skip to Main Content

মনোজাল I ক্রয়বিলাস

আকাশচুম্বী দামও কমাতে পারেনি এর আকর্ষণ। হয়ে উঠেছে পদমর্যাদা আর ঠাটবাট দেখানোর পন্থা। নাকি পুরোটাই পণ্যের গুণমান আর কারুশিল্পের প্রতি ভালোবাসার প্রদর্শন। খোঁজ করা যাক

বিশ্বজুড়ে বিলাসবহুল ফ্যাশন তার অনন্য আকর্ষণের জন্য বিখ্যাত। উচ্চমানের পণ্য, মর্যাদাপূর্ণ ব্র্যান্ড এবং উচ্চ মূল্যের ট্যাগে চিহ্নিত যেকোনো কিছু কেন যেন মনুষ্য প্রজাতিকে সব সময় চুম্বকের মতো টানে। অর্থনৈতিক নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও যথেষ্ট ব্যয় করে কেন একজন মানুষ বিলাসবহুল পণ্য কেনেন কিংবা তার প্রতি আকর্ষিত হন, ব্যাপারটি অনেকটাই রহস্যজনক। ক্রেতাদের এই মনোবিজ্ঞান এতটাই জটিল, তা কয়েক দশক ধরে বিপণনকারী, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করে আসছে। তারা নানা রকম গবেষণা করেছেন; ভোক্তাদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পেছনের অনেক কারণের কথাও জানিয়েছেন।
প্রতিপত্তি প্রদর্শনে
বিলাসবহুল পণ্যকে একজন ভোক্তা সাধারণত তার সম্পদ এবং সামাজিক মর্যাদার প্রতীক গণ্য করেন। লুই ভিতোঁ বা এরমেসের মতো বিলাসবহুল লেবেল থেকে পণ্যের মালিকানা পাওয়া রীতিমতো স্ট্যাটাস মার্কার হিসেবে কাজ করে। কারণটাও খুব কঠিন নয়। তাদের সিম্বল এবং এক্সট্রা অর্ডিনারি ডিজাইন সমাজের একটি নির্দিষ্ট স্থানকেই নির্দেশ করে। মনোবিজ্ঞানের মতে, এই ব্র্যান্ডগুলো সামাজিক বৈষম্য ও স্বীকৃতির জন্য সাধারণ মানুষের মনের গভীর মানসিক চাহিদার কারণে স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে ওঠে। তাই ভোক্তারা এই বিলাসবহুল জিনিসপত্র মূলত তাদের সামাজিক অবস্থান প্রতিষ্ঠা করার আশায় ক্রয় করেন।
ক্রয়ের আবেগ
উচ্চমূল্য দিয়ে কেনা পণ্য প্রায়শই ক্রেতার মনে একরকম আবেগ সৃষ্টি করে, যার মধ্যে সুখ, গর্ব ও ভোগের মতো অনুভূতি লুকিয়ে থাকে। বিলাসবহুল ফ্যাশন পণ্য অর্জনের অভিজ্ঞতার জন্য এই আবেগগত মাত্রা অনেকটাই দায়ী। ভোক্তাদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করে জানা গেছে, এই জিনিসগুলোর মালিকানা তার মনের সন্তুষ্টি ও আত্মমূল্যকে ব্যাপকভাবে বাড়াতে পারে। অনেকের জন্য বিলাসবহুল পণ্য নির্বাচন, ক্রয় এবং নিজের সংগ্রহে রাখা এমন একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দেয়, যা রীতিমতো অবাস্তব। পুরো অভিজ্ঞতা তাকে যে পরিমাণ তৃপ্তি ও আনন্দ দেয়, তা তিনি অন্য কিছুতে পান না। অনেকটা নিজেই নিজেকে পুরস্কৃত করার মতো।
ব্র্যান্ড খ্যাতি
বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর মনোবিজ্ঞান তাদের খ্যাতির সঙ্গে যুক্ত ‘হ্যালো এফেক্টে’র মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। যখন কোনো ব্র্যান্ডের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য গ্রাহকদের তৃপ্ত করে, তখন ব্র্যান্ডের একটি প্রভাব পড়ে ব্যক্তির ওপর। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে রোলেক্সের কথা। নির্ভুলতা ও উৎকর্ষের জন্য এই ব্র্যান্ডের খ্যাতি তার সব ঘড়ির ওপর একরকম ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে ভোক্তার মনে। অর্থাৎ ওই ব্র্যান্ডের ঘড়িগুলোর ওপর এমন এক বিশ্বাস তৈরি হয়, যা ক্রেতার পছন্দকে পরবর্তী সময়ে পরিচালিত করার সক্ষমতা রাখে।
বিরলতা
এক্সক্লুসিভিটি বিলাসবহুল ফ্যাশনের আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি নির্দিষ্ট পণ্য শুধু আমার জন্যই তৈরি কিংবা আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না—এই মনোভাব বিরল আনন্দ এনে দেয়। কারণ, মানুষ বরাবরই স্বতন্ত্র জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর ব্র্যান্ডগুলো কার্যকরভাবে ঠিক এই কৌশলই ব্যবহার করে। ছোট ব্যাচে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা বাড়ায় এবং বিরলতার অনুভূতি তৈরি করে। এই দুর্লভতার কারণে গ্রাহকেরা তাদের সেই বিলাসবহুল ক্রয়কে আরও মূল্যবান হিসেবে দেখেন। পণ্যের সীমিত প্রাপ্যতা তাদের মর্যাদা ও আকাঙ্ক্ষা বাড়ায়। ক্রেতারা তা কেনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
ফ্যাশনে পরিচয়
বিলাসবহুল ফ্যাশন আত্মপ্রকাশ ও পরিচয় নির্মাণের জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। এটি মানুষকে তাদের ব্যক্তিগত শৈলী, মূল্যবোধ ও যোগাযোগমাধ্যম বাড়াতে সাহায্য করে। ব্যক্তিত্ব গঠনের পাশাপাশি, প্রতিটি ক্রয়কে ব্যক্তিগত রুচি এবং সামাজিক অবস্থানের প্রতিফলন হিসেবে দেখেন ভোক্তারা। বর্তমান বিশ্বে ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং অপরিহার্য। বিলাসবহুল ফ্যাশন আইটেমগুলো সেই কাজই চমৎকারভাবে করে। একই সঙ্গে অন্যের কাছে নিজেদের আলাদা করতে এবং তাদের স্ট্যাটাস জানান দিতে সহায়তা করে।
কারুশিল্পের আকর্ষণ
বলা বাহুল্য, বিলাসবহুল পণ্যগুলোর আবেদন তাদের গুণমান এবং কারুশিল্পের মধ্যেও গভীরভাবে প্রোথিত। গ্রাহকেরা ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য ব্যবহারে উন্নত উপকরণ এবং সূক্ষ্ম উৎপাদন কৌশলকে মূল্যায়ন করেন। মূল্য নির্ধারণের মনোবিজ্ঞানও এখানে ভূমিকা রাখে। কারণ, খরচের ঊর্ধ্বগতি প্রায়শই এক্সক্লুসিভিটি এবং উন্নত কারুশিল্পের সমতুল্য অনুভূতি দেয়। যার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অনেক।
বিলাসের প্রতি ভালোবাসা
স্নায়ুবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিলাসবহুল পণ্য কেনা ব্যক্তির মস্তিষ্কে নিজেকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে এমন অনুভূতিপ্রবণ ইন্দ্রিয়গুলোকে সক্রিয় করে তোলে। ডোপামিন নিঃসরণের পাশাপাশি আনন্দ ও তৃপ্তির অনুভূতি তৈরি করে। এই প্রতিক্রিয়া বিলাসবহুল ক্রয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত মানসিক পরিপূর্ণতাকে আরও শক্তিশালী করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, বিলাসবহুল পণ্য কেনার মাধামে গ্রাহকেরা কেবল শারীরিক উন্নতিই খোঁজেন না; বরং সেগুলো মালিকানার সঙ্গে যে মানসিক তৃপ্তি ও মর্যাদা আসে, সেটাও তাদের বিবেচনায় থাকে।
ডিজিটাল প্রভাব
সোশ্যাল মিডিয়া এই বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। সমাজে ট্রেন্ড নির্ধারণকারী হিসেবে বিবেচিত প্রভাবশালীরা ভোক্তাদের রুচি গঠন করে এবং ব্র্যান্ডের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তোলে। বিলাসবহুল জিনিসপত্র অনুমোদনের মাধ্যমে তারা বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নতুন দর্শকদের আকর্ষণ করে। এই টেকনিক ডিজাইনার ব্র্যান্ড পছন্দ করা থেকে শুরু করে ভোক্তাদের আচরণ কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাবিত হয়, তা নির্দেশ করে।
পরিশেষে বলা যায়, বিলাসী পণ্য ভোগের মনস্তত্ত্ব হলো সামাজিক ও মানসিক কারণগুলোর একটি জটিল মিথস্ক্রিয়া। প্রতিপত্তি অর্জন থেকে শুরু করে মানসিক তৃপ্তি, ব্র্যান্ডের প্রভাব, বিরলতা, আত্মপ্রকাশ এবং কারুশিল্পের আকর্ষণ সেই ক্রিয়ায় ঘি ঢালার মতো কাজ করে। বাজার বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তারা মনে করেন, ব্র্যান্ডগুলো কেবল তাদের বিলাসবহুল পণ্যই সরবরাহ করছে না; বরং সেখান থেকে তারা পাচ্ছেন অভিজ্ঞতা, পরিচয় ও কৃতিত্বের প্রতীক সমমূল্যের অনেক কিছু।

 রত্না রহিমা
মডেল: আনিকা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: জুরহেম
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top