যাপনচিত্র I ক্ষমার ক্ষমতা
ইএসপি-এলটিডি ব্র্যান্ডের স্নেকবাইট অথবা ভালচার গিটার, ব্রেসলেট আর বুট অথবা ক্যাডস। সেই সঙ্গে হাতে নিখুঁত ট্যাটু। চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে গলায় ও গিটারে গর্জন তোলা তুখোড় রকস্টার লিংকন ডি’কস্তা
আকর্ষণীয় স্টাইল, জীবনযাপনের ঢং—সবকিছু মিলিয়ে ব্যান্ড মিউজিশিয়ানরা বরাবরই তরুণদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানেন। প্রোগ্রেসিভ মেটাল ব্যান্ড আর্টসেলের ভোকালিস্ট, রিফ গিটারিস্ট ও কম্পোজার জর্জ লিংকন ডি’কস্তার কথাই ধরা যাক। ট্যাটু আঁকা হাতে গিটার নিয়ে যখন স্টেজে ওঠেন, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় দর্শকেরা। প্রশ্ন জাগতেই পারে, তার এই জনপ্রিয়তা কি শুধু জাদুকরি সংগীতের কারণে? পাশাপাশি ভিন্নধর্মী স্টাইল আর ব্যক্তিত্বের চমকও যে রয়েছে তাক লাগানো সব স্টেজ পারফরম্যান্সের পেছনে! সুরের মায়া আর স্টাইলের জাদুতেই লিংকন জয় করেছেন অগুনতি অনুরাগীর মন।
ছুটির দিনের রুটিন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘অনেকে সকালে খেতে পারেন না; তবে আমার বেলায় ব্যাপারটি ভিন্ন; বরং আমার ঘুম ভাঙে ক্ষুধায়। যত রাতেই ঘুমাতে যাই না কেন, সকাল সাতটা থেকে আটটায় ঘুম ভেঙে যায়। এরপর ফ্রেশ হয়ে নাশতা করি। মেনুতে থাকে রুটি, ডিম ও সবজি।’ দিনের প্রথম প্রহরে সময় দেন একমাত্র সন্তানকে। এরপর বাজার-সদাইয়ের কাজ থাকলে সেরে নেন। সকাল থেকে দুপুরের মাঝে সময় বের করে গানসম্পর্কিত নানা বিষয়ে মাথা ঘামান। তার মা বর্তমানে অসুস্থ থাকায় রান্নার বিষয়ে সহায়তা করেন। অনেকে হয়তো জানেন না, এই রকস্টারের রান্নার হাত দারুণ। হাতে মাখানো ডাল, পোলাও, মাছভাজা, বেগুনভাজা, মাছের ঝোল, মুরগির ঝোল, গরুর কষা মাংস, মুরগির কষা মাংস, বট ভুনা, নানা রকমের খিচুড়ি রান্নায় সুনাম আছে তার।
বেলা দেড়টার দিকে গোসল সেরে দুটায় মধ্যাহ্নভোজ সারেন। খাবারের মেনুতে থাকে ভাত, মাছ, সবজি, ঝোল তরকারি, লেবু ও কাঁচা মরিচ। ছোটবেলা থেকে মাছ খাওয়া তার পারিবারিক অভ্যাস। সপ্তাহান্তে অথবা দুই সপ্তাহে একবার মাংস খান। দুপুরে ‘ভাতঘুম’ দেওয়াও তার ‘পারিবারিক অভ্যাস’, জানালেন নিজেই। সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর পাশাপাশি নিজে বিশ্রাম নেন। বিকেল কেটে যায় চা পান এবং মায়ের সঙ্গে সাংসারিক আলাপে। সন্ধ্যায় সিনেমা দেখার বাতিক আছে। হলিউড থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও কলকাতার বাংলা সিনেমা, এমনকি নাটক—সবই থাকে ওয়াচলিস্টে। রাতে সবাই একসঙ্গে ডিনার করেন; মেনু দুপুরের মতোই। পরিবারকে সময় দেওয়া এই রকস্টারের কাছে অগ্রাধিকার পায়; কাজ না থাকলে খুব একটা বাইরে যান না। এ ছাড়া সকালের একটা সময় ট্যাবে বসে বিভিন্ন চ্যানেলের কনটেন্ট দেখে দেশ ও বিশ্বের হালচালের খবর রাখেন।
সাইকো থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার, হরর, ডিটেকটিভ জনরার সিনেমা বেশি টানে লিংকনকে। ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা, ব্যান্ড অব ব্রাদার্স, সেভিং প্রাইভেট রায়ান, আই অ্যাম লেজেন্ড, টোয়েন্টি এইট ডেজ লেটার, টোয়েন্টি এইট ইয়ারস লেটার, আফটার ডেথ, এভিল ডেড, এক্সোরসিস্ট, দ্য এক্সোরসিজম অব এমিলি রোজ, দ্য টার্মিনেটর, ট্রান্সফর্মার ও কিং কং বিশেষ পছন্দের সিনেমা। জেমস বন্ড, মিশন ইম্পসিবল ও রেসিডেন্ট ইভল সিরিজের সিনেমাগুলোও তার বেশ ভালো লাগে। কিং কং সিনেমার কিং কং চরিত্রটি তাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করে। এ ছাড়া জেমস বন্ড সিরিজের সিনেমা দেখতে দেখতে হয়েছেন পিয়ার্স ব্রুসনান, শন কনোরি, টিমথি ডেলটন ও ডেনিয়েল ক্রেগের অনুরাগী। সেলিব্রিটি ক্রাশ হলিউড অভিনেত্রী মেলানি লরেন্ট ও মনিকা বেলুচ্চি।
শরীর ও মনের যত্নের প্রসঙ্গে লিংকন বলেন, ‘এর জন্য সুখী থাকার বিকল্প নেই। বিশ্বাস করি, আমি সুখী থাকলে আমার দেহ সুখী থাকবে। আমি জন্মগতভাবে স্থূলকায় বলে বর্তমানে চিকিৎসকের পরামর্শে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছি।’ তিনি যোগ করেন, ‘আই হ্যাভ টু ইট লাইক আ বার্ড, ওয়ার্ক লাইক আ ডগ টু লিভ লাইক আ কিং। যদিও আমি ভোজনরসিক, কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটে।’ আরও বলেন, ‘সুখী হতে হলে ক্ষমা করা ও ভালোবাসার ক্ষমতা থাকা চাই। এটি সবচেয়ে বড় শাস্তি, সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ, সবচেয়ে বড় গুণ।’
দেশি রক মিউজিক সিনারিওর এই তুখোড় তারকার স্টাইলের একটি বড় অংশ তার শরীরে থাকা ট্যাটু। বাঁ হাতে ট্যাটুর সাদা অংশে ক্রুশচিহ্ন এবং কালো অংশে ক্রুশের ছায়া, দেখলে মনে হয় ত্বক থেকে উঠে আসছে ক্রুশ। এককথায়, ‘ক্রস অব জিসাস ক্রাইস্ট’। ডান হাতে সিংহ; কারণ, তিনি এ রাশির জাতক। ঘরের দেয়ালে পোস্টারের ওপর নিজেই কিছু সংকেত নিয়ে ডিজাইন করেছেন একটি কসমিক ল্যান্ডস্কেপ। এখানে আছে দ্য শিল্ড অব কিং লিওনিডাস। যারা হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা থ্রি হানড্রেড দেখেছেন, তাদের নিশ্চয় জানা আছে, কিং লিওনিডাস ছিলেন স্পার্টার রাজা। এই ঢালে আছে নানা আঘাতের চিহ্ন; তাতে ইংরেজি ‘এ’ বর্ণের মতো যা দেখা যায়, তার মাধ্যমে ঔদ্ধত্য বোঝায়। এ ছাড়া এখানে তার হরস্কোপ সাইন লিও রয়েছে। আরও আছে কসমিক লায়ন; কেননা, বনের রাজা এ প্রাণী ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না! লিংকন বলেন, ‘আমিও এমনটা থাকার চেষ্টা করি। এ ছবিতে আমি আমার পুরো জীবনকে দেখি। এটা আমারই জীবন। এখানে আমি ও আমার ছেলে যোসেফ লিওনিডাস ডি’কস্তা বিরাজমান।’
লিংকন ভ্রমণপিয়াসি। ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা ঘুরে বেড়িয়েছেন। কোনো টানাপোড়েন নেই—এমন জায়গা পছন্দের; সেটি দেশের বান্দরবানও হতে পারে। কম সময়ে ফান ও ফুডের জন্য তার কাছে থাইল্যান্ড সেরা। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়াকে মনে হয়েছে শান্তির জায়গা, যেখানে কেউ কারও সাতে-পাঁচে নেই; যে যার মতো। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে তার কাছে অনেক ভাইব্রেন্ট মনে হয়েছে। সংগীতের মানুষ হিসেবে উপলব্ধি করেছেন বিভিন্ন দেশে ট্রেন্ডি গানের সয়লাব হলেও যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা; সেখানে বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে মাইকেল জ্যাকসন থেকে শুরু করে রিচার্ড মার্ক্সের মতো শিল্পীদের রেট্রো গান ছেড়ে রাখা হয়। এ ছাড়া হলিউড, লস অ্যাঞ্জেলেস, ওয়েক্স মিউজিয়াম, ওয়াক অব ফেমের কথা তিনি আলাদাভাবে উল্লেখ করলেন।
বিদেশে খাবার হিসেবে বিফ স্টেকের অথেনটিক স্বাদ নিতে চান লিংকন। এ ছাড়া সারা রাত ধরে রান্না করা ব্রিস্কেট আছে ইচ্ছার তালিকায়। পছন্দের খাদ্যতালিকায় আছে থাই ও চায়নিজ ফুড। ভ্রমণে বাকেট লিস্টে রেখেছেন সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও কাশ্মীর। ইচ্ছা আছে ইতালির রোমে গিয়ে শ্রাউড আব তুরিন দেখার, যেখানে আচ্ছাদিত কাপড় থেকে শুরু করে যিশুর স্মৃতিবিজড়িত নানা বস্তু রয়েছে। দেখতে চান মিসরের পিরামিড; ব্ল্যাকমেইল বক্সের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এরিয়া ফিফটি ওয়ান; শ্রীলঙ্কা ও পেরু। নানা রকম মিথোলজি ও সভ্যতার নিদর্শনস্থলে ভ্রমণ তার আগ্রহের বিষয়। অ্যালিয়েন নিয়ে মাথা ঘামাতে পছন্দ করেন! প্রসঙ্গক্রমে বললেন, আর্টসেলের ‘অতৃতীয়’ গানটি অ্যালিয়েন ঘিরে।
ফ্যাশনে আরামকে প্রাধান্য দেন লিংকন; অতিরঞ্জন এড়িয়ে সাধারণ্য বেছে নেন। তার হাতে প্রায়ই শোভা পায় আর্টসেলের ব্রেসলেট ও ঘড়ি। ব্র্যান্ড-ফোকাসড তিনি একদমই নন। ‘সিমপ্লিসিটি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই রকস্টারের সংগ্রহে আছে দুটি ইএসপি-এলটিডি ব্র্যান্ডের স্নেকবাইট, একটি ভালচার ও একটি ইসি ১০০০ গিটার। ফ্যাশন আইকন হিসেবে মানেন মেটালিকা ব্যান্ডের জেমস হেটফিল্ডকে। লিংকনের মতে, টি-শার্ট থেকে লেদারের কটি—সবকিছুতেই রক মিউজিকের ওই মহাতারকা দুর্দান্ত; সঙ্গে আলাদাভাবে তার ব্যক্তিত্বকে মনে করেন অনন্য সাধারণ। এই আর্টসেল তারকার পছন্দের ভোকালিস্ট ও রিফ গিটারিস্ট জেমস হেটফিল্ড, লিড গিটারিস্ট জন পেট্রুচি, ড্রামার মাইক পোর্টনয় এবং বেজিস্ট ভিক্টর উডেন।
জীবনদর্শন সম্পর্কে লিংকন বলেন, ‘মানুষকে ভালোবাসা এবং নিজের প্রতি সৎ থাকা উচিত। সুখী থাকার জন্য সচেষ্ট থাকা দরকার। মনে রাখা চাই, জীবনে ধন-দৌলত, যশ-খ্যাতির পেছনে ছোটা বাঞ্ছনীয় নয়।’ তার মতে, ‘ভোগে ভোগান্তি, অভোগে অশান্তি, উপভোগেই প্রশান্তি।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: রনি বাউল