skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I উড়ন্ত স্কার্ট

দমকা হাওয়ায় উড়ছে ধবধবে সাদা স্কার্ট। অনবদ্য প্রাণোচ্ছলতায় সামলানোর ন্যূনতম প্রচেষ্টা লাস্যময়ী তরুণীর। এই আলোকচিত্র জগদ্বিখ্যাত

১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একটি সাবওয়েতে ফিল্মমেকার বিলি ওয়াইল্ডারের রোমান্টিক কমেডি জনরার ফিল্ম ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’-এ অভিনয় করছিলেন তুমুল আলোচিত-সমালোচিত মডেল ও অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো। শো বিজনেসের ইতিহাসে অকালপ্রয়াত যে তারকা ‘ব্লন্ড বোম্বশেল’, ‘সেক্স সিম্বল’সহ আরও অনেক অভিধায় অভিষিক্ত। মাঝরাতের সেই শুটিংয়ের ফাঁকে স্বল্পবসনা মনরো তার পরনের সাদা স্কার্ট হাওয়ায় উড়িয়ে যে ভঙ্গিতে আলোকচিত্রী স্যাম শ-এর ক্যামেরায় ধরা পড়েছিলেন, সেই ছবি ‘ফ্লাইং স্কার্ট’ নামে জগদ্বিখ্যাত। বিশ শতকের সবচেয়ে আইকনিক ইমেজগুলোর একটি হিসেবে গণ্য। তার এই পোশাক পরিচিত ‘হোয়াইট ড্রেস অব মেরিলিন মনরো’ নামে।
ছবিটি তোলার মুহূর্তে নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাবওয়ে থেকে আসা দমকা হাওয়ায় মনরোর স্কার্ট আচমকাই তার হাঁটুর ওপরে উঠে যায়। সেই ষাটের দশকে কোনো নারীর গোড়ালির ওপরের ত্বক জনসমক্ষে দেখানোকে ভদ্রস্থ জ্ঞান করা হতো না; কিন্তু দুঃসাহসী মনরো স্কার্ট নিচে নামানোর তেমন চেষ্টা না চালিয়ে বরং উড়ন্ত অবস্থায় দেখানোকেই শ্রেয় মনে করে বলেছিলেন, ‘দেখতে দারুণ লাগছে না?’ এই ছবিতে ডান হাতে ঊরুসন্ধির কাছে স্কার্টকে কোনোমতে চেপে ধরে এবং বাম হাত নিজের কানের কাছে রেখে পোজ দিতে দেখা যায় মনরোকে। আলোকচিত্রটিতে তার রাজকীয় অভিব্যক্তি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটেছে দুর্দান্তভাবে। সাদাকালো এই ছবির ফোকাস পয়েন্ট তার পরনের ধবধবে সাদা বসন। কোনো ব্যাকড্রপ না থাকায় দর্শকের মনোযোগ এই চির রূপসীর মুখের অভিব্যক্তির ওপর নিবদ্ধ হতে বাধ্য। সেই মুখের ভাষায় আনন্দ, উদ্বেগহীনতা, সাহস ও বাস্তববাদ একাকার হয়ে আছে।
ভালোভাবে খেয়াল করলে ফ্রেমের মধ্যে মনরোর সঙ্গে দুজন পুরুষেরও দেখা মিলবে। ছবিটির বাঁ দিকে রয়েছেন তারা। তাদের ওপর ফোকাস করা হয়নি; ফলে তারা অনেকটাই ঝাপসা হয়ে আছেন। তাদের এমন উপস্থিতি এই ছবিতে বাড়তি মাহাত্ম্য যোগ করেছে। এ যেন জানান দেয়, পুরুষদের কাছে কতটা প্রার্থিত, কতটা স্বপ্নের মানুষ ছিলেন মেরিলিন মনরো। তার সৌন্দর্যের কতটা আরাধনা করতেন তারা।
দিনে দিনে প্রত্যাশার মাত্রা বহুদূর ছাড়িয়ে গেছে ‘ফ্লাইং স্কার্ট’। পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ন্যাশনাল আর্ট পিসে। নিজ সময়ে মনরো ছিলেন সবচেয়ে যৌন আবেদনময়ী নারী। তার সেই প্রভাব বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত প্রবাহিত। আর তাতে এই আলোকচিত্রের রয়েছে যুগান্তকারী ভূমিকা। এটি ন্যাচারাল বিউটির এক অনন্য উদাহরণ। ছবিতে আনন্দমুখর ও নিরুদ্বেগ থাকার যে অভিব্যক্তি মনরো প্রকাশ করেছেন, তা জানিয়ে দেয়, নিজ সৌন্দর্য উপস্থাপনের জন্য তথাকথিত নিখুঁত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই যে ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কি না, তা পাত্তা না দিয়ে, অর্থাৎ ছবি তোলার মুহূর্তে আচমকা আসা দমকা হওয়ায় উড়তে থাকা স্কার্টকে গোড়ালি অব্দি নামানোর চেষ্টা না করেই মূহূর্তটি আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সমাজ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের গ্যাঁড়াকলে নিজেকে দমিয়ে না রেখে জীবন যখন যেমন, তখন তেমনভাবেই উপভোগ করা শ্রেয়।
‘ফ্লাইং স্কার্ট’ তোলার মূহূর্ত ঘিরে এর পরের দিন, অর্থাৎ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪, নিউইয়র্কভিত্তিক সংবাদপত্র ‘ডেইলি নিউজ’-এ প্রকাশিত ‘ক্যামেরাস এক্সপোজ মেরিলিন অন আ গ্রেটিং’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এসটি. ফিফটিন টাইমসের (টাইমস স্কয়ার) কাছে, লেক্সিংটন অ্যাভিনিউর একটি সাবওয়ের গ্রেটিংয়ের ওপর যে ফিল্মের শুটিং চলছে, সেটির কাজের ফাঁকে, ব্যাকলেস হোয়াইট ড্রেস আকাশে উড়িয়ে দেওয়া এক চকিত বাতাসে নিজের মোজাবিহীন পা এবং আঁটোসাঁটো হোয়াইট নাইলন প্যান্টি জনসমক্ষে দেখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে অনাবৃত অবস্থায় প্রকাশ করেছেন মিস মনরো।’
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’ ফিল্মে দেড় মিনিটের এমন একটি সিকোয়েন্স ছিল, যেখানে ওই স্পটে দাঁড়িয়ে থাকবেন মেরিলিন মনরো। ফিল্মটিতে তার অভিনীত চরিত্রের কোনো নাম নেই; ক্রেডিট লাইনে স্রেফ ‘দ্য গার্ল’ বা ‘মেয়েটি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মনরো যেহেতু তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন, তাই তার উপস্থিতিতে সব সময় পাপারাজ্জি ও সাধারণ দর্শকের ভিড় জমে যেত। ফলে তার পক্ষে ডামি হিসেবে গ্লোরিয়া মসোলিনো নামের এক তরুণীকে দাঁড় করিয়ে রাত ১২টা ২০ থেকে ১টা ৪৫ পর্যন্ত, দৃশ্যটির আটবার মহড়া করিয়েছিলেন ফিল্মমেকার। এভাবেই সেট করে নিয়েছিলেন সবকিছু। অবশেষে চূড়ান্ত শুটিংয়ে হাজির হন মনরো। ততক্ষণে, অত রাতেও প্রায় ২ হাজার (মতান্তরে ৫ হাজার) মানুষ ভিড় করে সেখানে। সেই ভিড়ের মধ্যেই দুই ঘণ্টা ধরে সিকোয়েন্সটিতে কাজ করেছেন মনরো। সেই শুটিংয়ের ফাঁকেই এই ছবি তুলেছেন স্যাম।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ‘বায়োগ্রাফি’র অন্তর্জাল সংস্করণে ‘ফ্লাইং স্কার্ট’-এর আলোকচিত্রী স্যাম শ-এর নাতনি এবং ‘শ ফ্যামিলি আর্কাইভ’-এর পরিচালক মেলিসা স্টিভেন্স লিখেছেন, ‘১৯৪০-এর দশকে “ফ্রাইডে” ম্যাগাজিনের জন্য নিজের করা একটি ফটোশুট থেকে এই আলোকচিত্রের ধারণা পান স্যাম। সেই ছবিতে এক নাবিক ও এক তরুণীকে কনি আইল্যান্ডের একটি উইন্ড টানেলে উচ্ছ্বাসমুখর অবস্থায় ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছিল। সেই ছবিতে দেখা যায়, বাতাসের তোড়ে মেয়েটির স্কার্ট উড়ছে। আর এমন ছবি প্রচ্ছদে ছাপা হতেই মুহূর্তে ম্যাগাজিনটির সব কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এর এক দশক পর স্যাম যখন “দ্য সেভেন ইয়ার ইচ”-এর স্ক্রিপ্ট পড়েন, খেয়াল করলেন, সেই স্কার্ট-ব্লোয়িং আইডিয়াকে এখানে আরেকবার জাহির করার সুযোগ রয়েছে।’ এভাবেই জন্ম ঘটে আইকনিক ‘ফ্লাইং স্কার্ট’ আলোকচিত্রের।
এই ছবিতে দেখা মেলা মনরোর পোশাকটির নকশা করেছিলেন আমেরিকান কস্টিউম ডিজাইনার উইলিয়াম ট্রাভিলা। যার ঝুলিতে আগে থেকেই ১৯৪৮ সালের ফিল্ম ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব ডন হুয়ান’-এর কল্যাণে ছিল অস্কার পুরস্কার। মেরিলিন মনরোর সঙ্গে তিনি কাজ শুরু করেন ১৯৫২ সালের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ফিল্ম ‘ডোন্ট বদার টু নক’-এর মধ্য দিয়ে। এই লাস্যময়ীর জন্য মোট আট ফিল্মে পোশাকের নকশা করেছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে নিজ স্ত্রী, আমেরিকান অভিনেত্রী ডোনা ড্রেক যখন ছুটি কাটাচ্ছিলেন, এমন সময়ে একটি হোয়াইট ককটেল ড্রেসের ডিজাইন করেছিলেন ট্রাভিলা। সেই পোশাকই ‘ফ্লাইং স্কার্ট’-এ পরেছেন মনরো। ডেল ম্যাককনাথি ও ডায়ানা ভ্রিল্যান্ড রচিত ‘হলিউড কস্টিউম: গ্লামার! গ্লিটার! রোমান্স!’ থেকে জানা যায়, পোশাকটি বানানোর পর প্রথমে মনে ধরেনি ট্রাভিলার; তাই এটিকে বাক্সবন্দী করে রেখে দিতেই চেয়েছিলেন। সে আর হয়নি! তারপর তো এই ‘হোয়াইট ড্রেস অব মেরিলিন মনরো’র বাকিটা ইতিহাস!
৪ আগস্ট ১৯৬২, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হলিউডের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এই সেক্স সিম্বলের রহস্যময় মৃত্যুর পর তার জন্য বানানো এই পোশাক দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ করে রেখে দিয়েছিলেন ট্রাভিলা। এ সময়ে ধারণা ছড়িয়ে পড়ে, পোশাকটি হয়তো হারিয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে ট্রাভিলার মৃত্যুর পর তার সহকর্মী বিল স্যারিস এই হোয়াইট ড্রেসের প্রদর্শনী করেন। আমেরিকান অভিনেত্রী, গায়িকা ও উদ্যোক্তা ডেবি রেনল্ডসের ব্যক্তিগত সংগ্রহ হিসেবে এটি পরে হলিউড মোশন পিকচার মিউজিয়ামে জায়গা করে নেয়। পরবর্তীকালে আমেরিকান জনপ্রিয় টক শো উপস্থাপিকা অপরাহ উইনফ্রেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রেনল্ডস জানিয়েছিলেন, পোশাকটির রং খানিকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে; ‘কেননা, এটি তো এত দিনে অনেক পুরোনো হয়ে গেছে।’ ২০১১ সালে তিনি জানান, সে বছরের ১৮ জুন শুরু হতে যাওয়া এক নিলামে পোশাকটি বিক্রি করে দেবেন। দিয়েছেনও। প্রাথমিক দাম ১ থেকে ২ মিলিয়ন ডলার ধারণা করা হলেও মনরোর সেই ‘উড়ন্ত স্কার্ট’ বিক্রি হয়েছিল ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে, সঙ্গে বাড়তি ১ মিলিয়ন কমিশন। ফলে এটি পরিণত হয়েছে দুনিয়ার দামি পোশাকগুলোর একটিতে।

 লাইফস্টাইল ডেস্ক
দায় স্বীকার: নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ; দ্য গার্ডিয়ান; প্রিন্টিক ডট কম; বায়োগ্রাফি ডট কম; উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top