনশনের রোগীদের পড়তে হয় নানা বিপত্তিতে। অতিরিক্ত লবণ ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
ইনডাইজেশন
অতিরিক্ত রেড মিট খাওয়ার ফলে অনেকের হজমে অসুবিধা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
লিভারে চাপ
গরু ও খাসির মাংস অর্থাৎ রেড মিটে রয়েছে প্রচুর স্যাচুরেটেড ফ্যাট, অতিরিক্ত প্রোটিন ও লবণ। অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ করলে লিভারকে স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। সে ক্ষেত্রে যাদের ফ্যাটি লিভার রয়েছে, তারা পড়ে যান বাড়তি অসুবিধায়। বিশেষ করে বুক, পেটব্যথাসহ হজমের গন্ডগোল দেখা দিতে পারে।
খেতে মানা? না, না!
আনন্দঘন ঈদে একটু অনিয়ম তো হতেই পারে! এ সময় রেড মিট যদি একটু বেশি খাওয়া হয়েই যায়, শারীরিক ধকল বা নেতিবাচক প্রভাবের চাপ কমাতে খাদ্যতালিকায় অবশ্যই বিশেষ কিছু খাবার রাখা চাই।
টক দই
হজম ভালো করতে প্রোবায়োটিকের গুরুত্ব আজ আর নতুন নয়। এটি আমাদের অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে হজমে সহায়তা করে। সব ধরনের দই-ই ভালো, যদিও হজমের কথা চিন্তা করলে মিষ্টি দইয়ের চেয়ে টক দই বা ইয়োগার্ট বেশি সহায়ক। ডাইজেশনের পাশাপাশি এটি ক্যালরি নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
 খাওয়ার সময়: দুপুর কিংবা রাতে ভারী খাবার গ্রহণের পর।
 খাওয়ার পদ্ধতি: বোরহানি বা ঘোলে যুক্ত করে কিংবা সরাসরি খাওয়া যেতে পারে।
 খাওয়ার পরিমাণ: ১ বাটি টক দই সরাসরি খাওয়া যায় কিংবা তরল হলে ১ গ্লাস।
জিরা পানি
আমাদের খাদ্যতালিকায় প্রাচীনকাল থেকে জিরার ব্যবহার রয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ এই মসলায় সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফলেট ও ফাইবারের পাশাপাশি রয়েছে ভিটামিন এ, বি, সি ও কে। ভারী খাবার খাওয়ার পর হজম সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য এত পুষ্টিগুণসম্পন্ন মসলাটি গ্রহণ করতে পারেন।
 খাওয়ার সময়: ভারী খাবার খাওয়ার পরে কিংবা খালি পেটে।
 খাওয়ার পদ্ধতি: পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে বা ফুটিয়ে ছেঁকে নিয়ে।
 খাওয়ার পরিমাণ: ১ চা-চামচ।
আদা
হজমক্ষমতা ভালো রাখতে, গ্যাস বা ব্লটিং কমাতে খাদ্যতালিকায় সারা বছর আদা রাখা যেতে পারে। তবে ঈদে যেহেতু গরু ও খাসির মাংসের নানা আইটেম থাকে প্লেটে প্লেটে, সে ক্ষেত্রে অন্যান্য চা বা কফির পরিবর্তে, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বজায় রাখতে পান করতে পারেন আদা-চা। লেবুতে যাদের অ্যাসিডিটি হওয়ার ঝুঁকি থাকে না, তারা লেবুর রস মিশিয়ে পুষ্টিগুণসম্পন্ন দারুণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত এই চা পান করতে পারেন।
 খাওয়ার সময়: বিকেলে বা খালি পেটে কিংবা খাদ্য গ্রহণের পর।
 খাওয়ার পদ্ধতি: পানিতে ফুটিয়ে ছেঁকে কিংবা কুচি করে।
 খাওয়ার পরিমাণ: ১ চা-চামচ।
আছে আরও
এসব শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে ঈদের আনন্দ ধরে রাখতে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন আরও কিছু খাবার।
ইসবগুলের ভুসি
অতিরিক্ত রেড মিট খাওয়ার পর অনেকের মল শক্ত হয়ে যায়। ফাইবার আমাদের শরীর থেকে টক্সিক পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে এবং অন্ত্রকে সুস্থ রাখে। ঈদে যেহেতু খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ সবজি ও ফাইবার থাকে না বললেই চলে, সে ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া যথেষ্ট স্বাভাবিক। এ থেকে রেহাই পেতে সকালে খালি পেটে এক গ্লাস পানির সঙ্গে ইসবগুলের ভুসি মিশিয়ে পান করতে পারেন। এ ছাড়া কুসুম গরম দুধের সঙ্গে ইসবগুল মিক্স করে রাতে খেয়ে নিলেও সকালে ভালোভাবে পেট পরিষ্কার করতে কাজে দেবে।
ফল
পেটের অস্বস্তি কমাতে একটু ঠান্ডা খাবার বেশ ভালো লাগে। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ফল মিক্স করে খাওয়া যেতে পারে স্মোদি বা জুস হিসেবে। রেড মিট খাওয়া অনেক বেশি হয়ে গেলে শরীরে যে অস্বস্তি অনুভূত হয়, তা কাটাতে সামান্য বরফকুচি দিয়ে গ্রহণ করতে পারেন মাল্টা অথবা পেঁপের জুস।
পরিহারে মুক্তি
শরীর সুস্থ রাখতে অতিরিক্ত ভারী খাবার কখনোই স্বস্তির হয়ে ওঠে না। এ ছাড়া এই প্রচণ্ড গরমে গরু বা খাসির মাংস অতিরিক্ত গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আবার খাদ্যতালিকায় যদি আরও কিছু ফ্যাটজাতীয়সহ অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাবার সংযুক্ত থাকে, তাহলে তো কথাই নেই! তাই কিছু খাবার পরিহার করা শ্রেয়।
 ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার; যেমন পিৎজা, বার্গার, শিঙাড়া, ফেঞ্চ ফ্রাই, ওয়েজেস, নাগেট।
 বেকড মাংসজাত খাবার; যেমন সসেজ, সালামি ইত্যাদি; যেগুলোতে অতিরিক্ত ক্যালরিসহ প্রিজারভেটিভ ও অতিরিক্ত লবণ থাকে।
 কোল্ড ড্রিংকস ও কার্বনেটেড পানীয় ভারী খাবার গ্রহণের পর অনেকটাই আরাম বোধ পাওয়া যায় বলে অনেকের ধারণা; অথচ বৈজ্ঞানিকভাবে এ ধারণার কোনো ভিত্তি নেই; বরং এড়িয়ে চলাই উত্তম।
 ঈদে সেমাই, ফিরনি, জিলাপি, মিষ্টিজাতীয় খাবার কম-বেশি সবার টেবিলে থাকে; তবে রেড মিট খাওয়ার পাশাপাশি এ ধরনের খাবার আরও অনেক অস্বাস্থ্যকর। সে ক্ষেত্রে একেবারে বাদ না দিয়ে খেতে পারেন খুব অল্প পরিমাণে।
লাইফস্টাইল হালনাগাদ
ঈদের আনন্দ উপভোগের জন্য থাকা চাই সুস্থ। এমনকি ঈদ-পরবর্তী সময়গুলোতেও যেন সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব হয়, সে জন্য কিছু অভ্যাসের চর্চা রাখা শ্রেয়।
 পরিমিত খাওয়া: একবারে অতিরিক্ত না খেয়ে, দিনে কয়েকবার অল্প অল্প করে খাদ্য গ্রহণ করুন।
 ফাইবারযুক্ত খাবার অন্তর্ভুক্তকরণ: স্যালাদ, শাকসবজি ও ফলমূল রাখুন প্রতিদিনের মেনুতে।
 হালকা হাঁটা: খাওয়ার ৩০ মিনিট পর ১৫ থেকে ২০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করলে হজম ভালো হয়।
 চিনি ও লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ: এই দুই খাদ্যদ্রব্য পরিমিত পরিমাণ গ্রহণ করলে রক্তচাপ ও রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।
 পানি পান: এই গরমে ডিহাইড্রেশন থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত বিরতিতে পানি পান করুন। দিনে অন্তত ৮ থেকে ১০ গ্লাস সাদা পানি, ডাবের পানি ও ডেটক্স ওয়াটার পানের চেষ্টা করুন।
ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপন করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই সুস্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করি। রেড মিট পুষ্টিকর খাদ্য হলেও অতিরিক্ত গ্রহণে তা হজমে সমস্যা, রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণ হতে পারে। তাই ঈদের দিনে কিংবা তার পরে হঠাৎ শরীর খারাপ লাগলে আতঙ্কিত না হয়ে কিছু হালকা, সহজপাচ্য ও প্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণ করলে দেহ দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। সচেতনভাবে খাওয়া-দাওয়া করলে ঈদের আনন্দ থাকবে পূর্ণ, আর শরীর থাকবে সুস্থ ও প্রাণবন্ত। তবে শরীর বেশি খারাপ লাগলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করাই মঙ্গল।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top