ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ফারসি ফিভার
শতক পুরোনো সাউথ এশিয়ান স্টাইলিং স্টেপল। সময়ের স্রোতে হারিয়ে ফিরে আসা। বিভাজনের ডঙ্কাও যাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি বেশি দিন। হেরিটেজ ড্রেসিংয়ের হাত ধরে আবার ফিরেছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে
কালজয়ী বললে ভুল হবে না এই পোশাককে। একসময় আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিল। এত বছর পর সমসাময়িক স্টেটমেন্ট পিসগুলোর সঙ্গে জোর টক্কর দিতে দেখা যাচ্ছে। তাই তো এই মেঝেতে লুটোপুটি খাওয়া সিলুয়েটের সালোয়ারে মন মজেছে জনপ্রিয় তারকা আর ডিজাইনারদের। তালিকায় পাকিস্তানিদের নামটা একটু এগিয়ে। হানিয়া আমির, আয়েজা খান, সাদাফ কানওয়াল, আনমোল বালোচদের মতো অভিনেত্রীদের দেখা গেছে ফারসি সালোয়ারে।
ডিজাইনারদের মধ্যে শুরুটা হয়েছিল হুসেইন রিহার, ফায়েজা সাকলাইন আর জারা শাহজাহানের হাত ধরে। আর এখন তো সবাই ধুমিয়ে তৈরি করছেন এই সালোয়ার। দেখা গেছে, ভারতীয় অভিনেত্রী খুশি কাপুর এবং কারিশমা কাপুরদের ওয়্যারড্রোবেও। আর তা দেখেই কাটতি বেড়েছে এর। ভারত, পাকিস্তানসহ সাউথ এশিয়ান দেশগুলোতে। গেল মৌসুমের ঈদের বাজারজুড়ে রমরমা ছিল এই সালোয়ারের। শুধু পাজামাকে কেন্দ্র করে তৈরি প্রচলিত ফেস্টিভ ওয়্যারকে যা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে দেখিয়েছে।
আ রয়্যাল লিগ্যাসি
সতেরো কি আঠারো শতক। তা নিয়ে একটু দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু শুরুটা যে হয়েছিল মোগল দরবারে, তা নিয়ে তর্কের সুযোগ নেই। বিলাসবহুল ফারসি সালোয়ার ছিল সে সময়কার সম্ভ্রান্ত নারীদের অন্যতম প্রধান পোশাক। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রচলিত ইউরোপিয়ান গাউনের জাঁকজমক ভাব প্রতিফলিত করার জন্যই নকশা করা হয় এটি। মেঝে ছোঁয়ানো অর্থাৎ ফ্লোর লেন্থ ফ্লেয়ারের কারণে এর এমন নামকরণ। পারসিয়ান ভাষায় ফারস অর্থ মেঝে, আর তা থেকেই ফারসি। এর সিগনেচার ট্রেইলিং হেমলাইনের থেকে অনুপ্রাণিত নাম। সে সময় লাক্সারিয়াস সিল্ক, ব্রোকেড আর ভেলভেট থেকে তৈরি হতো এই সালোয়ার। জারদৌসি, গোটা পাত্তি আর হাতের কাজের সূক্ষ্ম নকশায়। এর রাজসিক আর পরিশীলিত সৌন্দর্য প্রদর্শনে। পুরো আউটফিটের মোট তিনটি অংশ। প্রথমটা কুর্তা অথবা লং শার্ট, দ্বিতীয়টা দোপাট্টা অথবা লং স্টোল আর তৃতীয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; ফারসি সালোয়ার অথবা পাজামা। কোমরে দড়ি দিয়ে আটকানো দুই পায়ের ঢোলা পাজামা। একদম গোড়ালি অব্দি লম্বা, তারপর সেখান থেকে চওড়া ফ্লোয়ি পট্টি। হাঁটার সময় যে অংশ মেঝেতে লুটোপুটি খায়।
ভারতের সঙ্গে সীমানা ভাগের পর ফারসি সালোয়ার স্থায়ী জায়গা করে নেয় পাকিস্তানে। প্রতিদিনকার পোশাক হিসেবে। তবে একসময় পালাজো আর চুড়িদারের দাপটে মেইনস্ট্রিম ফ্যাশনে আবেদন হারাতে শুরু করে এটি। ব্রাইডাল আর ফেস্টিভ ওয়্যারের পাশাপাশি কালচারাল অ্যাটায়ার হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় একসময়। ছিল সেই অঞ্চলের ধ্রুপদি নৃত্যের পোশাকের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে সময়ের সঙ্গে সুর কাটতে শুরু করে এই ফ্যাশন স্টেপলের। শামিল হয় হারিয়ে যাওয়ার কাতারে। কিন্তু ফ্যাশন তো ফিরে ফিরে আসে, তা আবার প্রমাণিত হয় ফারসি সালোয়ারের ক্ষেত্রেও।
ফিরে আসার গল্প
স্লো ফ্যাশন আর হেরিটেজ কতুরে ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের নতুন ঝোঁক এই পটপরিবর্তনের কারণ। ফলে আর্টিস্যানাল ক্রাফটম্যানশিপের সমাদর যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এর গুণগ্রাহীও। এই সালোয়ার পুরো মুভমেন্টের সঙ্গে দারুণ মানানসই। এর স্টেটমেন্ট মেকিং শিলুয়েট শুধু রাজসিক নয়, সাসটেইনেবলও বটে। ফলে সমসাময়িক জায়গা করে নিতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। হুসেইন রেহার, জারা শাহজান, হিনা কোচার, শীতল যাত্রার মতো ডিজাইনার হাউস আর কতুরিয়ারদের কল্যাণে পথ আরও সুগম হয়। আধুনিকায়ন হয় পোলকা ফ্যাব্রিক, অভিনব কাট আর কনটেম্পরারি এমবেলিশমেন্টের ছোঁয়ায়। তবে মূল রয়ে যায় সেই মোগল আমলেই। শিফন, সিল্ক আর অরগাঞ্জাতেও যে ফারসির সৌন্দর্য এতটুকু কমে না, তাই করে দেখিয়েছেন তারা। ফলে তৈরি হয়েছে ভার্সাটাইল এবং পরিশীলিত উৎসবসম্মত পোশাক। ফারসি সালোয়ারের জনপ্রিয়তার পালের হাওয়ায় বাতাস দিয়েছেন ফ্যাশন স্টাইলিস্টরাও। ডিজাইনারদের অভিনব আবিষ্কার দিয়ে সাজিয়েছেন তারকাদের লুক। ফলাফল—তাদের বরাতে সাধারণেও প্রিয় হতে শুরু করে এ পোশাক। পাকিস্তানি টিভি ড্রামা আর ইনফ্লুয়েন্সারদের কল্যাণে সে জাদু ছড়াতে শুরু করে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে।
দ্য আলটিমেট গাইড
প্রথমেই ফ্যাব্রিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। কারণ, এটাই নিশ্চিত করবে সালোয়ারের গ্রেসফুল ড্রেপ। এ ক্ষেত্রে সিল্ক আর বেনারসি কাপড় দিয়ে তৈরি করা যায় ফরমাল ফেস্টিভ এবং ব্রাইডাল ওয়্যার। শাইনি ভাব আর স্ট্রাকচারড লুক যাদের পছন্দ, তাদের জন্য। জর্জেট আর শিফনে তৈরি হবে লাইটওয়েট, ফ্লোয়ি ফারসি সালোয়ার। ইজি ব্রিজি, এফোর্টলেস লুকের জন্য। ভেলভেটে তৈরিগুলো শীতের জন্যই তোলা থাক। কটন আর লিনেন হচ্ছে ক্যাজুয়াল ওয়্যারের ব্রিদেবল অপশন। আরামের সঙ্গে আপোস না করে স্টাইলিংয়ের জন্য।
ফারসি সালোয়ারের বিশেষত্ব ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু। লম্বায় গোড়ালির ওপর থেমে গেলে হারাবে আবেদন; বরং হতে হবে মেঝে ছোঁয়া লেন্থের, যা লম্বা দেখানোর ইলিউশন তৈরি করবে লুকে।
সালোয়ারের সঙ্গে কুর্তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। লং কিংবা শর্ট—উভয়ের সঙ্গেই ভালো মানায় ফারসি। তবে প্রপোরশন ঠিক রাখা প্রয়োজন। যাদের শরীরের নিচের অংশ ভারী, তারা লং কামিজ পরলে ব্যালেন্সড লুক তৈরি হবে। আর স্ট্রাকচারড লুকের জন্য ঢিলাঢালা শর্ট কুর্তাই সই। তবে খুব বেশি খাটো যেন না হয়। সঙ্গে অ্যাকসেসরিজটাও মানানসই হওয়া জরুরি। সূক্ষ্ম এমবেলিশমেন্টের অথবা মেটালিক টোনের স্ট্রাকচারড ক্লাচ সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে। ফুটওয়্যার হিসেবে এমব্রয়ডারড জুত্তি, ট্র্যাডিশনাল কোলাপুরি হিল অথবা ফ্ল্যাট—পরে নেওয়া যাবে অনায়াসে।
ফ্যাশন ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট