ছুটিরঘণ্টা I বাদল দিনে লেক মালাউই
মালাউই। দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। এর অন্তর্গত লেক মালাউই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আধার। বর্ষণমুখর দিনে এই লেকের তীর আর তীরবর্তী গ্রামাঞ্চল ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
খানিক দূর এগিয়ে ঘরঘর শব্দ তুলে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িটা আসলে ট্যাক্সি। আমি ট্যাক্সি ভাড়া করেছি কেপ ম্যাকলেয়ারে যাব বলে। সকাল থেকে এত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সদ্য আসা এই দেশে, কিছুই বলার নেই! একে তো আফ্রিকার দক্ষিণ ভাগে এখন আমি রোড ট্রিপ করছি, তার ওপর বিচিত্র আচরণের লোকজনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, লোকের চেয়ে বেশি বিচিত্র এ দেশের পথঘাটের অভিজ্ঞতা।
দেশটির নাম মালাউই। সব আছে, আবার যেন কিছুই নেই। রাজধানী লিলংওয়ে থেকে কেপ ম্যাকলেয়ার আসতে সময় লাগে চার ঘণ্টা; অথচ আমার সময় লেগেছে আট ঘণ্টা। বাসে এসেছি। ঠিক বাস নয়; মাইক্রোবাস ধরনের। দেখি, এতেই গাদাগাদি করে সব প্যাসেঞ্জার বসে আছেন। দিনে একটা বাসই যায় কেপ ম্যাকলেয়ারে। তাই আমিও উঠে বসেছি। কিন্তু যত্রতত্র থেমে যাত্রী ওঠানো-নামানোয় বিস্তর সময় লেগে গেল।
আমি যাব মাংকি বে নামে এক জায়গায়। পথে আর কিছু না হলেও দুধারে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া যে লালিমা ছড়িয়ে যাচ্ছে, তার তুলনা আফ্রিকা ছাড়া আর কোথাও নেই। কারণ, কৃষ্ণচূড়ার জন্ম খোদ আফ্রিকাতেই। তা ছাড়া এই অঞ্চলের মানুষের মতো এমন আনন্দপ্রিয় মানুষ আর দেখিনি। এই যে পথে দেরি হচ্ছে, সেটাও যেন এদের জন্য আমোদের ব্যাপার। আমি মিলিটারি নিয়মে চলা মানুষ। নিয়মের এদিক-ওদিক হলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। অথচ এরা কিনা আট ঘণ্টা পরও বলছে, ‘এই তো চলেই এসেছি মাংকি বে!’ আমার খুব রাগ হলো। ড্রাইভারকে দিলাম ধমক। তাতে সবাই আরও হেসে দিল। যেন এদের জন্মই হয়েছে সব সময় হাসিঠাট্টা করার জন্য!
মাইক্রোবাস থেকে রেগেমেগে নেমে, হনহন করে হাঁটা দিলাম। আমার পেছনে দৌড়ে এলেন বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর। বললেন, ‘এ রকম মাঝপথে নেমে যেয়ো না, প্লিজ। কোনো যানবাহন পাবে না। আমরা তোমাকে সামনের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিচ্ছি।’
ছোট শহর, তাই ট্যাক্সিস্ট্যান্ডও ছোট। আশাতীত রকমের নির্জন। একটা ট্যাক্সিও নেই। তবু কোথা থেকে বাসের কন্ডাক্টর ধরেবেঁধে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এলেন। আর এই পুরো সময় যে আমার জন্য ব্যয় করলেন, তাতে তারা কোনো বাড়তি টাকা নিলেন না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, একজন যাত্রীর পেছনে যে এত সময় নষ্ট হলো, তাতে বাকি যাত্রীদের কোনো সমস্যাই নেই। আফ্রিকার এই অঞ্চলের মানুষ এত রিল্যাক্স থাকে কীভাবে, কে জানে!
ট্যাক্সি পেলাম এবং ট্যাক্সিচালকের নামও জানলাম—অস্টিন। ট্যাক্সি সবে গ্রাম পেরিয়ে লেক মালাউইয়ের দিকে যাচ্ছে, যা এখান থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরত্ব। পিচঢালা রাস্তার দুপাশে সবুজ জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়। ভ্রমণের জন্য অতি চমৎকার দৃশ্যপট। দেখতে যাচ্ছি লেক; তবে মাঝে বোনাসস্বরূপ সজীব পাহাড়ের দেখা পাব, ভাবিনি।
অস্টিন আমাকে গাড়িতে নেওয়ার পর একটা গ্যাস স্টেশনে গেলেন, গ্যাস নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে গ্যাস ছিল না। আমি হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারছি না। গাড়িতে গ্যাস নেই, তবু তিনি যাত্রী নিয়েছেন! মালাউইতে জ্বালানি সংকট প্রকট। কিন্তু এত ভয়াবহ অবস্থা, জানতাম না। আরেকটু এগিয়ে আরেকটি গ্যাস স্টেশনে সামান্য গ্যাসের সন্ধান মিলল। অত্র অঞ্চলে এই দুখানাই গ্যাস স্টেশন রয়েছে, যেগুলোতে গ্যাস নেই বললেই চলে। এতক্ষণে বুঝলাম, সাধারণ মানুষ এখানে কেন এত সহনশীল।
এর পরই ঘটল বিপত্তি। জনমানবহীন পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি গেল খারাপ হয়ে। সাউদার্ন আফ্রিকায় এসে কী যে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে! অস্টিন একটা লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি চালান, তা তিনি জেনেই চালান। কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে এদের বসবাস। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই এক বেলার বেশি খাবার জোগাড় করার সামর্থ্য নেই। তারপরও এত হাসি, এত আনন্দে থাকার মতো মনোবল কোথায় পান, কে জানে! আমাদের মতো কথায় কথায় অভিযোগ করার মানসিকতা এদের একেবারেই নেই।
গাড়ির বনেট খুলে কিছুক্ষণ টোকাটুকি দিতে দিতে ফোন করে অস্টিন কাকে যেন ডাকলেন। খানিক পর এক লোক মোটরসাইকেলে করে যন্ত্রপাতি নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ পর গাড়ি ঠিক হলে আবার আমরা চললাম গন্তব্যের দিকে। অতি অল্প গ্যাসে কত দূর যেতে পারব, কে জানে। আমার সন্দেহকে উড়িয়ে দিয়ে অস্টিন আমাকে লেক মালাউইয়ের তীর ছুঁয়ে থাকা রিসোর্টে নামিয়ে দিলেন।
বিকেল গড়িয়ে গেছে। আমি রুমে ব্যাকপ্যাক রেখে কয়েক কদম দূরে লেক পাড়ে চলে এলাম। এ তো লেক নয়, যেন কূলকিনারাহীন এক সমুদ্র। নীল জলে ছলাৎ ছলাৎ করে তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। জীবনে নানা দেশের নানা লেক দেখেছি; কিন্তু সমুদ্র আকারের, সমুদ্রের মতো ঢেউ তোলা লেক এই প্রথম দেখলাম। এর তটে মাটি নেই; আছে ছোট ছোট নুড়ি পাথর আর বালি।
রিসোর্টের লবিও লেকের একেবারে তীরে। লবির একাংশ খোলা আকাশের নিচে, যার পা ধুয়ে দিচ্ছে লেকের ঢেউ। ঢেউয়ের পাশেই সুইমিংপুল। পুলে ভাসতে ভাসতে লেকের ঢেউয়ের ঝাপটা এসে পড়ে সেখানে। এই রিসোর্টে ইউরোপীয় আর দক্ষিণ আফ্রিকার ছেলেমেয়ে দেখলাম; অবশ্য আমি ছাড়া সবাই শ্বেতাঙ্গ। দক্ষিণ আফ্রিকার ছেলেমেয়েরাও শ্বেতাঙ্গ। এদের পূর্বপুরুষ ইংল্যান্ড থেকে বহু বছর আগে এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এরা দক্ষিণ আফ্রিকার ধনী শ্রেণি। এদের দেখতে দেখতে আমার আবার সূর্যাস্ত দেখা মিস না হয়ে যায়!
লেকের কোনায় চেয়ার-টেবিল পাতা। তার একটায় বসে সূর্যের গনগনে সিঁদুর রং থেকে কমলা, কমলা থেকে গোলাপি হয়ে যাওয়া দেখছি। এখন মনে হচ্ছে লেকের পানি, আশপাশের সব গাছপালা সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে রং বদলে ফেলছে। এমনিতেই লেকের আশপাশে কেউ নেই; আর এখন আরও শান্ত হয়ে সন্ধ্যা নামছে। আকাশের রং যতখানি ফিকে হচ্ছে, ততখানিই নির্জনতা পেয়ে বসছে প্রকৃতিকে। সারা দিন কিছু খাইনি। সমুদ্রসম ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ দেখছি যখন আপন মনে, আমাকে রাতের খাবার দিয়ে যাওয়া হলো।
এই ঢেউ আর অন্ধকারের মুগ্ধতা আমার রুমের বারান্দা থেকেও দেখা যায়। বারান্দায় বসতে না বসতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকায় এখন বর্ষাকাল। মেঘ নিজের মনের সব ইচ্ছা পূরণ করার জন্য আকাশকে ছেয়ে জুড়ে আছে। মেঘের এখন ঝরে পড়ার বেলা; আর আকাশের এখন শান্ত হয়ে ঘুমের দেশে চলে যাওয়ার ক্ষণ।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বৃষ্টির ছটা। গভীর রাত। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির সুরধারার সঙ্গে ঐকতান বেজে চলছে সামনের লেক মালাউইতে। আফ্রিকার এক কোনায় পড়ে থাকা, অজানা এই দেশ মালাউই আসলে বিখ্যাত তার লেকের জন্য। বৃষ্টির ধারা যত বাড়ছে, লেকের জলে তার সুরধারা আরও প্রবল হচ্ছে।
পরদিন সূর্যোদয় দেখার জন্য খুব ভোরে উঠলাম। সুয্যিমামা বেশ হাসিমুখেই ধরা দিল। এই রিসোর্টে এত ভোরে আর কেউ ওঠেননি। এমনকি কোনো কর্মীরও দেখা পাচ্ছি না। এদের রিসোর্টে প্রচুর গাছপালা আছে; এর মাঝে সাদা রঙের দেয়াল আর পাতার ছাউনি দেওয়া চারচালা ছোট ছোট কটেজ। শুধু রিসোর্টের ভেতরেই এত বড় জায়গা, বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে কিচেন খুঁজে পেলাম। সেখানে দেখি, দুটো মেয়ে এই সকালে উঠে নাশতা তৈরির কাজে লেগে গেছেন। ওদের বললাম আমাকে কফি দিতে।
কফির মগ হাতে নিয়ে রিসোর্টের বাকিটাও দেখে ফেললাম। এরই মাঝে রিসোর্টের মালিক বিশাল আকারের দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর নিয়ে লবিতে এলেন। তিনি নিজেও ছোটখাটো কেউ নয়। আমার চার গুণ আকারের। নাম ম্যাক। দক্ষিণ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ। পরিবার থাকে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তিনি এখানে বাঘা বাঘা দুই সঙ্গী আর হোটেলের স্টাফদের নিয়ে সংসার পেতেছেন। ম্যাকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার নাশতা এসে গেল, ইংলিশ ব্রেকফাস্ট।
লবির একাংশ উঁচু করে বানানো হয়েছে। সেই উঁচু জায়গায় সুইমিংপুল; তার পেছনে খানিকটা খোলা জায়গায় ছাউনি দেওয়া। এর পেছনে বিশাল জায়গায় ভদ্রগোছের লবি। বিশাল বিশাল সোফা পাতা। আধুনিক ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন। তবে পুরো রিসোর্টে মালাউইয়ের হস্তশিল্প শোভা পাচ্ছে। ওয়াল হ্যাংগিং, বড় বড় ল্যাম্পশেড, ওয়াল পেইন্টিং, টেবিল, চেয়ার, টুল, সোফা, বাগানের শোপিস ইত্যাদি সবকিছুতেই স্থানীয় শিল্পের প্রাধান্য। স্থানীয় পাতা, বেত, বাঁশ, কাঠ দিয়ে করা হয়েছে সবকিছু।
এখনো কেপ ম্যাকলেয়ার গ্রামের কিছুই দেখা হয়নি আমার। তাই রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে গ্রামের পথ ধরলাম। বালি আর নুড়ি মেশানো পথ। রিসোর্ট পার হলে পথের দুপাশে বেশ কয়েকটি হস্তশিল্পের দোকান। দোকানগুলো একটা একটা করে খুলছে। দোকান পার হলে এ গ্রামের একমাত্র রেস্তোরাঁ। আরেকটু এগিয়ে গেলে গ্রামের বাড়িঘর পথের দুপাশে। তার চেয়ে বেশি আছে গাছপালা। ঘন জনবসতি আফ্রিকার কোথাও আমি দেখিনি। এ গ্রামেও ঘন জনবসতির চিহ্ন নেই। পথের ধারে অনেক দূরে দূরে একটা একটা মাটির ঘর। তবে ভীষণ পরিচ্ছন্ন। আমার খুব ইচ্ছা করল বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখার। সে রকম একটা বাড়ির সামনে ঘুরে ঘুরে বাড়িটা যখন দেখছিলাম, এক ছেলে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী খুঁজছ?’ আমি আফ্রিকায় এমন যেচে পড়ে সাহায্য করতে চাওয়া আদমি অনেক পেয়েছি। তাই নির্দ্বিধায় বললাম, ‘বাড়িটার ভেতরটা কেমন, দেখতে চাই।’ ছেলেটির নাম প্রমিজ। চিকন পাটকাঠির মতো কাঠি দিয়ে ঠেসে বুনন করা বেড়া ভেদ করে সোজা বাড়ির উঠানে নিয়ে আমাকে হাজির করলেন তিনি।
বেশ বড় জায়গাজুড়ে এ বাড়ির সীমানা। পুরোটাই বেড়া দেওয়া। এক কোনায় ছনের চাল দিয়ে মাটির ঘর, বাড়ির মালিকের থাকার জন্য। ছনের বেড়া দেওয়া বাকি দুটি ছোট ঘরের একটি রান্নাঘর, আরেকটি গোয়ালঘর। মাঝখানের উঠানটা বেশ বড়। সেখানে অনেকখানি জায়গাজুড়ে লম্বা লম্বা পাটি পেতে ভুট্টার গুঁড়া শুকাতে দেওয়া হয়েছে। এই ভুট্টার গুঁড়া পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য। আমাদের যেমন ভাত প্রধান খাদ্য, তেমনি এদের হলো ভুট্টার গুঁড়া দিয়ে তৈরি মণ্ড। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় শিমা। শিমা দিয়ে এরা শাকসবজি, মাছ, মাংস—সবই খায়।
উঠানের এক কোনায় বাড়ির মালকিন একমনে বস্তা থেকে ভুট্টার গুঁড়া বের করে গামলা ভরে নিয়ে পাটিতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার পরনে শুধু একটা রঙিন লুঙ্গি, যা বুক থেকে বেঁধে রেখেছেন। তার আশপাশে কয়েকটা পোষা ছাগল আর মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে উঠানটা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আফ্রিকার যেকোনো গ্রাম বা শহর দেখলে সত্যি চোখ জুড়িয়ে যায়। কোথাও কোনো কাগজ, চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল ইত্যাদি পড়ে নেই। মনে হয় যেন এইমাত্র সব ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করা হয়েছে।
গ্রামের বাড়ি দেখে আমি এ গ্রামের হস্তশিল্পের দোকান পরিদর্শনে গেলাম। মালাউই বিখ্যাত কাঠের তৈরি জিনিসপত্রের জন্য। অস্থায়ী বেড়া আর ছনের চালের দোকানে ঢুকতেই ঝমঝম বৃষ্টি নামল। দোকানগুলোতে কাঠে খোদাই করা মুখোশ, আফ্রিকান নারী-পুরুষ, পুতুল, নানা প্রাণী, নানা ডিজাইনের বাটি, ট্রে, ওয়াল হ্যাংগিং ইত্যাদি সব ধরনের হস্তশিল্প রয়েছে। ট্যুরিস্ট কম আসে এবং মালাউই অত্যন্ত ব্যয়বহুল দেশ বলে এই হস্তশিল্পের দাম অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি। দোকানগুলোর শেষ মাথায় আফ্রিকার রঙিন প্রিন্টের কাপড় আর সেলাই মেশিন নিয়ে বসে আছেন বিলি। সারি সারি রঙিন চিটেঙ্গি কাপড়ের মধ্য থেকে একটা পছন্দ করে দিলেই তিনি শার্ট, টপ, স্কার্ট—যা বানাতে বলব, বানিয়ে দেবেন।
হস্তশিল্পের দোকান দেখা হলে আমি গ্রামের পথ ধরে আরও এগিয়ে গেলাম। যত দূরেই যাই না কেন, গাছপালা বা বাড়ির মাঝ দিয়ে লেক মালাউইয়ের নীল জল চোখ শীতল করে দেয়। সামান্য দূরেই ডালপালা মেলে দুহাতে আমাকে কাছে ডাকছে একটি বিশাল উঁচু গাছ। আফ্রিকায় এ গাছ বহু দেশে দেখেছি। নাম বাওবাব। অনেক জনপদে একমাত্র বাওবাব গাছ ছাড়া অন্য কোনো বৃক্ষ নেই। অনেকে বাওবাব গাছের দেখা জীবনে কখনো পায় না। আমি পথে পথে পেয়ে যাচ্ছি এ গাছ; এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
বাওবাব গাছ দেখে গ্রামের লেক মালাউইয়ের তীরে চলে এলাম। এই তট আরও সুন্দর। বিভিন্ন গাছের ছায়ায় ঘেরা। সামনে প্রায় মাঝ সাগরে জেলেরা স্পিডবোট ঠিক করছেন। সাগরের মতো লেক, তাই একে সাগর তো বলাই যায়। এ গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। দেখলাম, স্পিডবোটে বসে থাকা দুজনকে বড় বড় ঢেউ উল্টে প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল।
সকালে আকাশ পরিষ্কার ছিল, এখন দুপুরে আবার মেঘ করেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঘনঘোর বাদল দিনের মতো নিমেষে কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। লেকের ঘন নীল রং বদলে হয়ে গেল ধূসর। আসতে শুরু করল পাহাড় সমান ঢেউ। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেলা; এই রোদ তো এই মেঘ। এই শান্ত আকাশ; পরক্ষণেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ গমগমে গর্জন তার।
বৃষ্টি শুরু হতেই আমি রিসোর্টের খোলা লবিতে এসে বসলাম। লেক এখন সাগরের মতো ফুঁসছে। কাছে গেলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার সঙ্গে আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া ঢেউ আছড়ে পড়ছে লবির এই অংশে। চেয়ার-টেবিল, সুইমিংপুল—সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যেন। অথচ একটু আগেও লেকের প্রগাঢ় নীল রং দেখে ভেবেছিলাম, এর চেয়ে নিরীহ আর কিছুই নেই। এখন সে সজল হয়ে, দামাল হয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে সবকিছু।
লেকের কাছে বেশিক্ষণ বসা গেল না। বড় বড় ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। আমি বৃষ্টিতে না ভিজলেও কিংবা এখনো লেকে নেমে সাঁতার না কাটলেও সে ঠিক করেছে, জলোচ্ছ্বাস ঘটিয়ে ভিজিয়ে দেবে এই চরাচর!
এমন মেঘের দিনে বৃষ্টি, জলের উচ্ছ্বাস দেখার জন্য যেন এই লেক মালাউই আর এই দেশ মালাউই আদর্শ।
ছবি: লেখক