skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I রসিকতার রংবেরং

১ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল জোক ডে বা বিশ্ব রসিকতা দিবস। অন্যের জীবনের হাসি ছড়ানো ইতিবাচক রসিকতার চর্চা অব্যাহত থাকুক; তবে অন্যকে হেয় করার কিংবা কষ্ট দেওয়ার মতো নেতিবাচক রসিকতা যেন জীবনচর্চায় জায়গা করে নিতে না পারে

কৌতুক বা রসিকতা। নানা ক্লেদের নিষ্পেষণ থেকে জীবনে প্রাণোচ্ছলতার প্রবাহ এনে দেওয়ার এক দারুণ টোটকা। সমাজভেদে রসিকতার ধরন-ধারণও ভিন্ন। বাঙালি সংস্কৃতিতে এর রয়েছে নিজস্ব ভঙ্গিমা। আর তা বহুকাল ধরেই। কিছু রসিকতা ভীষণ তির্যক হয়ে থাকে; কিছু আবার নিরেট নির্জলা। কিছু রসিকতা কেবল হাসির ফোয়ারা বইয়ে দেয়; কিছু আবার প্রাথমিক হাসির মুহূর্ত ফুরোলে গভীর চিন্তায় মগ্ন করে তোলে। উদাহরণ হিসেবে শুরুতে এমন একটি গল্প শোনানো যাক।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত লোকসংস্কৃতি গবেষক শামসুজ্জামান খানের সংকলিত ‘বাঙালির রঙ্গ-রসিকতার গল্প’-এর ভান্ডার থেকে। সে অনেক দিন আগের কথা। এখনকার মতো এত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তখন ছিল না। ফারসি পাঠের জন্য ছিল মাদ্রাসা আর সংস্কৃত পাঠের জন্য টোল। টোলের পণ্ডিত আর মাদ্রাসার মৌলভিদের নানা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর চল ছিল। শামসুজ্জামান খান নথিভুক্ত করেছেন, ‘হিন্দুরা নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন সংস্কৃত পণ্ডিত বা বামুন-পুরুতকে। বলা ভালো, তারা খেতেও পারতেন মেলা। খাওয়ার শেষ দিকটায় হতো প্রতিযোগিতা। যেমন পুরুত মশাইয়ের গলা পর্যন্ত খাবার উঠে গেছে—এমন অবস্থায় নিমন্ত্রণকর্তা হয়তো বললেন, “পুরুত মশাই, আরেকটা রসগোল্লা খেতে পারলে আপনাকে আরও এক টাকা বেশি দেব।” টাকার লোভে তিনি খেতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন হতো যে পুরুত-বামুন আর হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারতেন না। বাঁশের তৈরি সাইংয়ে করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হতো। মৌলভি-মাওলানাদের মধ্যেও কেউ কেউ ছিলেন এমন পরখেকো খাদক। তো, একবার এক শিক্ষিতা ও সুচতুরা হিন্দু বিধবা ভাবলেন, বামুন-পুরুতেরা খাবার নিয়ে বড় অরুচিকর বাড়াবাড়ি করেন। তাই তাদের নেমন্তন্ন না করে সংস্কৃত টোলের দুজন পণ্ডিতকে নেমন্তন্ন করবেন। দুজন বিদ্বান খাবেন, দুটো জ্ঞানের কথা বলবেন, সে ভারি শোভন হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দুই পণ্ডিতকে নেমন্তন্ন করে বাড়িতে আনলেন তিনি। সমাদর করে বসালেন। অনুরোধ করলেন হাতমুখ ধুয়ে আহারে বসতে। জলের ঘটি নিয়ে বাইরে গেলেন এক পণ্ডিত। সে সময় যিনি ঘরে ছিলেন, তিনি আরেক পণ্ডিত। বিধবাকে তিনি বললেন, “মা ঠাকরান, পণ্ডিতজনকে নেমন্তন করে খাওয়ানো পুণ্যের কাজ! কিন্তু আপনি ওই ছাগলটাকে নেমন্তন করেছেন কেন?” ইতিমধ্যে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকেছেন বাইরে থাকা পণ্ডিত। আর ঘরের পণ্ডিত বাইরে গেছেন হাতমুখ ধুতে। সদ্য হাতমুখ ধুয়ে আসা পণ্ডিত তখন ভদ্রমহিলাকে বললেন, “মা জননী, আপনার মঙ্গল হোক। আপনার স্বর্গীয় স্বামীর কল্যাণ হোক। তা, আমাকে নেমন্তন্ন করায় আপনার উদ্দেশ্যকে আমি সাধুবাদ দিই। তবে ওই গাধাটাকে কেন নেমন্তন্ন করেছেন, মা ঠাকরান?” বিধবা ভদ্রমহিলা এবার ভেতরের ঘরে গেলেন। যাওয়ার আগে তাদের বলে গেলেন, “আপনারা বসুন। আপনাদের খাবার নতুন করে সাজিয়ে আনতে আমার সামান্য একটু বিলম্ব হবে।” কিছুক্ষণ পর দুটো বড় কাঠের খঞ্চার একটিতে তাজা ঘাস ও অন্যটিতে খড়বিচালি সাজিয়ে দুই পণ্ডিতের সামনে উপস্থিত হলেন বিধবা। বললেন, “খান।” এ ঘটনায় আঁতকে উঠলেন পণ্ডিতদ্বয়, “একি! আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কী?” বিধবা বললেন, “আমার ওপর ক্রুদ্ধ হবেন না। আপনারাই বলেছেন, আপনাদের একজন ছাগল, আরেকজন গাধা। আমি সেইমতো খাবার দিয়েছি। আমার অপরাধ কোথায়, বলুন?”

দুই
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রসিকতার গুরুত্ব অসীম। এ নিয়ে চিন্তা, গবেষণা ও তত্ত্বের শেষ নেই। তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে সমকালীন সাহিত্যে এ ঘিরে বারবার তিনটি তত্ত্বের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। শুরুতেই রয়েছে রিলিফ থিওরি। এর প্রবক্তা ব্রিটিশ দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেন্সার এবং অস্ট্রিয়ান নিওরোলজিস্ট ও মনোবিশ্লেষণের প্রতিষ্ঠাতা সিগমুন্ড ফ্রয়েড। এতে রসিকতাকে গণ্য করা হয়েছে মুক্তির উপায় হিসেবে। তত্ত্বটির দাবি, যা থেকে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপের উপশম ঘটে, সেটিই রসিকতা। হাস্যরস সৃষ্টির আবশ্যিক গঠন ও মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিষেধাজ্ঞা জয় ও অবদমিত ইচ্ছার বিকাশে রসিকতা ব্যবহারের এই তত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে ফ্রয়েডের ‘জোকস অ্যান্ড দেয়ার রিলেশন টু দ্য আনকনসাস’ গ্রন্থে। অন্যদিকে, সুপিরিয়রিটি থিওরি বেশ পুরোনো। এই তত্ত্বমতে, মানুষ অন্যের দুর্ভাগ্যে হাসে। কেননা, এ পরিস্থিতিতে দুর্ভাগ্যের শিকার মানুষটির তুলনায় রসিকতা উপভোগকারী মানুষটি নিজেকে উচ্চতর অবস্থানে গণ্য করে। এই তত্ত্বের উৎস নিহিত প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং থমাস হবসের চিন্তাজগতে। শেষোক্ত জনের ‘হিউম্যান নেচার’ গ্রন্থটিতে এ তত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে। আরও আছে, ইনকনগ্রুইটি থিওরি। রসিকতাবিষয়ক প্রচলিত তত্ত্বগুলোর মধ্যে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ, বেশির ভাগ রসিকতাকে এর আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। শব্দ হিসেবে ‘ইনকনগ্রুইটি’ বা ‘অসামঞ্জস্য’-এর অর্থ ব্যাপক বিস্তৃত। সামঞ্জস্যহীন যেকোনো কিছুকেই আমাদের কাছে সাধারণত হাস্যকর মনে হয়। উদাহরণ হিসেবে সার্কাসের জোকারদের ভাবা যেতে পারে। তাদের অস্বাভাবিক আকৃতি, যুক্তিহীন কথাবার্তা, অসামঞ্জস্য অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি দর্শকের মনে হাসির খোরাক জোগায়। কেননা, সেগুলো আমাদের প্রত্যাশার পারদ ছাপিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ভাষ্য, কোনো টান টান প্রত্যাশা আচমকা শূন্যতায় পর্যবসিত হলে তা হাসির উদ্রেক ঘটায়।

তিন
রসিকতা যেহেতু হাসি ডেকে আনে, তাই এর স্বাস্থ্যগত উপকারিতা অনেক। গবেষণায় প্রমাণিত, হাসলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে; ফলে কমে স্ট্রোক বা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি। প্রাণোচ্ছল থাকলে নিঃসরণ ঘটে স্ট্রেস হরমোনের; ফলে মুক্তি ঘটে উৎকণ্ঠা ও মানসিক চাপ থেকে। তা ছাড়া হাসির কারণে তলপেটের পেশি সংকুচিত ও প্রসারিত হয় বলে সহজে সেই পেশির ব্যায়াম হয়ে যায়। তাই রসিকতা আদতে সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বেশ বাড়িয়ে দেয়।

চার
মাত্রা ছাড়ানো কোনো কিছুই মঙ্গলকর নয়; রসিকতার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে বিবেচনাবোধ জরুরি। যে রসিকতা অন্যের মুখে হাসি এনে দেওয়ার বদলে তার অন্তরকে রক্তাক্ত করে, তা পরিহার্য। কেননা, তা আদতে নিছক রসিকতা হয়ে থাকে না; বরং অদৃশ্য অথচ কার্যকর অস্ত্র হিসেবে অপরকে ঘায়েল করে। রসিকতার নামে তাই কাউকে কষ্ট দেওয়া, রাগিয়ে তোলা অনুচিত।

পাঁচ
১ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল জোক ডে বা বিশ্ব রসিকতা দিবস। অন্যের জীবনের হাসি ছড়ানো ইতিবাচক রসিকতার চর্চা অব্যাহত থাকুক; তবে অন্যকে হেয় করার কিংবা কষ্ট দেওয়ার মতো নেতিবাচক রসিকতা যেন জীবনচর্চায় জায়গা করে নিতে না পারে।
সবার জীবনে হাসির ফোয়ারা বয়ে যাক। মঙ্গল হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top