কভারস্টোরি I আপ্যায়ন আখ্যান
অতিথি আপ্যায়নে বাঙালির সুনাম বেশ পুরোনো। আর তা যদি হয় ঈদের মতো কোনো বড় উপলক্ষ, কখনো কখনো বাড়াবাড়ি পর্যায়েও গিয়ে ঠেকে! এই ভূখণ্ডের গণমানুষের ঈদ এবং তাতে অতিথি আপ্যায়নের শিকড় অনুসন্ধান এবং বর্তমান চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন আল মারুফ রাসেল
উৎসব আর আপ্যায়ন—দুটি ব্যাপার আলাদা করে দেখা বাঙালি সংস্কৃতিতে পুরো অসম্ভব। বিশেষত কৃষিসমাজে। অবশ্য পুরো বিশ্বেই কৃষিসমাজ মুখ্য ছিল, এই ব্রিটিশ-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা জয়ের আগপর্যন্ত। পলাশীর যুদ্ধ পৃথিবীর বুকে যে শিল্পায়ন ও করপোরেট যাত্রার সূচনা ঘটিয়েছিল, তার আগের প্রায় ১২ হাজার বছরের কৃষিযুগকে ঠেলে, বাংলা ছিল সেই শিল্পায়ন ও করপোরেট পরীক্ষা-নিরীক্ষার গবেষণাগার। যেহেতু বাংলা ছিল কাঁচামালের জোগানদাতা, তাই বাংলা থেকে কৃষি পুরোপুরি হারায়নি; কেবল ধরন বদলেছে।
বাংলার উৎসবগুলো সবই সর্বজনীন প্রকৃতির। এর একটা বড় কারণ হয়তো কৌলীন্য প্রথা বাংলায় সেন শাসনের আগে যেমন ছিল না, তেমনি পরে মুসলিমদের আগমনের পর সেই কৌলীন্য প্রথায় খানিকটা ভাটা পড়ে; কারণ, নিম্নবর্গের হিন্দু, বৌদ্ধদের ধর্মান্তর। কিন্তু তার চেয়ে বড় কারণ আলো-হাওয়া-জল-প্রকৃতি—সব মিলিয়ে বাংলার কৃষিজীবন। হয়তো ইউটোপিয়ান একটি এলাকা নয়; কিন্তু কৃষিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায় হিসেবে তারা এক, যূথবদ্ধ জীবনে আবদ্ধ ছিল।
বাংলার ঈদ নিয়ে আলাপে কেন এই কৃষিজীবনকে টেনে আনা, তা বলতে গেলে আস্ত একটি বই লেখা যাবে। এখানে অল্প কথায় বলে দিই, থিতু হয়ে বসতি গড়ে যখন উর্বরা বাঁকা চাঁদে (আলহিলালু হাসিবু এলাকা তথা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট তথা আজকের রাজনৈতিক মানচিত্রের ইরাক, ইসরায়েল, জর্ডান, লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক ও পশ্চিম ইরান) কৃষিকাজ করতে শুরু করেছিলেন কিছু মানুষ, তখন থেকেই কৃষি পরবের শুরু; যা একপর্যায়ে চাঁদের নানাবিধ হিসাব আর সঙ্গে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপকরণ মিলে পরিণত হয়েছিল কৃষি উৎসবে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে হারানের (দক্ষিণ তুরস্কের একটি জায়গা, সিরিয়ার সীমান্তে) আদি ‘আল ফিৎর’ উৎসব; আর নানা ছুতায় পশু উৎসর্গ করার রীতি তো একেবারে প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের প্রিয় ব্যাপার। বোলান গিরিপথের ঠিক নিচে মেহরানগড়ে (বেলুচিস্তানে) প্রায় ৯ হাজার বছর আগে একদল মানুষ কৃষিকাজের শুরু করেছিলেন। সেই ঢেউ বাংলায় আসতে বেশি সময় নেয়নি। বাংলার আদি প্যাগান কৃষিসমাজে জৈন, বৈদিক, বৌদ্ধ, নানা ধরনের প্রভাবের একেবারে শেষ ধর্মীয় প্রভাব হিসেবে আসে উর্বরা বাঁকা চাঁদের দেশের ধর্ম ইসলাম, তেরো শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। পৃথিবীর প্রায় দুই প্রান্তের মাঝে মিল ছিল একটাই—কৃষিসংস্কৃতি। তবে কৃষিতে কৃষিতে যে মিল বা মিথস্ক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল, সেটা আর হয়ে ওঠেনি নানা কারণে।
বাংলার ঈদ উদ্যাপনের সংস্কৃতি নিয়ে বলতে গেলে অধুনা সব হিসাব টানতে হয়। কারণ, বাংলায় প্রথম দিকে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল কম; অনেক লেখক ধর্মীয় আবেগের আতিশয্যে বলে ফেলেন, ইখতিয়ার উদ দিন বাখত-ইয়ার খালজির সময় বা তারও আগে সুফিদের হাত ধরে ঈদের উৎসব শুরু হয়েছিল বাংলায়। অথচ এ তথ্য চরম ত্রুটিপূর্ণ। উৎসব হতে মানুষ লাগে; তাই বলা ভালো, ছোট্ট একটা দলের অনুষ্ঠান হিসেবেই সেটা ছিল বহুকাল, অন্তত গুরকানি বা তিমুরিদদের (যাদের ইংরেজরা মোগল বলে ডাকে) বাংলা দখলের আগপর্যন্ত বাংলায় ঈদ উৎসবের কোনো বর্ণনা নেই; সুলতানি আমলে তো নয়ই, গুরকানিদের বাংলা দখলেরও দীর্ঘদিন পরে ঘটা করে উৎসব হিসেবে ঈদ উদ্যাপিত হতে শুরু করেছিল। ঢাকায় প্রথম ঈদগাহ দেখি ১৬৪০ সালে তৈরি, ধানমন্ডিতে। বাংলার সুবাহদার শাহ সুজার আদেশে তার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাশিম পাণ্ডু নদীর ধারে সেটি তৈরি করেছিলেন। তবে সেই ঈদগাহ কি আমজনতার জন্য ছিল? হেকিম হাবিবুর রহমান এর উত্তর দিয়েছেন, ‘কেবল নবাব, উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী, কাজি-হাকিম এবং তাদের বন্ধুবান্ধবই ঈদগাহে যেতেন।’ পরে আঠারো শতকের শুরুর দিক থেকে সিলেট, কিশোরগঞ্জে বড় বড় ঈদগাহ তৈরি হলে ঈদ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত হতে শুরু করেছিল।
ঢাকার গুরকানি ঈদ নিয়েও তেমন বিস্তারিত লেখা পাওয়া যায় না; খাবার নিয়ে তো ইতিহাসবিদেরা একেবারেই নীরব! ঢাকায় যে ঈদ মিছিল হতো, সেটি ঢাকার সুবাহদার ও খোরাসানি শিয়া সম্প্রদায়ের হাত ধরে। সুলতানি আমলে ঢাকায় ঈদ মিছিল হতো, এমন কোনো তথ্য কোনো ঐতিহাসিকের কাছেই নেই। গুরকানি বা মোগল আমলের ঈদের খানিকটা বিবরণ মেলে মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বি’ থেকে। তা-ও সেখানে খাবার বা খাবার পরিবেশনের কোনো বিবরণ নেই। তবে ঢাকায় আসা সুবাহদার ও পরে নাইব-ই-নাজিমরা দিল্লি দরবারের অনুসরণ করতেন আর তারা কোনো না কোনোভাবে সম্রাট বা দরবারেরই প্রভাবশালী কারও আত্মীয় হতেন। সেই হিসেবে বাহাদুর শাহ জাফরের উৎসবের খাবার পরিবেশন প্রাসঙ্গিক হলেও হতে পারে। ‘দিল্লি: চার উপাখ্যান বই’ থেকে পাঠ করা যাক, ‘সম্রাট খাবার নিয়ে আসার আদেশ দিতেন আর পরিচারিকারা রিলে পদ্ধতিতে একে অন্যকে খবর সরবরাহ করে জানিয়ে দিতেন, “ভদ্রমহিলারা, নি’মাতখানা প্রস্তুত করুন। রাজকীয় খাবার নিয়ে আসুন।” পরিচারিকারা তাদের মাথায় করে অনেকগুলো ঝুড়ি নিয়ে আসতেন বৈঠকের দিকে। তারা রিলে পদ্ধতিতে মসৃণভাবে খাবারগুলোকে রাজকীয় দস্তরখানে পরিবেশন করতেন। রসুইঘরের পরিচারিকারা সাত গজ লম্বা ও তিন গজ চওড়া চামড়ার টুকরো বিছাতেন। তার ওপরে বিছিয়ে দিতেন সাদা কাপড়, আর তার মধ্যিখানে, আরেকটি দুই গজ লম্বা, দেড় গজ চওড়া আর ছয় আঙুল উঁচু কাঠের টেবিল রাখা হতো। সিল করা খাবারগুলো টেবিলে রাখার আগে আরেক প্রস্থ চামড়া আর টেবিলের আচ্ছাদন রাখা হতো। রসবতীর তত্ত্বাবধায়ক সম্রাটের সামনে বসতেন, তিনিও তার নাশতা এখানেই করতেন। দস্তরখানের বাকিটা সম্রাটের স্ত্রী, শাহযাদা ও শাহযাদিদের জন্য বরাদ্দ থাকত।…খাওয়ার সময় সাধারণত মাটিতে বসেই খাওয়ার রীতি। অকৃত্রিম সাদা চাঁদনি বিছিয়ে দেওয়া হতো মেঝেতে, আর মাঝে মাঝে গালিচা আর পাশবালিশ দেওয়া হতো তার ওপর। ঘরের ওপর দয়া আর সমৃদ্ধি বৃদ্ধির দোয়া লেখা দস্তরখান পেতে দেওয়া হতো চাদরের ওপরে। পরিবারের সদস্যরা দস্তরখানের দুপাশে সারিবদ্ধ হয়ে বসতেন, আর মাঝে সবার ওপরের দিকে বসতেন পরিবারের কর্তা। একটি নিচু, কাঠের টেবিল সম্রাটের জন্য দস্তরখানের ওপর রাখা হতো, সেটাও কাপড়ে ঢাকা থাকত। খাবারে মাছি বসা থেকে রেহাই পেতে তারের জালির ঢাকনা ব্যবহার করা হতো। খাবার যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য নি’মাতখানা ব্যবহৃত হতো (এখনকার দিনের রেফ্রিজারেটরের বদলে)। গরমের দিনে এর পায়াগুলো ডুবানো থাকত পানিভর্তি পাথরের বাটিতে, খাবার শীতল রাখার জন্য। দিনে কেবল দুই বেলা খাবার খাওয়া হতো। পুরুষ ও মহিলারা সকাল ১০টা বা ১১টা পর্যন্ত পান চিবোতেন আর হুক্কা টানতেন, যখন দিনের প্রথম খাবার পরিবেশিত হতো। দ্বিতীয় খাবার দেওয়া হতো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। ভোজে অনেক ধরনের খাবার পরিবেশিত হতো।’
সম্রাটের জায়গায় ঢাকার সুবাহদারকে বসিয়ে দিলেও কাছাকাছি ধরনের ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গুরকানি শাসকদের খাবার পরিবেশিত হতো সোনা বা রুপার পাত্রে। এমনকি তামারও হতো। কারণ, খাবারে বিষ প্রয়োগ করা হলে ধাতুর পাত্রে সেটা ধরা পড়ত। কদাচ পোর্সেলিনের বা সিরামিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেগুলো একেবারেই ব্যতিক্রম। তারও আগে বাগেরহাটের খানজাহান আলীর বসতভিটায় আমরা প্রচুর পরিমাণে সেলাডনের তৈরি প্লেট পেয়েছি। যদিও বাংলায় সাধারণ মানুষের তৈজসপত্র মাটিরই হতো; আর তার বহু প্রমাণ আমরা পাই। আধুনিক সময়ে এসে সাধারণ মানুষ সিরামিক, কাচ, এমনকি প্লাস্টিকও ব্যবহার করছে।
কী কী খাওয়া হতো, সেই তালিকা দিতে গেলে এই লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। আফগান, পারসিক, আরবি, বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতির একখানা হাঁড়ি ছিল বাংলা। বাদশাহি হিসেবে চব্বিশ-পঁচিশ রকমের রুটি, চার-পাঁচ রকমের নান-খাটাই, চব্বিশ-পঁচিশ রকমের পোলাও-বিরিয়ানি-খিচুড়ি, বারো রকমের মিষ্টান্ন, পাঁচ-ছয় রকমের হালকা খাবার, ছয় থেকে আট রকমের কোরমা ও কারি, দইয়ের তৈরি পাঁচ-ছয় রকমের খাবার, ডাল-চাটনি-ভর্তা মিলিয়ে আরও দশ থেকে বারো ধরনের খাবার, দশ রকমের কাবাব, দশ ধরনের হালুয়া, দশ রকমের মোরব্বা, কয়েক রকমের ফল আর বিশ ধরনের মিষ্টি। গুরকানি সম্রাটের কাছাকাছি আত্মীয় হলে খাবারটা কাছাকাছি ধরনেরই হতো হয়তোবা। আর দূরের আত্মীয় বা অনাত্মীয় হলে যদি এর অর্ধেক খাবারও হয়, তা-ও কম কিসে।
তবে যদি আক্ষরিকভাবে ঈদকে আমজনতার উৎসব বলতে হয়, তাহলে সেটির সূচনা গত শতকের তিনের দশকের আগে নয়। এ ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতি গবেষক শামসুজ্জামান খানের নিবন্ধের খানিকটা উল্লেখ করতে হয়: ‘১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকায় এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ঔদার্যে বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে নতুন শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের উদ্ভব ঘটে, তাদের হাতেই বাঙালি মুসলমানের ধর্ম-সামাজিক আনন্দ-উৎসব হিসেবে সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপযপূর্ণ ঈদ উৎসবের সূচনা। নব্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ঈদ উৎসবকে সর্বজনীনতা জ্ঞান করে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এবং আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে রেকর্ড করা গান: “ও মন, রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ”। ১৯৪০-এর দশক থেকে শুরু হয়ে বাংলার ঈদ উৎসব ধীরে ধীরে ধর্ম-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে বৃহৎ থেকে বিশাল আবর্তনে রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে বাংলার আধুনিক ঈদ উৎসবের “সেকাল” সত্তর-আশি বছরও এখন পর্যন্ত অতিক্রম করেনি (এখন প্রায় নব্বই বছর)।’
বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের জন্য নতুন উৎসবের উদাহরণ হিসেবে আমরা ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকের পুরোনো ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ থানার পুলিশ কর্মকর্তা খন্দকার আবু তালেবের আত্মজীবনীতে একটু চোখ দিতে পারি: ‘রোজা ও ঈদের চাঁদের খবরাখবর তখন কলকাতা হতে প্রচার করা হতো।…. ফুলপিঠা তৈয়ার করার সময় বউয়েরা “প্রিয় স্বামী” আর অবিবাহিত মেয়েরা, “বিবাহ ও প্রজাপতি” এঁকে রাখত। ঈদের দিনে যুবক-যুবতী বন্ধু-বান্ধবীদের পাত্র দেখার জন্যই এ ধরনের ফুলপিঠা তৈয়ার করা হতো।’
তৎকালীন পূর্ব বাংলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে বিত্তহীনতা ও নগদ পয়সার অভাব থাকায় দরিদ্র কৃষি পরিবারে ঈদ উৎসবের কোনো জৌলুশ ছিল না। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকেও গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের যারা শহরে চাকরি, ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা ওকালতি করতেন, তাদের বাড়িতে ঈদের দিনের খাদ্যতালিকায় পোলাও-কোরমা-জর্দার দেখা মিলত। আর বাবু সংস্কৃতির আদলেই দেখনদারির একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু বিপুলসংখ্যক দেহাতি মানুষ প্রায় ভুখানাঙ্গা অবস্থায়ই ঈদের দিনটি অতিক্রম করত; হয়তো-বা দু-এক সম্ভ্রান্ত বাড়ির আঙিনায় সারি করে বসে কলাপাতায় কিছু খাবারেরও ব্যবস্থা হয়ে যেত। আর ছিল মসজিদের শিরনি।
তবে ওপরের কটি অনুচ্ছেদের উল্টো চিত্রও আছে। যেমনটা আগেই বলেছি, কৃষিজীবীদের যূথবদ্ধ জীবন হোক কিংবা জমির মালিকের দাক্ষিণ্য, কৃষিসমাজে আধপেটা হলেও একটা ব্যবস্থা হয়েই যেত। আবার সুফি দরবেশদের খানকা, দরগা, চিল্লায় ঈদ তো জাঁকজমকের সঙ্গে হতোই; তবে সেটার সঙ্গে বাঙালিদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল কম, কেবল হাজির হওয়া ছাড়া। আম-বাঙালির ঘরে ঘরে খাবারের বা অতিথির সামনে খাবার পরিবেশনের রীতি একেবারে অধুনা। ইতিহাসের পাতায় যে ঢাকায় তোরাবন্দি বা নিম-তোরাবন্দি খাবার পরিবেশনের কথা শুনি, সেটা অভিজাতদের বলয়েই ছিল কেবল। কমপক্ষে চব্বিশ পদের খাবার পরিবেশিত হতো তোরাবন্দিতে, আর পরে দুর্ভাগ্যের আগমনে নিম-তোরাবন্দিতে (কমপক্ষে বারো পদের খাবার) পরিণত হয়েছিল; অবশ্য গত শতকের তিনের দশকের পর সেটাও আর দেখা যায়নি। আগেই বলা হয়েছে, খাবার পরিবেশনের একটা ব্যাপার ছিল সামাজিক আধিপত্য দেখানোর হাতিয়ার। সেটাই আমরা দেখি বিভিন্ন আঞ্চলিক বনেদি ঘরে। যেমন চট্টগ্রামে মেজবান, বগুড়ার মজলিস, জামালপুর-শেরপুরের জিয়াফতের মেন্দা, সিলেটের মেমানদারি, খুলনা-যশোর এলাকার গণভোজ…এমন আরও অনেক উদাহরণ টানা যায়।
গণভোজগুলোয় আমন্ত্রিতদের সামাজিক অবস্থান আর আতিথেয়তা দেওয়া মানুষটির আর্থিক অনুদানভেদে খাবার পরিবেশনে তারতম্য হয়। আবার কিছু খাবার বিশেষায়িতভাবে পরিবেশনের সুযোগই নেই। যেমন চট্টগ্রামের মেজবানে যেভাবে কোর্সভিত্তিক খাবার পরিবেশিত হয়; প্রথমে গরম ভাত-মাংস, পরে চনার ডাল, নলা হাজি একে একে আসতে শুরু করে। আবার শেরপুরের মেন্দা বা পিটালিতে আইটেম কেবল একটাই—চালের গুঁড়ার সঙ্গে গরু বা খাসির মাংস আর ভাত; সঙ্গে বড়জোর যোগ হয় আচার। আগে যেখানে এগুলো নদীর ধারে, গাছের ছায়ায়, মাদুর পেতে বসে কলাপাতায় পরিবেশন করা হতো; এখন টেবিল-চেয়ারে মাটির শানকি, মালসা নয়তো সিরামিক প্লেটে পরিবেশিত হয়। আগে আয়োজক নিজে তদারক করতেন আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধুরা মিলে; এখন সে দায়িত্ব সাধারণত ক্যাটারারদের বেয়ারারা সামলান। এ ধরনের কিছু পরিবর্তন তো এসেছেই। বগুড়ার মজলিস যেহেতু আলু তোলার কায়িক শ্রমের সঙ্গে জড়িত, তাই আলু ঘাটির এই খাবারের জন্য তেমন আয়োজন করতে হয় না; কেবল দায়িত্ব ভাগ করে নেন মাঠে কাজ করা লোকেরা। কেউ মাংসের (বা মাছের) দায়িত্ব নেন, কেউ আনাজপাতির, আবার কেউ রান্নার। পরে মাঠের মাঝখানে বসেই খেয়ে নেওয়া হয় অনাড়ম্বর করে। ওরসেও এখন নিম্নবিত্তদের প্লেটে করে বা কাগজের ঠোঙায় ভরে খাবার দেওয়ার রীতি চালু হয়ে গেছে; তবে ওরসে উপস্থিত হওয়া সম্ভ্রান্তদের জন্য আবার ক্যাটারারই ভরসা। তবে গ্রামে যৌথ সম্ভ্রান্ত কৃষি পরিবারে আমার অভিজ্ঞতা খানিকটা ভিন্ন। সকালে সেমাই, ফিরনি মুখে দিয়ে ঘরে এলে নাশতা হতো মোটা আমন চাল ও বিভিন্ন ডালের মিশ্রণের খিচুড়ির; সেটি বিশাল বড় গামলায় মাখানো হতো পেঁয়াজ, শুকনো মরিচ, সরিষার তেল আর আমের ঝুরা আচার দিয়ে। এই মাখানোর দায়িত্বে থাকতেন পরিবারপ্রধান, নয়তো পরিবারে এই দায়িত্বে ডিসটিংক্ট মার্ক পেয়ে পাস করা কেউ। পাশে হয়তো মাংস কিংবা ডিম ভাজি। সেই স্বাদ শহরে বসে পাওয়া অসম্ভব!
বাংলায় নানা সময়ে নানা জায়গা থেকে জীবিকার তাগিদে অনেকে এসেছেন। তারা সঙ্গে করে তাদের প্রথা ও ঐতিহ্যকেও টেনে এনেছেন। আমাদের এখানে খাবারের ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ মোটের ওপরে হয়-ই না। নইলে দিল্লির মতো ঢাকার নিজের খাবারেরই একটা এনসাইক্লোপিডিয়া করা হয়ে যেত অনায়াসে। এই যেমন হালের ফুড ভ্লগারদের কল্যাণে মানুষ কাবুলি পোলাও চিনেছে, অথচ এটি তো পুরান ঢাকার বহু পরিবারের ঘরোয়া খাবার ছিল। ঢাকার আফগানদের এই খাবারের পাশাপাশি আছে দো-গোশা পোলাও-ও; কে খোঁজ রাখে, পরে কোনো এক দোকানি এটি করলে ফুড ভ্লগারদের কল্যাণে হয়তোবা আবার সবাই জানবেন। পোলাও আর বিরিয়ানির মাঝে যে সরু সুতোর ফারাক—সেটাই-বা কজনে জানে! সাইনু পালোয়ানের হারিয়ে যাওয়ার পর ঢাকার মোরগ-পোলাওয়ের নিভে আসা প্রদীপের টিমটিমে আলোটা যে কেবল ঝুনুই জ্বালিয়ে রেখেছে, সেটাও জানা জরুরি। এসব খাবারের ঘরোয়া পরিবেশনটাই ছিল উৎসবের, আনন্দের। লখনৌ থেকে, কাশ্মীর থেকে ঢাকায় আসা লোকেরা তাদের থলেতে যে খাবারের জাদুটাকে, সহবতের থলেটাকে বয়ে এনেছিলেন, সেটা আলাদা করে বলারই-বা কী আছে! লখনৌয়ের লোকেরা পান পাতা মাটিতে পুঁতে রেখে যে ‘বেগমী’ পান খাইয়েছিলেন আমাদের, তাতে মিশিয়েছিলেন কেওড়া মেশানো সাদা খয়ের, আর লখনৌয়ি জাঁতায় একই আকারে কাটা প্রায় গুঁড়ো হয়ে আসা সুপারি। ঢাকার পান রাখার জন্য তামার কলাই করা পানদান, গোল পিটারি, ঘট, হুসনদান তো ছিলই।
ফরিদপুরের ১৯১৮ সালের এক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন সৈয়দ মুস্তাফা আলী (যিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর বড় ভাই)। সেটি প্রতিবেশীদের খাঞ্চায় করে সকালবেলায় নাশতা দিয়ে যাওয়া। সেই এলাকায় নাকি একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা চলত প্রতিবেশীদের মধ্যে—কে সবার আগে নাশতা পাঠাবেন। ঢাকার বনেদি পরিবারের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। খাবার ঘরের মাঝখানে বড়-চওড়া দস্তরখান বিছিয়ে দুপাশে থালা দিয়ে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা করা হতো। প্রতি চারটি থালার পর দস্তরখানের মাঝামাঝি একটি থালা রাখা হতো হাড়, কাঁটা ফেলার জন্য। প্রত্যেক অতিথির থালার বাম দিকে একটি খালি পেয়ালা রাখা হতো বোরহানির জন্য। যেকোনো খাবার প্রতি চারজনের জন্য একটি বড় ডিশে রাখা হতো। আর মিষ্টান্নগুলো আগে থেকেই প্রত্যেক অতিথির জন্য আলাদা আলাদা বাটিতে রাখা হতো। সব খাবার সাজানো হয়ে গেলে মেহমানদের ঘরের বাইরে হাত ধুইয়ে রুমালে হাত মুছিয়ে বসানো হতো। মেহমানেরা সবাই নিজেদের মতো করে খাবার নিয়ে নিতেন; তদারকির জন্য গেরস্ত ও তার আত্মীয়রা উপস্থিত থাকলেও তারা এক পাশে থাকতেন। কোথাও কোনো জিনিস কম হলে তা চোখের ইশারায় আনিয়ে নেওয়া হতো। খাওয়া শেষ করে আবার সবাই হাত ধুতেন। এ সময়ে গেরস্তের চাকরেরা গরম পানি নিয়ে প্রস্তুত থাকতেন। এরপর অতিথিদের হাত-মুখ মুছিয়ে বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে পান, হুক্কা দিয়ে আপ্যায়ন করে আতর লাগিয়ে দেওয়া হতো। পান পরিবেশিত হতো সেই পানদান, গোল পিটারি, ঘট, হুসনদানে; আর পিক ফেলার জন্য দেওয়া হতো উগালদান। হুঁকোর চমৎকার টিকা তৈরি করতেন টিকাটুলীর লোকেরা। লখনৌয়ের তামা, পিতল, দস্তার হুঁকোকে পেছনে ঠেলে দিয়েছিল বাংলার মাটির হুঁকো; দেখতে তো সুন্দর ছিলই, তামাকের সঙ্গে যোগ করেছিল মাটির সোঁদা গন্ধ। গত শতকের তিনের দশক থেকে বোরহানির গ্লাসের সঙ্গে এক গ্লাস খাবার জলও রাখা হতো; তবে আগেকার দিনের মতো কেওড়া মেশানো পানি আর পরিবেশিত হতো না। আগেকার দিনে খাওয়ার জলে কেওড়া না মিশিয়ে দেওয়াটা অপরাধ ও অপমানজনক হিসেবে ধরা হতো।
ঢাকার আমজনতার জন্য অবশ্য দৃশ্যটা খুব একটা বদলে যায়নি। মেহমানেরা সাধারণত বসার ঘরে বসেন, আর গেরস্ত খাবারের ঘরে দস্তরখান বিছিয়ে তাদের ডাকেন। আগেকার দিনেও মেহমানেরা হুড়োহুড়ি করে ঘরে ঢুকে দস্তরখানে তাদের পছন্দসই জায়গায় গিয়ে বসতেন। প্রথমে দুজন-একজন চিলমচি আর অন্যজন আফতাবা নিয়ে দস্তরখানের ওপরে দাঁড়িয়েই অতিথিদের হাত ধোয়ানো শুরু করতেন। এরপর অতিথিদের সামনে থালা দেওয়া হতো। দু-চারজন পরিবেশনকারী বারো গিরার দস্তরখানের ওপরেই উপস্থিত থাকতেন, আর খাওয়া শুরু হতো। তদারককারী কারও মুখোমুখি হয়ে ঝুঁকে একদিক থেকে অন্যদিকে খাবার ছুড়তে ছুড়তে বণ্টন করতেন; কিন্তু দস্তরখানে তখন দেখা যেত, পোলাও আছে তো কোরমা নেই, আর কালিয়া আছে তো কাবাব শেষ! সে এক গোলমেলে পরিস্থিতি! এরপর মেজবানের বারবার খাবার গ্রহণের অনুরোধ, অতিথির অস্বীকৃতির পরও জোর করে থালায় খাবার গুঁজে দেওয়া—এসব সমাদর মনে হলেও এগুলো আসলে বিশৃঙ্খল ব্যবস্থা, যা এখনো টিকে আছে।
তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঈদ উৎসব ৯০ বছরে, বলা ভালো গত শতকের আটের দশক থেকে বদলেছে ব্যাপকভাবে। এতে গত শতকের ছয়-সাতের দশকের ঈদ উপলক্ষে আয়োজিত মেলা ও অন্যান্য পরবের অবদান রয়েছে ব্যাপক। ঢাকার গবেষকদের মতে, বর্তমানে যেভাবে ঈদ দেশজুড়ে বড় একটি উদ্যাপনে পরিণত হয়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ ঈদকে ঘিরে তৈরি হওয়া অর্থনীতি। এই অর্থনীতিতে বিগত ১৫-১৬ বছরে যুক্ত হয়েছে ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টগুলোও। ঈদ যেখানে এই মেট্রোপলিটান জীবনে আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ, গোটা বৃহত্তর পরিবার একসঙ্গে বসে খাওয়ার তথা কোয়ালিটি টাইম কাটানোর একটি উপলক্ষ ছিল, সেটি হারিয়ে যাচ্ছে। কসমোপলিটান শহর ঢাকায় অনেক পরিবারে ঈদের দিনে পারিবারিক রেসিপিগুলোই হয়তো বছরে একটা বা দুটো দিনে রান্না করা হয়, সেটাও হারিয়ে যাচ্ছে। ঈদের সকালে ঘরে নানি-দাদি বা মায়ের বানানো সেমাই, ফিরনির জায়গায় ঠাঁই করে নিচ্ছে কোনো বেকারির বা সুইটশপের মাহালাবিয়া বা ডেইট ক্যান্ডি। জেনট্রিফিকেশনের এই সময়ে আর কীই-বা বলার আছে, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বড়জোর বলতে পারি, ‘এবার ফেরাও মোরে’!
তথ্যসূত্র:
আল মারুফ রাসেল; দিল্লি: চার উপাখ্যান। হেকিম হাবিবুর রহমান; ঢাকা: পাচাস বারাস পেহলে। শামসুজ্জামান খান; বাঙালি মুসলমানের ঈদ। সৈয়দ মুস্তাফা আলী; আত্মকথা
মডেল: পূজা চেরি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: জুবাইদা ফাইজা ক্লোদিং ও ব্লুচিজ
জুয়েলারি: জড়োয়া হাউজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল