মনোযতন I বৃষ্টিভীতি
ওমব্রোফোবিয়া। সরল বাংলায়, বৃষ্টিতে ভয়। যারা বর্ষা মৌসুমে নীরবেই ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন; বাইরে বের হওয়ার কথা শুনলে যাদের চোখে পানি চলে আসে, বুক ধড়ফড় করে, তারা এই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত
বৃষ্টি কারও কাছে প্রেম, কারও কাছে কবিতা। কারও কাছে রেইনকোটের ভেতর লুকানো কিছু দুঃখ; আবার কারও কাছে শৈশবের পলিথিনের নৌকা! কিন্তু কিছু মানুষের কাছে বৃষ্টি রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার। শরীর নয়; মন কাঁপানো এক ভয়। এই ভয়ের নাম ওমব্রোফোবিয়া। টিনএজারদের মধ্যে এ সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই ভয় কীভাবে গড়ে ওঠে, কেন তৈরি হয়, কীভাবে প্রভাব ফেলে মনের জগতে?
ওমব্রোফোবিয়া মানে বৃষ্টির প্রতি অস্বাভাবিক ভয়। গ্রিক শব্দ ‘ওমব্রোস’ অর্থ ‘বৃষ্টি’ আর ‘ফোবিয়া’ মানে ভয়। দুয়ে মিলে এমন নাম। একে শুধু ভয় বললে ভুল হবে; এটি একধরনের অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। এটি একধরনের নির্দিষ্ট ফোবিয়া, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি বৃষ্টি কিংবা বৃষ্টির সম্ভাবনামাত্রই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তা কোনো মামুলি আতঙ্ক নয়; বরং শরীর ও মনের ওপর একসঙ্গে হিংস্র আক্রমণ অনুভব করেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃষ্টিকে ভয় পাওয়া সাধারণত একধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া, যেটি শৈশবের কোনো ট্রমা, অভিজ্ঞতা কিংবা পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়।
ফোবিয়া নাকি অতি সংবেদনশীলতা
অনেকে বৃষ্টিতে ভিজতে চান না; সেটি ওমব্রোফোবিয়া নয়। তবে এতে যারা আক্রান্ত, তাদের কাছে বিষয়টি শুধুই অস্বস্তি নয়, একটি গভীর মানসিক সংকটও। ওমব্রোফোবিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়; যেমন—
বৃষ্টি শুরু হলে আচমকা ঘাবড়ে যাওয়া;
বৃষ্টি দেখলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া;
টিভি, ফোন কিংবা জানালা থেকে বৃষ্টি দেখতে না চাওয়া;
বৃষ্টি নামলে ঘরে লুকিয়ে পড়া এবং একা থাকতে চাওয়া;
আতঙ্কে কাঁদতে শুরু করা;
মাথা ঘোরা কিংবা শরীর অবশ লাগা;
বাসা থেকে বের হতে ভয় পাওয়া;
বাইরের শব্দকে নিজের ক্ষতির পূর্বাভাস গণ্য করা।
এই লক্ষণগুলো যখন বারবার আসে, জীবনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কাজ, শিক্ষা, সম্পর্ক—সব জায়গায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
ভয়ের শুরু যেখান থেকে
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিংয়ের শিশু ও কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৌহিদা ফেরদৌসী বলেন, ‘ভয় মানুষের মনে গেঁথে থাকে। অনেক সময় অন্যদের দেখেও মনে ভয় জন্ম নিতে পারে। ভয় শিখে নেওয়া আদতে একটি প্রতিক্রিয়া। ওমব্রোফোবিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। অনেক সময় ছোটবেলায় হঠাৎ কোনো ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাতের বিকট শব্দ কিংবা এমন দিনে বাসায় একা থাকার স্মৃতি রূপ নেয় ট্রমায়। তখন মস্তিষ্ক শেখে, “বৃষ্টি মানেই বিপদ”। কিছু ভয় এতটাই গভীরে গেঁথে যায় যে পূর্ণ বয়স্ক জীবনে এসেও তা মুছে ফেলা সম্ভব হয় না।’
কৈশোরে বাড়ন্ত কেন
টিনএজ মানেই শারীরিক, মানসিক ও হরমোনাল পরিবর্তনের ঝড়! এ সময়ে মস্তিষ্ক ও মন একসঙ্গে নিজেকে খুঁজে বেড়ায়। এমন দিনগুলোতে আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি খুব সাধারণ ব্যাপার। এ বয়সে কোনো আতঙ্কবোধ চুপিসারে মনের ঘরে ঢুকে পড়লে সহজে বের হয় না; বরং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার গভীর সংকেত জারি করতে পারে।
ধরা যাক, ক্লাস সিক্সে থাকা অবস্থায় বৃষ্টিতে স্কুল থেকে ফেরার পথে সড়কে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কারও মৃত্যু দেখা কিংবা বন্যায় বাড়ি ডুবে যাওয়ার ট্রমা, এমনকি ঘরে থাকা অবস্থায় টানা কয়েক দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকা—এমন আপাতদৃষ্টে সাধারণ ঘটনাও মস্তিষ্কে বৃষ্টিকে ‘আতঙ্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। বিশেষ করে যারা সংবেদনশীল স্বভাবের, তাদের মধ্যে এমন ফোবিয়া হানা দেওয়ার ঝুঁকি বেশি।
বৃষ্টি ঘিরে মনে দানা বাঁধা ছোটবেলার ভয় যদি সামাল দেওয়া না যায়, শিশু থেকে টিনএজ, টিনএজ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার, অর্থাৎ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও গভীর হতে পারে। শিশুরা অনেক সময় বজ্রপাত বা হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে যাওয়া দেখে ভয় পেয়ে কান্না করে, সেটাকে মা-বাবা মজার বিষয় বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু টিনএজে ঢুকে সেই শিশু যখন বাইরে একা চলাফেরা শুরু করে, তখন সে নিজের ভয়কে আর প্রকাশ করতে চায় না। কারণ, সমাজ বলে, ‘ভয় পেলে তুমি দুর্বল!’
শুধুই ভয় নয়
ওমব্রোফোবিয়ায় ভোগা কিশোর-কিশোরীরা শুধু মানসিকভাবে নয়, শারীরিকভাবেও কষ্ট পায়। বৃষ্টি শুরু হলে তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, ঘেমে ওঠা, বমি ভাব অনুভব করা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, এমনকি প্যানিক অ্যাটাকের সূত্রপাত ঘটতে পারে। অনেকে তখন সোশ্যাল অ্যাভয়ডেন্সে ভোগে; ফলে স্কুলে যায় না, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে না, ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখে নিজেকে। ডা. তৌহিদা ফেরদৌসীর মতে, এ ধরনের ভয়কে অস্বীকার কিংবা অবহেলা করলে তা আরও গভীর মানসিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে।
ভয়টা সত্যি বৃষ্টির নাকি অন্য কিছুর
ওমব্রোফোবিয়া অনেক সময় শুধুই বৃষ্টির ভয় নয়; বরং এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো পুরোনো ট্রমা। যেমন—
পারিবারিক কলহ: অনেক শিশু-কিশোর বৃষ্টির দিনে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হয়েছে। ফলে বৃষ্টি মানেই তাদের জন্য মানসিক অস্থিরতা।
দুর্যোগ স্মৃতি: ২০০৭ সালের সিডর কিংবা ২০০৯ সালের আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া শিশুদের মধ্যে এ ভয় অনেক বেশি দেখা যায়।
বৃষ্টিতে দুর্ঘটনা: রাস্তা ভিজে পা পিছলে পড়ে যাওয়া, বজ্রপাতের শব্দে চমকে ওঠা ইত্যাদি অভিজ্ঞতাও মনে বৃষ্টিভীতি ডেকে আনতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়া ও ফ্যান্টাসি কালচার
আজকের প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় বড় হচ্ছে। ‘রেইনি ডে অ্যাসথেটিক’, ‘পেট্রিকোর’, ‘সোলফুল মিউজিক অ্যান্ড কফি’—এমন রোমান্টিক দৃশ্যের ভিড়ে যাদের জন্য বৃষ্টি মানেই আতঙ্ক, তারা নিজেদের আরও বেশি বিচ্ছিন্ন মনে করে। এই দ্বন্দ্ব তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে। অনেকে ভয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও দূরে থাকতে শুরু করে। আবার কেউ কেউ চাপে পড়ে নিজের ভয়কে অস্বীকার করে, যেটা আরও বিপজ্জনক।
সামাজিক চাপ ও লজ্জার সংস্কৃতি
ছেলেরা ভয় পায় না—আমাদের সমাজে এই মিথ খুব শক্তভাবে রয়ে গেছে। ফলে অনেক কিশোর মনের ভেতরে ভয় পুষে রাখে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে চায় না। কারণ, তাকে দুর্বল বা ‘মেয়েলি’ মনে করা হবে। অন্যদিকে কোনো মেয়ে যদি বলে, ‘আমি বৃষ্টি হলে ভয় পাই,’ তখন পরিবার থেকে সাধারণত উত্তর পায়, ‘বৃষ্টি দেখেই ভয়? তোমার তো সবকিছুতেই সমস্যা!’ এ ছাড়া এখনো আমাদের দেশে ভয় বা ফোবিয়াকে ‘নাটক’ বা ‘আড়ম্বর’ ভেবে নেওয়া হয়। এসব সামাজিক স্টেরিওটাইপ ও বিদ্রূপের কারণে কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের আরও গুটিয়ে ফেলে। আত্মবিশ্বাস হারায়; নিজের অনুভূতিকে সন্দেহ করতে শুরু করে। এই ভয়কে নিজের ভেতর চেপে রাখে। ফলে এই ভয়ই পরবর্তী সময়ে ভয়ংকর রূপ নেয়—ডিপ্রেশন, সোশ্যাল আনঅ্যাডজাস্টমেন্ট, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত। তাই ওমব্রোফোবিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া দূরের কথা, সেটি যেন স্থায়ী বসবাস গেড়ে ফেলে মনে।
ওমব্রোফোবিয়া মানে মানসিক দুর্বলতা নয়
ডা. তৌহিদা ফেরদৌসী বলেন, ওমব্রোফোবিয়া মানেই দুর্বলতা নয়; বরং এটি একটি বৈজ্ঞানিক সমস্যা। এর জন্য সাইকোথেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি, সাপোর্টিভ কাউন্সেলিং, এমনকি প্রয়োজন হলে মেডিকেশনের মাধ্যমেও উপশম সম্ভব।
থেরাপি ও কাউন্সেলিং: কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (সিবিটি), এক্সপোজার থেরাপি—এসব পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে ভয়কে মোকাবিলা করা শেখানো হয়।
জার্নাল থেরাপি: ‘আজ বৃষ্টি দেখে কেমন লাগল?’, ‘ভয় পেলাম কি?’, ‘কীভাবে সামলালাম’—বৃষ্টির দিনে নিয়মিত নিজের অনুভূতি এভাবে লিখে রাখার চর্চা মানসিক স্বস্তি এনে দিতে পারে।
পারিবারিক সহায়তা: মা-বাবা বা ভাই-বোনদের উচিত ভয়কে লুকানোর মতো বিষয় না বানিয়ে তা নিয়ে খোলামেলা কথা বলা।
স্কুলের ভূমিকা: স্কুল কাউন্সেলরদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। ক্লাসে সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।
যাদের ভয় নেই, তাদের ভূমিকা:যারা বৃষ্টিকে ভালোবাসেন, তাদের ভূমিকাও কম নয়। তারা যদি বুঝতে শেখেন, কারও ভয় পাওয়ার পেছনে কারণ থাকতে পারে; তাহলে আক্রান্তজন আর একা থাকেন না। বন্ধুত্ব, সহানুভূতি, আরেকজনের অবস্থান বোঝার চেষ্টা—এমন মানবিক আচরণই কাউকে নিরাপদ বোধ করায়।
বৃষ্টিকে ভয় পাওয়া কোনো অপরাধ নয়; বরং ভয়কে স্বীকার করে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করাই শ্রেয়।
সুবর্ণা মেহজাবীন
ছবি: ইন্টারনেট