এডিটর’স কলাম I রক্তের আরজি
১৪ জুন। ওয়ার্ল্ড ব্লাড ডোনার ডে বা বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। রক্ত ও রক্তজাত পণ্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং স্বেচ্ছাসেবী, অবৈতনিক রক্তদাতাদের ধন্যবাদ জানাতে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়
প্লাজমা বা রক্তরস নামে পরিচিত একটি প্রোটিনসমৃদ্ধ তরল দিয়ে দেহে গড়ে ওঠে রক্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্যমতে, মানবদেহের মোট ওজনের ৭ থেকে ৮ শতাংশ রক্ত। রক্তের প্রাথমিক কাজ কোষকলায় অক্সিজেন, পুষ্টি ও প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহের পাশাপাশি বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করা। দেহে হরমোন এবং অন্যান্য পদার্থকে কলা ও অঙ্গগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব রক্তই সামলায়। প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। তাই তো রক্ত নিয়ে কালে কালে সৃষ্টি হয়েছে নানা শিল্প-সাহিত্য। কখনো একে উপমা হিসেবে করা হয়েছে ব্যবহার; কখনোবা প্রত্যক্ষ অর্থ বোঝাতে। এভাবেই ‘রক্ত দিন, জীবন বাঁচান’—খুব চেনা স্লোগান হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। এর তাৎপর্য ব্যাপক। কেননা, রক্তদান বাঁচিয়ে তুলতে পারে মুমূর্ষু প্রাণ।
দুই
রক্তদান নিয়ে অনেকের মাঝে নানা বিভ্রান্তি ও ভয় ছড়িয়ে থাকে। এসব বিপত্তির ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো সুইয়ের ভয়। অনেকে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দেখলেই ঘাবড়ে যান। অথচ দক্ষ কোনো চিকিৎসক বা নার্স কারও শিরায় এই সুই ফোটালে তা ছোট্ট একটি পিঁপড়ের কামড়ের চেয়ে বেশি ব্যথা সৃষ্টি করে না। অন্যদিকে, সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত টেনে নেওয়ার সময় সাধারণত তা টেরই পাওয়া যায় না। আবার কারও কারও মনে রক্ত দিলে অসুস্থ কিংবা দুর্বল হয়ে পড়ার শঙ্কা কাজ করে। বাস্তবে কিন্তু এর উল্টো। বরং বিশেষত ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী, গলার ক্যানসারসহ বেশ কিছু রোগের ঝুঁকি কমাতে রক্তদান সাহায্য করে। কেননা, রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বোন ম্যারো নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। তাই বেড়ে যায় সুস্থতা, প্রাণবন্ততা আর কর্মক্ষমতা। এর বাইরেও কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে; যেগুলো অনেককে রক্তদানে নিবৃত্ত করে। যেমন পরিবারের বাধা, নিজের রক্তের গ্রুপকে কমন গণ্য করে সহজলভ্য ভাবা, রক্তদান প্রক্রিয়ায় কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা প্রভৃতি। কিন্তু এসবই যে মামুলি অজুহাত, বলা বাহুল্য।
তিন
বয়স ১৮ থেকে ৬৫, দেহ ও মনে সুস্থ—এমন যে কেউ নিয়মিত রক্তদান করতে পারেন। তবে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। রক্তদাতা কখনো অনিরীক্ষিত রক্ত কিংবা রক্তের উপাদান গ্রহণ করলে, শিরায় কোনো রকম নেশাযুক্ত ওষুধ নিলে এবং অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কে জড়ালে রক্ত দেওয়া যাবে না। আরও আছে। শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১২ গ্রাম/ডিএলের নিচে; নাড়ির গতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০-এর বাইরে কিংবা হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত; রক্তচাপ ডায়াস্টোলিক ৫০ থেকে ১০০ এবং সিস্টোলিক ১০০ থেকে ১৮০ মিমি মার্কারি সীমার বাইরে; শরীরের তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রির ওপরে; সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, ফ্লু বা অন্য কোনো রোগের সংক্রমণে আক্রান্ত; হৃদ্রোগ, ক্যানসার, কিডনির অসুখ, অ্যাজমা বা শ্বাসযন্ত্রের অসুবিধা, টিবি, অ্যালার্জি; মৃগীরোগ, জ্ঞান হারানো কিংবা কোনো মানসিক ব্যাধি অথবা ডায়াবেটিস বা থাইরয়েডে ভুগলে রক্ত দেওয়া বারণ। এর বাইরে সময়নির্ধারিত কিছু বিধিনিষেধও রয়েছে। ম্যালেরিয়া এনডেমিক জোনে (বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম) ভ্রমণের তিন মাস, কোনো টিকা গ্রহণের এক মাস, রেবিস বা হেপাটাইটিস বি-এর টিকা গ্রহণের ছয় মাস, দাঁতের চিকিৎসা চলার ২৪ ঘণ্টা এবং কোনো সংক্রামক রোগের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ১৪ দিন সময়সীমা পেরোনোর আগে রক্ত দেওয়া মানা। তা ছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ও ব্রেস্ট ফিডিং করানোর সময় করা যাবে না রক্তদান। অন্যদিকে, গর্ভপাতের ছয় মাসের মধ্যেও রক্ত না দেওয়াই শ্রেয়।
চার
নিয়মিত রক্তদানের উপকারিতার শেষ নেই—চিকিৎসাবিজ্ঞান এমনটাই নিশ্চিত করে। একদিকে যেমন আপনার দেওয়া রক্ত অন্যের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে বলে আপনি অপার্থিব ও নির্মল প্রশান্তির অনুভূতি লাভ করবেন; অন্যদিকে নিজের দেহও থাকবে তুলনামূলক অধিক সুস্থ। কমে যাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি। তা ছাড়া আয়রনের ঘাটতি, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, সিফিলিস প্রভৃতি অপ্রত্যাশিত ব্যাধি আপনার শরীরে ঘাপটি মেরে আছে কি না, রক্তদানের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গেলে তা সহজে ও বিনা মূল্যে শনাক্ত করতে পারবেন। আগে থেকে উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে নিয়মিত রক্তদান কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনবে। সুস্থতার নিশ্চয়তা মিলবে অনেকখানি।
পাঁচ
১৪ জুন। ওয়ার্ল্ড ব্লাড ডোনার ডে বা বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। রক্ত ও রক্তজাত পণ্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং স্বেচ্ছাসেবী, অবৈতনিক রক্তদাতাদের ধন্যবাদ জানাতে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ব্লাড ডোনার অর্গানাইজেশনস এবং ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব ব্লাড ট্রান্সফিউশনের উদ্যোগে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে থাকলে নিয়মিত রক্তদানে অংশ নিন; অন্যদেরও উৎসাহিত করুন। কেননা, আপনার দেওয়া রক্ত অনেকের প্রাণপ্রদীপ টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
সবার মঙ্গল হোক।