ফরহিম I আত্মবিশ্বাস উদ্ভূত
‘ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু বি আ মেস টু বি ম্যানলি’—দারুণ জনপ্রিয় এ উদ্ধৃতিই যেন আজকের আত্মবিশ্বাসী পুরুষদের পরিচায়ক। এমনকি কনফিডেন্স বুস্টের জন্যও উপকারী এই মনস্তত্ত্ব
ঝটপট শেভিং, আফটার শেভ আর চটজলদি গোসল, বের হওয়ার সময় নাম না জানা একটা পারফিউম—ব্যস! ম্যান স্কিন কেয়ারের এই রুটিন চিরচেনা। কিন্তু দিন বদলেছে। কে পপস্টারদের বেবি সফট গ্লাস স্কিন, কিংবা হলিউড অভিনেতাদের মাচো লুক—বিশ্বব্যাপী স্কিন কেয়ার স্পটলাইট নারীদের আলোকিত করে বেশ কিছু বছর ধরে পুরুষসমাজেও ভীষণ প্রভাব খাটাচ্ছে। ম্যান স্কিন কনফিডেন্স বর্তমানে পুরুষদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সামাজিক সমীক্ষা বলছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পুরুষদের পার্সোনাল কেয়ার প্রোডাক্টের বাজার ১৬৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে ত্বকযত্নের খাতটি দ্রুত ক্রমবর্ধমান।
ম্যান স্কিন কনফিডেন্স একটা স্টেটমেন্ট, একটা প্রতিপাদ্য; যা জানান দিচ্ছে সৌন্দর্য, যত্ন শুধু একটা লিঙ্গের অধিভুক্ত নয়; বরং নিজের যত্ন নেওয়া সবার কর্তব্য। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ৫ জনে ১ জন পুরুষ ফাউন্ডেশন ব্যবহার করে থাকেন। এতে লুকানোর কিছু নেই; না আছে লজ্জার।
মেকি আত্মসম্মান আর পুরুষতান্ত্রিকতার নেতিবাচকতা ভেঙে নতুনদের পৃথিবীতে নিজের যত্ন নিয়ে নিজেকে আরও পরিশীলিত, আরও আত্মতৃপ্ত করার প্রতিপাদ্য মেনে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হচ্ছে ম্যান স্কিন কনফিডেন্সের বিষয়টি।
নিজের যত্ন
কয়েক দশক আগেও তামাটে গায়ের রং, পাতলা চুল কিংবা মেছতার দাগকে পুরুষালি ভাবা হতো। একটু সূক্ষ্মভাবে ভাবলেই দেখা যায়, পুরুষালি নয়; বরং নিজের প্রতি অবহেলাকে গ্লোরিফাই করা হয়েছে যুগের পর যুগ ধরে। সে সময় গত হয়েছে। আজকের সচেতন পুরুষ সেই শিকল ভেঙে বের হয়ে আসছেন দৃপ্ত পায়ে।
সেলফ হাইজিন কিংবা নিজস্ব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কোনো লৈঙ্গিকভিত্তিক দায়িত্ব নয়; বরং সেলফ লাভের অংশ। স্কিন কেয়ার মানেই শুধু রং ফর্সাকারী কোনো ক্রিম নয়। আবার স্কিন কনফিডেন্স একটা রুটিন, একটা লাইফস্টাইল। নিজের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, রুচিশীলতার প্রকাশ আর মানসিক সুস্থতার বিকাশ ঘটে। ‘ম্যান আপ’ বলে কঠোরতা কিংবা আবেগহীন হওয়ার প্রশ্রয় নয়; বরং স্কিন কনফিডেন্স বিশ্বজুড়ে প্রচার করছে কীভাবে নিজের আত্মবিশ্বাসে বলিষ্ঠতা ধরে রেখে আরও নমনীয় থাকা যায়।
পুরুষত্বের নতুন সংজ্ঞা
ত্বকের যত্ন হোক বা পোশাকের, কিংবা বাচনভঙ্গি অথবা কণ্ঠের—পুরোটাই জড়িত ছিল নারীত্বের সঙ্গে। পুরুষেরা নিজের প্রতি যত্নবান হওয়া মানেই তার নামের পাশে এঁটে যেত কোনো নেতিবাচক বা হাস্যরসাত্মক বিশেষণ। যুগের পর যুগ কঠোরতাকে পুরুষতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে অনেক প্রজন্মের।
সময় বদলেছে। সেসব ছাইপাঁশ চিন্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন করে গড়া হচ্ছে পুরুষের সংজ্ঞা। সোশ্যাল মিডিয়া, অ্যাড ইন্ডাস্ট্রি, প্রিন্ট মিডিয়া, বিনোদন প্ল্যাটফর্মগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে ভুলে ভরা পুরুষতান্ত্রিকতাকে। নতুন এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি, ইনফ্লুয়েন্সার, খেলোয়াড়েরা। শেয়ার করছেন নিজেদের স্কিন কেয়ার এবং হেলথ কেয়ার রুটিন। ৫০ বছর বয়সী অভিনেতা ফ্যারেল উইলিয়ামস চালু করেছেন নিজের স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ড। ডেভিড বেকহাম শেয়ার করছেন নিজের স্কিন কেয়ার রুটিন। সৌন্দর্য কোনো রঙের সঙ্গে নয়; বরং সৌন্দর্য জড়িত নিজের যত্নে, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে, নিজের আলো মেলে ধরাতে।
ত্বকযত্নের পাশাপাশি যদি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা যায়, মন্দ হয় না। সাসটেইনেবল স্কিন কেয়ার রুটিন গড়ে তোলার মাধ্যমে সম্ভব নিজের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিশদ কোনো বিষয়ে অবদান রাখা। বদলে ফেলা যেতে পারে ছোট ছোট অভ্যাস; ক্রুয়েলটি ফ্রি কিংবা বায়োডিগ্রেডেবল প্রোডাক্ট ব্যবহারে পরিবেশের প্রতি অবদান রেখে যাওয়া যায়।
ইতিবাচক পুরুষত্বের সংজ্ঞা নিজের আবেগকে লুকিয়ে না রেখে মেনে নেওয়াতে। শারীরিক শক্তি প্রদর্শনে নয়; বরং নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলাতে। মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করাতে।
ত্বক: আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি
ত্বক বলে দেয় ভেতরের খবর। বোর্ড রুমে হোক বা প্রথম ডেটে, কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা হয়, তার ওপর নির্ভর করে অন্যের কাছে সে ব্যক্তি কতটা আত্মবিশ্বাসী, কতটা আস্থাভাজন। ত্বক বলে দেয় ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে কতটা উদাসীন বা সচেতন।
ভালো ত্বকের সঙ্গেই থাকে সুস্থতার সংযোগ। সঠিক পরিমাণে পানি পান, ঘুম, দৈহিক ফিটনেসের প্রতি যত্নবান পুরুষেরা শুধু ত্বককেই ভালো রাখেন না, বাড়িয়ে দিতে পারেন আত্মবিশ্বাসও। ত্বকের যত্ন নেওয়া মানে দেহে সেরাটোনিন আর অক্সিটোসিনের আগমন, ফিল-গুড হরমোনগুলো বৃদ্ধি করে সার্বিক সুস্থতা।
বদলে যাওয়া পৃথিবী জানান দিচ্ছে, বদল আনতে হবে রেগুলার স্কিন কেয়ার রুটিনেও। শুধু ক্লিনিং, স্ক্রাবিং বা ময়শ্চারাইজিং নয়; খেয়াল রাখা চাই আরও গভীরভাবে। ত্বকের স্বাভাবিক টান টান ভাব বজায় রাখা চাই কোলাজেন প্রোডাকশনের। এ ক্ষেত্রে বাসায় বসে কিংবা কোনো স্যালনে এলইডি থেরাপি নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ত্বকের ভিন্নতা ও চাহিদা অনুযায়ী নেওয়া যেতে পারে গুয়াশা মাসাজ, ক্রায়োথেরাপি, অক্সিজেন থেরাপি।
ম্যান স্কিন কনফিডেন্স কথা বলে পুরোনোকে ভেঙে নতুনকে গড়ার। গ্রুমিং কোনো একটা স্পেশাল কাজ নয়; বরং নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসের মতোই। যেহেতু প্রতিটি স্কিন টাইপই আলাদা, সে অনুযায়ী ত্বকের চাহিদাও ভিন্ন। সে অনুযায়ী সঠিকভাবে যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে রুখে দেওয়া যেতে পারে ত্বকে সৃষ্ট পারিপার্শ্বিক সব বিরূপ প্রভাব।
আত্মবিশ্বাস কোনো সাময়িক ট্রেন্ড নয়; বরং নিজের ভেতরকার সৌন্দর্য আরও বেশি উজ্জীবিত করে তোলার অংশ। ম্যান স্কিন কনফিডেন্স যুগের পর যুগ চলে আসা অন্ধত্বকে ভেঙে দিয়ে পুরুষের সৌন্দর্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার মিশন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। নমনীয়তার পরশে শুধু সৌন্দর্য নয়, সম্ভব নিজের পুরো পারসোনালিটি বদলে ফেলা। নিজের যত্ন নিয়ে কাঙালকেও রাজা দেখাতে পারে, এই বিশ্বাসে তৈরি করা সম্ভব অহংকারবিহীন পুরুষতান্ত্রিকতা।
বিদিশা শরাফ
মডেল: সায়েম
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল