skip to Main Content

সঙ্গানুষঙ্গ I খোশবাই

মির্জা গালিব লিখেছিলেন, ‘খুশবু তেরি ইয়াদো কি তারাহ, বাস যায় মেরি জিন্দেগি মে’; আতর ঠিক সেভাবেই মিশে আছে ঈদের স্নিগ্ধ স্মৃতিতে। এর আবেদন এখনো অম্লান

আতর—একটি শব্দেই মন ছুটে যায় ছোট্ট বেলায়। ঈদের নামাজে যাওয়ার সময় পরিবারের সব পুরুষ ব্যবহার করতেন এই সুগন্ধি। সফেদ পাঞ্জাবিতে কয়েক ফোঁটা আর তারপরে এক টুকরো তুলায় আতর নিয়ে কানের তরুণাস্থিতে বসিয়ে দেওয়া। তারপর ঘরের ছোট্ট মণির হাতের তালুর উল্টো দিকে একটুখানি আতরের স্পর্শ। এইটুকু ঈদের সকালে না হলে চলতই না। এখনো চলে না। শৈশবের সঙ্গে এর সুগন্ধের ঐকতান খুব চেনা। এর ইতিহাস ৫ হাজার বছরের বেশি পুরোনো। পারস্যে এর শিকড় বলেই সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। ধর্মীয় আচার, রাজদরবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যবহার ছিল প্রথম দিকের উদ্দেশ্য। পরবর্তী সময়ে সাধারণের কাছে পৌঁছে যায় ধীরে ধীরে। ভারত, আরব আর মধ্যপ্রাচ্যে হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। অভিজাত প্রসাধন হিসেবে স্বীকৃত ছিল এই তিন অঞ্চলেও। এর বাইরে মনস্তাত্ত্বিক দিকেও তৈরি হয়েছিল যোগাযোগ। মন কেমনের গল্পতেও অংশ নিয়েছিল। দেহ আর প্রশান্তির জন্যও হয়ে উঠেছিল প্রয়োজনীয়। আবেগের সঙ্গে আতরের সম্পর্ক সেখানেই রচিত হয়। এসেনশিয়াল অয়েল হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আতর অতীত
আতরের সুগন্ধ মুসলিম সাম্রাজ্যের সোনালি যুগে আরও বহু দূরে সুবাস ছড়িয়েছে। আরব বিশ্বে ৮ থেকে ১৪ শতক পর্যন্ত আতর তৈরির প্রক্রিয়ার প্রসার ঘটে ব্যাপকভাবে। মুসলিম সভ্যতা বিশেষ করে আরবরা মিষ্টি ও সুবাসিত আতরের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিল। তারা বিশেষত ‘রোজ ওয়াটার’ (গোলাপজল) এবং ‘মাস্ক’ তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ভারতের বিভিন্ন রাজবাড়িতে আতর তৈরি ও ব্যবহার করা হতো; বিশেষ করে মোগল আমলে, যেখানে রাজা-মহারাজাদের শখ ছিল সুগন্ধি ব্যবহার করা। ভারতীয় আতর তৈরির প্রক্রিয়া এখনো অনেকটা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে চলে আসছে।
ভালোবাসার স্পর্শে
হাজার বছর আগের এই আতরের আবেদন ফুরায়নি কখনোই; বরং কয়েক বছর ধরে আগ্রহ বেড়েছে মানুষের মাঝে। ফ্রাগরেন্সলেস প্রোডাক্টের চাহিদার এই সময়ে আতরের প্রতি আগ্রহ খানিকটা অবাক করার মতোই। আতর তৈরিতে ব্যবহৃত হয় যেসব উপাদান, তা মূলত প্রকৃতি থেকে পাওয়া। ফুল, নানা রকম মসলা এবং ঔষধি উপাদান এগুলোর মধ্যে অন্যতম। করোনাকালের পর থেকে মানুষের মাঝে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার প্রবল প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। কৃত্রিমতা, রাসায়নিক উপাদান—এসবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দানবকে এড়িয়ে চলতে চাইছে মানুষ। শারীরিক ও মানসিক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হিসেবে অনেক চিকিৎসকই দায়ী করেছেন প্রসাধনকে। ক্যানসারের মতো রোগের কারণ হিসেবেও খুঁজে পাওয়া গেছে আর্টিফিশিয়াল ফ্রাগরেন্সের দায়। বগলে নিয়মিত বডি স্প্রে ব্যবহারে সে অংশের ত্বক যে ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা-ও জানা গেছে গবেষকদের কল্যাণে। আতরে অ্যালকোহল কিংবা সিনথেটিক এলিমেন্টস ব্যবহার করা হয় না। তাই ত্বক আর পরিবেশ—দুয়েরই ক্ষতির ঝুঁকি নেই। তৈরির প্রক্রিয়ায় আছে সেই শিকড়ের টান। ট্র্যাডিশনাল ডিস্টিলেশন প্রসেসে মনোযোগের সঙ্গে সম্পন্ন করা হয় এই পুরো যজ্ঞ। তাই আতরের আবেদন ভিন্ন।
বিলাসের তালাশ
লাক্সারি আতর বাজার ২০২৩ সালে ছিল ২২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন, যা ২০৩০ সালে ৩৪ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন হবে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। আতর শুরু থেকেই লাক্সারি ক্যাটাগরির পণ্য। অনন্য গুণে গুণান্বিত হওয়ার কারণে তার সাম্রাজ্যে কখনো চাহিদার কমতি হয়নি। হাই স্ট্যাটাসের সঙ্গে প্রথম থেকেই বিনি সুতায় বাঁধা এই সুগন্ধি। এখনো চলছে সেই জয়রথ। আগর উদ, আম্বর, জেসমিন, গোলাপ ও মাস্ক আতর বিলাসবহুল আতরের তালিকায় জ্বলজ্বলে। এই ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে বেশ কিছু পারফিউম হাউসের মাঝেও দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের আগ্রহ।
আতর সিনথেটিক ফ্রাগরেন্স নয়। তাই ত্বকে অ্যালার্জি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি নেই। অ্যালকোহল, প্যারাবেন এবং রাসায়নিক মুক্ত। তাই স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হয় না। সংবেদনশীল ত্বকের অধিকারী যারা, তারা আতর ব্যবহার করতে পারেন স্বচ্ছন্দে। আতরে প্রশান্তিও মেলে। ল্যাভেন্ডার ও চন্দন কাঠের তৈরি আতরের এই বিশেষ গুণ রয়েছে।
নব যুগে
দক্ষিণ এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের অধ্যায় পেরিয়ে আতর পৌঁছে গেছে পুরো বিশ্বে। পশ্চিমে তৈরি হয়েছে বিশাল বাজার। ধরণী থেকে পাওয়া উপাদানের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন সেখানকার ক্রেতারা। তাই রসায়নের কারিকুরিতে ভরপুর কৃত্রিম পারফিউম থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন চোখ। তবে কৃত্রিম আতরও তৈরি হচ্ছে দেদার। প্রাকৃতিক উপাদান নয়, বরং সিনথেটিক রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয় তাতে। সস্তায় বিকোয়। প্রাকৃতিক আতরের মতো সুগন্ধি সৃষ্টি করতে ডিজাইন করা হয়, তবে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া ও উপাদান একেবারে ভিন্ন। আবার ত্বকের জন্যও আরামদায়ক হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশে এভাবে তৈরি আতরের চাহিদার পারদ বেশ উঁচু। কারণ, এর দাম থাকে নাগালের মধ্যে। তাই বলে মেইড উইদ লাভ আতরের কদর কমেছে, তা কিন্তু মোটেই নয়।
মোগল সম্রাট শাহজাহান আতরের সমঝদার ছিলেন। তার প্রিয় আতরগুলোর মধ্যে গোলাপ, চন্দন, কস্তুরী ও মাস্ক উল্লেখযোগ্য। এই সুগন্ধিগুলো মোগল রাজকীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল সেই সময় থেকে। নিজের বাগানের সুগন্ধি উপকরণে তৈরি করিয়ে নিতেন এই প্রসাধন। আজও আতরের আদর কমেনি এক বিন্দু; বরং গুণপনার আলেখ্যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ।

 সারাহ্ দীনা
মডেল: অমিত
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top