skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I নতুন পণ্যে জিআই প্রাপ্তি: আশা ও বাস্তবতা

শুধুই কি একটা সনদ, একটা আইনি স্বীকৃতি! নাকি প্রাপ্তির পরিধিটা অনেক বিস্তৃত। পুরো বিষয়ে কতটা সচেতন সংশ্লিষ্টরা। লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান

আরও ২৪টি পণ্য একযোগে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) সনদ পেয়েছে বাংলাদেশ। ৩০ এপ্রিল সংশ্লিষ্টদের এই সনদ হস্তান্তর করা হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের মোট জিআই পাওয়া পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৫৫। বাংলাদেশের প্রথম জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্য জামদানিরই কেবল আছে আন্তর্জাতিক নিবন্ধন। জামদানি ছাড়া এই তালিকায় আরও আছে ৫টি ফ্যাশন পণ্য—মসলিন, টাঙ্গাইল শাড়ি, মণিপুরি শাড়ি, মিরপুরের কাতান শাড়ি এবং গোপালগঞ্জের গয়না।
নতুন করে দুই ডজন পণ্যের জিআই স্বীকৃতিতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাস্তবিকভাবে এই প্রাপ্তিতে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হবে কিংবা শিল্প ও শিল্পীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনে আদৌ সহায়ক হবে কি না। উত্তর খোঁজার আগে আমরা বরং ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই সম্পর্কে একটু বিশদে জেনে নিই।
ভৌগোলিক নির্দেশক
ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) একটি আইনি স্বীকৃতি। কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক উৎপাদন অঞ্চল এবং পণ্যটি ওই এলাকার যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশিষ্ট হয়েছে, সেটাও জিআই প্রাপ্তির ফলে আমরা জানতে পারি। এটা একধরনের মেধাস্বত্বও, যা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) ট্রেড-রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (ট্রিপস) চুক্তির আওতায় সুরক্ষিত।
জিআই স্বীকৃতিকে পুরোনো একপ্রকার হাতিয়ারও বলা চলে; কারণ, বর্তমান বিশ্বে এর মাধ্যমে কোনো দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে জিআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার এই স্বীকৃতির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখার পাশাপাশি ঐতিহাসিক মূল্যও ধরে রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হলো জামদানি (বাংলাদেশ: নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ), দার্জিলিং টি (ভারত: দার্জিলিং); শ্যাম্পেন (ফ্রান্স: শ্যাম্পেইন); পারমিজানো-রেজিয়ানো ও পেকোরিনো রোমানো পনির (ইতালি) ইত্যাদি।
যে কারণে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
জিআই সনদ কোনো দেশের জন্য শুধু সম্মানজনকই নয়, বরং এটি অর্থনৈতিকভাবে বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ভিন্ন নয়। জিআই পণ্য সাধারণ পণ্যের চেয়ে ২০%-১০০% বা তারও বেশি দামে বিক্রি হতে পারে, যদি সঠিকভাবে বাজারজাত করা হয়। বাংলাদেশের জিআই পণ্যও আন্তর্জাতিক জিআই পণ্যের মতোই উচ্চ দামে বিক্রি হতে পারে। অবশ্য সেটা নির্ভর করবে বাজারজাতকরণ, গুণগত মান বজায় রাখা এবং সঠিক ব্র্যান্ডিংয়ের ওপর। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জিআই পণ্যের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম থাকে। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী এসব পণ্যের নিরাপত্তা ও গ্যারান্টি থাকার কারণে দাম বহুগুণ বেশি হয়। বাংলাদেশের পণ্যের প্রকৃত মূল্য তখনই পাওয়া সম্ভব, যখন এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে নিবন্ধিত হয়ে সক্রিয় রপ্তানি নেটওয়ার্কে প্রবেশ করবে।
জিআই যেভাবে সাহায্য করতে পারে
 আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতি: জিআই পণ্য বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
মূল্যবৃদ্ধি: সনদপ্রাপ্ত পণ্যের দাম সাধারণত বেশি থাকে।
 স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন: জিআই পণ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোতে কর্মসংস্থান বাড়ে।
 ঐতিহ্য সংরক্ষণ: প্রাচীন শিল্প টিকে থাকার সুযোগ পায় এবং বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে নতুন করে প্রাণ পায়। পরম্পরার কারুশিল্পীরাও নতুন করে আশাবাদী হয়ে ওঠেন।
শিল্প ও শিল্পী যেভাবে উপকৃত হতে পারে
জিআই মূলত শিল্পীদের অধিকার রক্ষা করে এবং নকল করা থেকে মুক্ত রাখে। জামদানি বা টাঙ্গাইল শাড়ির বয়নশিল্পীরা বহু বছর ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে বঞ্চিত হয়েছেন। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জিআই সনদের কারণে প্রকৃত উৎপাদকদের স্বীকৃতি ও আর্থিক লাভ নিশ্চিত করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখতে হবে। এখন সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়ন সহায়তাও পাওয়া যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নতুন প্রজন্মের উৎসাহ বাড়ে ঐতিহ্যবাহী পেশায় যুক্ত হতে।
আরও যেসব সুবিধা পাওয়া যায়
জিআই প্রাপ্তি এবং এর সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে নানাভাবে সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। এই যেমন ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পণ্যের পরিচিতি তৈরি হয়। বাজার সম্প্রসারণের ফলে রপ্তানির সুযোগ বাড়ে। আবার আইনি সুরক্ষা থাকায় পণ্যের অনুকরণ ঠেকানো যায়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ মূল্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নে স্থানীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান বাড়ে।
জিআই প্রাপ্তির বৈশ্বিক সুফল
ফ্রান্সের জিআই পণ্যের মধ্যে আছে শ্যাম্পেন ও রকোফোর চিজ। এই দুটি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তারা বিলিয়ন ডলার আয় করছে। গেল অর্থবছরেই ৫৮০ কোটি ইউরো আয় করেছে শ্যাম্পেন রপ্তানি করে। আর রকোফোর চিজ থেকে এসেছে ৬৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে ভারতের জিআই পণ্যের সংখ্যা চার শতাধিক। এগুলোর মধ্যে গত অর্থবছরে কেবল দার্জিলিং চা রপ্তানি করে ৭০০ কোটি রুপির বেশি আয় হয়েছে। জিআই পণ্যের মানোন্নয়ন এবং এর বিপণন সুবিধা নিশ্চিয়ে ভারত বিভিন্ন রাজ্যে জিআই হাব গড়ে তুলেছে।
চীনে প্রচুর ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ও হস্তশিল্প পণ্য জিআই সনদপ্রাপ্ত। সরকারিভাবে বিশাল বিনিয়োগ করা হয়েছে জিআই সুরক্ষায়। ২০২৩ সালে চীনের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যগুলোর সরাসরি বার্ষিক উৎপাদন মূল্য ১৩ হাজার ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। একই বছর কেবল লিউইয়াং আতশবাজির রপ্তানি মূল্য ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ইউয়ান। ইতালি ও গ্রিসে পনির, ওয়াইন, অলিভ অয়েল—সবকিছুই জিআইয়ের আওতায়। পারমিজানো-রেজিয়ানো ও পেকোরিনো রোমানো পনির রপ্তানি করে গেল অর্থবছরে ইতালির আয় ছিল ৮০০ কোটি ইউরো।
অন্যান্য দেশও জিআই পণ্য রপ্তানি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আয় করে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশও নিজেদের পণ্যকে প্রিমিয়াম অবস্থানে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ৫৫টি জিআই পণ্যের মধ্যে কয়টা আসলে রপ্তানি হয় এবং তা থেকে বছরে কত টাকা আসে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা কারণ কী? চলুন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
যে কারণে পিছিয়ে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ৫৫টি পণ্য জিআই সনদ পেয়েছে। তারপরও বিশ্ববাজারে এগুলোর কোনো অবস্থানই নেই। এর পেছনে আছে কিছু স্পষ্ট কারণ: ১. প্রযুক্তি ও মান নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, ২. প্রশিক্ষণের অভাব, ৩. ভোক্তা ও উৎপাদক পর্যায়ে সচেতনতার অভাব, ৪. দুর্বল ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং এবং ৫. আইন প্রয়োগে দুর্বলতা।
বাংলাদেশের করণীয়
জিআই সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই বাস্তবানুগ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া কোনোভাবে এর সুফল আমরা নিতে পারব না। এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপগুলো হতে পারে:
 জাতীয় জিআই নীতিমালা বাস্তবায়ন: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
 প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: জরুরি ভিত্তিতে প্রান্তিক কারুশিল্পী ও কৃষকদের জিআই সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।
 মান নিয়ন্ত্রণ ও টেস্টিং ল্যাব: জিআই পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা।
 রপ্তানি সহায়তা: বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা রপ্তানিমুখী জিআই হাব গড়ে তোলা।
 আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা: নকল পণ্য প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা দ্রুত ও কার্যকরভাবে গ্রহণের ব্যবস্থাপনা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জিআই পরিকল্পনা হওয়া উচিত প্রযুক্তিনির্ভর, গবেষণাভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। এরই আলোকে কিছু প্রস্তাব:
 জিআই ইনোভেশন সেন্টার স্থাপন: মান নিয়ন্ত্রণ, গবেষণা ও পণ্যের ডিজাইন উন্নয়নে এটি হতে পারে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান।
 ডিজিটাল জিআই রেজিস্ট্রি তৈরি: একটি ওয়েবভিত্তিক তথ্যভান্ডার, যেখানে প্রতিটি জিআই পণ্যের বিস্তারিত থাকবে। সেটা কেবল বাংলায় নয়, বরং ইংরেজি তো বটেই; প্রয়োজনে আরও একাধিক ভাষায় থাকতে পারে।
 আঞ্চলিক জিআই হাব গঠন: বিভাগভিত্তিক জিআই উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে উৎপাদকেরা প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পাবেন।
 জিআই পণ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন: ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ডব্লিউআইপিও ও ডব্লিউটিওর সঙ্গে সমন্বয় করে সব জিআই পণ্যের আন্তর্জাতিক নিবন্ধন জরুরি। কারণ, এখন পর্যন্ত ৫৫টির মধ্যে মাত্র একটির (জামদানি) আন্তর্জাতিক নিবন্ধন আছে।
যেভাবে শুরু
বাংলাদেশে জিআই প্রক্রিয়া শুরুর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। সেটা এখানে উল্লেখ মনে হয় না বাহুল্য হবে। উপ্পাডা জামদানির ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জন্য ভারত আবেদন করে ২০০৮ সালের ১০ এপ্রিল; আর স্বীকৃতি পায় ২০০৯ সালে। বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় ২০১১ সালে। তখন পর্যন্ত জিআই নিয়ে আমাদের কোনো ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। এমনকি আলাদা কোনো বিভাগও ছিল না। অথচ ভারত এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করে সেই ১৯৯০ সালে। এর আগে প্রতিটি দেশকে নিজের আইন ও বিধিমালা তৈরি করতে হয়। আমরা আইন করেছি ২০১৩ সালে, আর বিধিমালা করতে করতে ২০১৫ সাল গড়িয়ে গেছে।
এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদই প্রথম ভারতের উপ্পাডা জামদানি নিবন্ধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে ভারতের ওই আবেদন স্থগিতও করে। পরবর্তীকালে সরকারকে জামদানির জিআই নিবন্ধনের আবেদনে সহায়তা করে। এর আগে কারুশিল্প পরিষদের উদ্যোগে ব্র্যাকের পৃষ্ঠপোষকতায় একটা গবেষণা চালানো হয় সিপিডির মাধ্যমে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতেখার ইকবাল পরিচালিত সেই গবেষণাপত্রে প্রথম জিআইয়ের জন্য আলাদা বিভাগের পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই গবেষণাপত্রের নাম ছিল ‘প্রোটেক্টিং বাংলাদেশ’জ জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন ইন্টারেস্টস: দ্য কেস অব জামদানি’।
এরই মধ্যে ২০১৩ সালে আমাদের জামদানি বয়নকৌশলকে ইউনেসকোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এটা এখন উপ্পাডা জামদানি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। উপ্পাডাডটকম নামে একটি সাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউনেসকো তাদের বয়নপদ্ধতিকে ওই স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব আমাদের এখানে মনিটরিং করার এবং এ নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। অথচ সরকারি তরফেই এর সুরাহা হতে হবে।
মজার বিষয় হলো, ক্র্যাফটস কাউন্সিল অব অন্ধ্র প্রদেশের (সিসিএপি) ওয়েবসাইটে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘একসময় উপ্পাডা জামদানি বলে কিছুই ছিল না। সেখানকার বয়নশিল্পী প্লেইন শাড়ি বুনতেন। এরপর সেখান থেকে তিনজন বয়নশিল্পী বাংলাদেশে এসে জামদানি বোনার কৌশল শিখে গিয়ে সেখানে জামদানি বোনা শুরু করেন।’
অথচ আমাদের তাঁতের সঙ্গে ওদের তাঁতের মিল নেই; ওরা জ্যাকার্ডে বোনে; আমরা পিটলুমে। মোটিফে মিল নেই; এমনকি বয়নকৌশলেও। উপ্পাডা জামদানি অনেকটা ট্যাপেস্ট্রির মতো। কোনোভাবে ওই শাড়ি জামদানি হতে পারে না। আবার বাংলাদেশ থেকে শিখে যাওয়ার বিষয়টা তারা স্বীকার করলেও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের আবেদনে সেটা উল্লেখ করা হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বাংলাদেশ থেকে শিখে যাওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর কিছু কেন জানল না। জামদানিপল্লিতে তারা শিখল, অথচ সেটা কারও নজরে এলো না! এমনকি তারা কাদের মাধ্যমে এলো, কেন সেটা তাঁত বোর্ডকে জানানো হলো না ইত্যাদি নানা প্রশ্নের উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। এত দিন পরে হলেও এর তদন্ত হওয়া উচিত।
২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর জিআই সনদ পায় জামদানি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিগত সরকার ভারতের উপ্পাডা জামদানি জিআই বাতিলের ব্যবস্থা না করে ছেড়ে দেয়। সেই সময়ের শিল্পসচিব বলেছিলেন, ওদেরটা ওরা করেছে, আমরা আমাদেরটা করেছি। ওদের বিষয়ে আমাদের নাক গলানোর প্রয়োজন নেই।
জামদানির পর দ্বিতীয় বস্ত্র হিসেবে মসলিন জিআই পায়। এরপর টাঙ্গাইল নিয়ে গড়িমসির সুযোগ নেয় ভারত। যদিও ভারতের আবেদন ক্রটিপূর্ণ ও মিথ্যা তথ্যে ভরা। কারণ, তারা টাঙ্গাইলের উৎপত্তি প্রসঙ্গে বেঙ্গল নামক স্থানের কথা বলেছে। যদিও বেঙ্গল নামক ভূখণ্ডের কোনো বাস্তব উপস্থিতি পৃথিবীতে নেই। তা ছাড়া তারা মোটিফ হিসেবে জামদানির নাম উল্লেখ করেছে। অথচ জামদানি কোনো মোটিফ নয়, বরং একটি ঐতিহ্যবাহী বয়নপদ্ধতি।
জামদানির পর টাঙ্গাইল, তারপর মসলিনের জিআই নিয়েছে ভারত। টাঙ্গাইলের ব্যাপারে মাদ্রাজ হাইকোর্টে একটা রিট হয়েছে। অথচ মসলিন নিয়ে কিছুই করা হয়নি।
যাহোক, জিআই পণ্য নিয়ে যে ধরনের সচেতনতা দরকার ছিল, তা আমাদের নেই। নেই সরকারি উদ্যোগ, যাতে সচেতনতার পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে ডিজাইনাররা যথেচ্ছাচার করছেন। একটা বয়নের মোটিফ আরেকটা বয়নে ব্যবহার করে জগাখিচুড়ি পাকাচ্ছেন। ব্যবসার নামে নিজেদের ইচ্ছেমতো মোটিফ দিয়ে একটি বয়নের ঐতিহ্য ও পরিচয়কে নষ্ট করা হচ্ছে। অন্যদিকে কোনো একটি সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত না হওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছে। তাতে কাজের কাজ হচ্ছে না; বরং বিভিন্ন সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হচ্ছে।
আরও একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশের জিআই পণ্যগুলোর মধ্যে জামদানি ছাড়া একটারও আন্তর্জাতিক নিবন্ধন নেই। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) মাধ্যমে জেনেভায় আন্তর্জাতিকভাবে নিবন্ধিত হয়। এরপর আর একটার ক্ষেত্রেও এই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে জিআই পণ্যের আবেদনের ক্ষেত্রে ওই কারুশিল্পী গোষ্ঠী এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। ফলে প্রতিটি জার্নালে থেকে যাচ্ছে তথ্যবিভ্রাট কিংবা অসম্পূর্ণ তথ্য। তাতে করে আবেদন দুর্বল হচ্ছে। জার্নালগুলোর এই তথ্য ঘাটতি দূর করাও আবশ্যক।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে মিরপুর কাতান শাড়ির বয়নশিল্পী ও বয়নকারুশিল্পীদের কথা। কয়েক দিন আগে সেখানকার পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছি। কথা বলেছি তাদের সঙ্গে। জিআই কী, তারা সেটাই জানেন না। এটা কী কাজে লাগে, এতে তাদের জীবনমানের কোনো উন্নতি হবে কি না, তা-ও তাদের জানা নেই। এমনকি জিআইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহেও তাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। ফলে জার্নালে থেকে গেছে তথ্য ঘাটতি।
পাশাপাশি এসব জার্নাল এত বছরেও ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয়নি। ফলে বিদেশিদের পক্ষে আমাদের পণ্য সম্পর্কে জানা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, সময়াভাবে সংযুক্ত করা সম্ভব হয় না—এই যুক্তি খোঁড়া বললেও কম বলা হয়। কারণ, আউটসোর্স করেও এগুলো করা যায়। তবে হ্যাঁ, তাদেরও লোকবলের অভাব আছে।
এই যেমন ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ এবং ‘বাংলাদেশ শিল্প-নকশা আইন, ২০২৩’—এ দুটি আইনে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি প্রদান ও নিবন্ধনের জন্য পৃথক একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠার কথা বলা থাকলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরকে (ডিপিডিটি); কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও সংস্থাটি সে কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি।
জানা গেছে, আলাদা ইউনিট না থাকায় স্থায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়া যায়নি। ফলে দক্ষ জনবলও তৈরি হয়নি। ডিপিডিটির কর্মকর্তাই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জিআই স্বীকৃতি নিয়ে কাজ করছেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির জিআই-সংক্রান্ত কাজ অনেকটা ধীরগতিতে চলছে এবং নথিপত্র সংরক্ষণ নিয়েও প্রায়ই জটিলতা তৈরি হয় বলে অভিযোগ আছে। অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর এসব নিয়েই আমরা পদে পদে ঝামেলায় পড়ব।
অতঃপর
বাংলাদেশ কোনো সন্দেহ নেই এক অপার সম্ভাবনার দেশ। আর জিআই পণ্যের ক্ষেত্রেও সেই সম্ভাবনা অপরিমেয়। প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। কেবল জিআই পাওয়া ফ্যাশন পণ্য নয়; বরং সব পণ্যের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগে সুফল মিলবে, তা হলফ করে বলা যায়। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিকতা একান্ত আবশ্যক; না হলে আমরা যতই বলি না কেন, কোনো ফল হবে না; বরং সেই ট্র্র্যাডিশন সমানে চলতে থাকবে।
প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন, ভৌগোলিক নির্দেশক শুধু একটি সনদ নয়, এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির সুরক্ষাবলয়। জামদানি কিংবা মসলিন কেবল কাপড় নয়, এগুলো আমাদের ইতিহাসের জীবন্ত নিদর্শন। তাই জিআই পণ্যের সুরক্ষা, বিপণন ও বৈশ্বিক সম্প্রসারণে আশু উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।
তবে সমান্তরালে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে শেয়ারড লিগ্যাসি বা অভিন্ন উত্তরাধিকারের বিষয়টির নিষ্পত্তি একান্ত আবশ্যক। এই দুটি শব্দের সুযোগ নিয়ে তাদের আগ্রাসনও প্রত্যাশিত নয়।
পরিশেষে বলি, সঠিক কৌশল অবলম্বন করে এবং যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে জিআই ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তোলা সম্ভব। আর সেটা করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপথই কেবল বদলাবে না, বরং বিশ্বসভায় আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: সাংবাদিক; টেক্সটাইল হেরিটেজ এক্সপার্ট

মডেল: এফা ও তৃণ
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: বেলওয়ারি বাই ব্লুচিজ ও মাহমুদা শাড়ি কুটির
ছবি: সালেক বিন তাহের ও ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top