skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I ব্লু জোন ডায়েট

সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন পেতে এই ডায়েটের চাহিদা বাড়ছে। সঠিক নিয়মে চর্চার পরামর্শ দিলেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি

খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া ও জীবনযাত্রার ধরনের পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশে গড় আয়ু কমছে। বার্ধক্যের আগেই অনেক নারী-পুরুষের শরীরে দেখা দিচ্ছে নানা শারীরিক সমস্যা। আজকাল কিশোর-কিশোরীদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ কিডনির নানা জটিলতা, ওবেসিটি, এমনকি স্ট্রোক বা হার্টের সমস্যা ইত্যাদিও কমন। এত কম বয়সে এ ধরনের রোগ খুবই দুঃখজনক। যদি একটু সচেতনভাবে ভাবা যায়, তাহলে বোঝা সম্ভব, আমরা কতটা অনিয়ম করি। তবে এ সমস্যা পৃথিবীর সকল দেশে সমান নয়। অনেক দেশে এখনো ৯৫ বা ১০০ বছর বয়সেও অনেকে থাকছেন প্রাণবন্ত, কর্মক্ষম ও হাস্যোজ্জ্বল। বয়স যেন শুধুই একটি সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় তাদের কাছে। সত্যি বলতে বয়স নয়; স্বাস্থ্যই আসল সাফল্য।
২০০৪ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের উদ্যোগে লেখক ও অনুসন্ধানী গবেষক ড্যান বুয়েটনার সারা পৃথিবীতে এমন কিছু অঞ্চল চিহ্নিত করেন, যেগুলোতে মানুষের গড় আয়ু অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। তিনি দেখেন, এসব অঞ্চলের নাগরিকদের জীবনে বার্ধক্য আসে খুবই ধীরে ও সুস্থিরভাবে। এই অঞ্চলগুলোকেই তিনি নাম দেন ব্লু জোন; সরল অর্থে, পৃথিবীর দীর্ঘজীবীদের ঠিকানা। ব্লু জোনগুলো হলো—
 ওকিনাওয়া, জাপান: এখানে নারীদের গড় আয়ু বিশ্বে সর্বোচ্চ।
 সার্ডিনিয়া, ইতালি: পুরুষদের দীর্ঘজীবী হওয়ার হার এখানে সবচেয়ে বেশি।
 ইকারিয়া, গ্রিস: ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার রোগ আজকাল সারা বিশ্বে কমন হলেও এখানে এটি প্রায় অনুপস্থিত।
 নিকোয়া, কোস্টারিকা: কম স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন এই অঞ্চলে দৃঢ়।
 লোমা লিন্ডা, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র: স্বাস্থ্যসচেতন সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট সম্প্রদায়ের বসবাসস্থল।
ডায়েটে সংযোগ
ব্লু জোন অঞ্চলের অধিবাসীরা যে স্বাস্থ্যকর জীবনের অধিকারী হন, তা অর্জনের নিমিত্তে ব্লু জোন ডায়েট চর্চার চল শুরু হয়েছে। এটি কেবলই খাদ্যতালিকা নয়; বরং একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই ও মানসিক প্রশান্তিনির্ভর জীবনধারার রূপরেখা। ওই অঞ্চলগুলোর মানুষ দীর্ঘজীবী শুধু নন; তারা সুখী, প্রশান্ত ও কর্মক্ষম থাকেন শতবর্ষ বয়সেও। আর ব্লু জোন ডায়েট শুধু খাবার গ্রহণ বা পরিত্যাগের বিষয় নয়; এটি খাদ্যের চেয়ে বেশি কিছু। ব্লু জোন অঞ্চলের মানুষদের খাদ্যাভ্যাস, জীবনশৈলী, শারীরিক কার্যকলাপ, সামাজিক সংযোগ ও মানসিক শান্তির মাঝে রয়েছে একটি সামঞ্জস্য। এটি কোনো বিশেষ ডায়েট ট্রেন্ড নয়; বরং শতাব্দীকাল ধরে চলে আসা অভ্যাস ও খাদ্যসংস্কৃতির মিশ্রণ; যা স্বাস্থ্য, সুখ ও দীর্ঘায়ুর এক দারুণ উপায়। তবে এই ডায়েটের চর্চা করতে মানা চাই এর মূলনীতিগুলো।
উদ্ভিজ্জভিত্তিক খাদ্য গ্রহণ
ব্লু জোন ডায়েট অনুসরণ করতে গেলে অ্যানিমেল প্রোটিন খুবই অল্প পরিমাণে গ্রহণ করা চাই। নানা রকম শাকসবজি, মৌসুমি ফল, বাদাম, শস্যদানা, ডাল গ্রহণই এ ডায়েটের প্রধান অংশ।
রেডমিট ও প্রসেসড ফুডে সীমারেখা
কম-বেশি সবাই জানি, অতিরিক্ত পরিমাণে রেডমিট গ্রহণ করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক সময় বেশ অসুবিধার কারণ হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে রেডমিট, প্যাকেটজাত খাবার, ক্যান ফুড, ফাস্ট ফুড ও প্রিজারভেটিভযুক্ত খাবার প্রায় একেবারেই পরিহার করেন ব্লু ডায়েট অঞ্চলের অনুসারীরা।
অতিভোজন নয়
‘হারা হাচি বুও’। অর্থাৎ পরিমিত ভোজনের দর্শন। ব্লু জোন অঞ্চলের মধ্যে জাপানি ওকিনাওয়ানদের এই দর্শনে বলা হয়, ৮০% পেট ভরলেই খাওয়া বন্ধ করা উত্তম।
প্রতিদিন ডাল ও বাদাম
প্রোটিন বলতেই অনেকে শুধু মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি খাদ্যপণ্যকে বোঝেন; অথচ ডাল, বাদাম, বীজও যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিনসমৃদ্ধ। এ ছাড়া এগুলো ফাইবারেরও দারুণ উৎস। ব্লু জোন ডায়েটে ডাল ও বাদাম থাকে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়।
চিনি ও লবণের পরিসীমা
হোয়াইট পয়জন বলতে চিনি, লবণ—এ ধরনের উপাদানকে বোঝানো হয়। ব্লু জোন ডায়েট চর্চাকারীরা চিনি ও অতিরিক্ত লবণ বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক স্বাদের খাবার গ্রহণ করেন নিয়মিত। এ ছাড়া তারা প্যাকেটজাত মিষ্টি বা স্ন্যাকস একেবারেই এড়িয়ে চলেন। কেননা, সেগুলোতে থাকা বাড়তি লবণ, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট ইত্যাদি শরীরের ওপর সব সময় খারাপ প্রভাব ফেলে।
প্রাকৃতিক পানীয় গ্রহণ
ব্লু জোন ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত থাকে ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার, হারবাল টি, মসলা চা, লেবুপানি ইত্যাদি। এ ধরনের ডায়েট যারা অনুসরণ করেন, তাদের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হয় সফট ড্রিংক, এনার্জি ড্রিংক বা প্যাকেটজাত জুসগুলো।
দল বেঁধে আহার
পরিবারকে সময় দেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো ও আড্ডাবাজি করা, সামাজিক সংযোগ বজায় রাখাসহ উপভোগ করে খাওয়াদাওয়া করা ব্লু জোন অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক রীতি।
প্রাত্যহিক সক্রিয়তা
শারীরিক সক্রিয়তা দৈনন্দিন জীবনের অংশ। সে ক্ষেত্রে বাগান করা, হাঁটাচলা, রান্না করা, ঘরের কাজ সারা এ ডায়েটের অনুসারীদের ব্যায়াম হিসেবে গণ্য।
জীবনের উদ্দেশ্য ও মানসিক প্রশান্তি
ওকিনাওয়ানরা যাকে বলে ‘ইকিগাই’; অর্থাৎ এই জীবনের একটি মানে থাকা। প্রার্থনা, ধ্যান ইত্যাদি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়; মন রাখে ভালো। আর মন ভালো থাকলে শরীরও থাকে তুলনামূলক সুস্থ।
প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ
সুস্থ জীবনযাপন ও দীর্ঘায়ু কে না চায়! তাই ব্লু জোন ডায়েট বিশেষ করে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামাঞ্চলে অনুসরণ করা খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। গ্রামের মানুষ সাধারণত ভোরে উঠে মাঠে কাজে যান আর সন্ধ্যায় খাবার গ্রহণের পর বেশি রাত না জেগে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস তাদের।
বলা হয়, মাছে-ভাতে বাঙালি। সে ক্ষেত্রে মাংসের চেয়ে আমাদের দেশে এখনো বিশেষত গ্রামাঞ্চলে মাছের চাহিদাই বেশি। এ ছাড়া নানা রকম পিঠা-পুলিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ খাবার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঘরে তৈরি খাবারগুলোর প্রতি আকর্ষণ এখনো এ দেশে কম নয়। আবার বাংলাদেশে প্রচলিত খাবারের দিকে একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, আমাদের খাদ্যতালিকায় সাধারণত থাকে চাল, ডাল, নানা ধরনের শাকসবজি, লাউ, তিল, খেজুর, কলা, নারকেল, ভুট্টা, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি। এগুলো সবই অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং এনার্জিবহুল। নির্দিষ্ট পরিমাণ ও ভারসাম্য রক্ষা করে, একটু সচেতনভাবে এগুলো গ্রহণ করতে পারলে আমাদের দেশের মানুষও পেতে পারে সুখী ও দীর্ঘায়ুর জীবন।
জীবনচর্চায় যোগ
লাইফস্টাইল ও ব্লু জোন ডায়েট নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় মিলেছে এই ডায়েটের বিশেষ উপকারিতার তথ্য-উপাত্ত।
 ব্লু জোন ডায়েট হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক এবং হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা রক্ষা করে।
 এই ডায়েটে আগে থেকেই চিনি গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে ভূমিকা রাখে।
 ইমিউনিটি বুস্টার হিসেবে কাজ করে।
 ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ভালো রাখে এবং অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের উন্নতি ঘটায়।
 ওবেসিটি কমাতে এবং স্থায়ীভাবে সঠিক বিএমআই বজায় রাখতে সাহায্য করে।
 মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
 ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
প্রবাদ আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ব্লু জোন ডায়েট এমন একটি ডায়েট, যেখানে আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য, জীবনযাপন ও মানসিক শান্তি একসঙ্গে কাজ করে। এগুলোকে ব্যালেন্স করে সুস্থ ও দীর্ঘায়ু জীবন পেতে কিছু পরামর্শ মানা যেতে পারে।
 খাদ্যতালিকায় আজ থেকে বাদ দিতে পারেন প্যাকেটজাত খাবারগুলো। এ ছাড়া চিপস, সকল রকম সফট ড্রিংকস ইত্যাদিও সরিয়ে ফেলুন ডায়েট থেকে।
 প্রতিদিনের ডায়েটে যোগ করুন যথেষ্ট পরিমাণ ফ্রুটস, নাটস, ভেজানো মুগ ডাল, স্প্রাউট ইত্যাদি।
 প্রতিদিন অন্তত এক বেলা প্রোটিনজাতীয় খাবার গ্রহণ করুন।
 সাধারণত আমরা রাতে বেশ ভারী খাবার খেয়েই শুয়ে পড়ি; অথচ এই অভ্যাস ঝেড়ে ফেলা এবং হালকা ও পরিমিত খাবার গ্রহণ করা উত্তম।
 মন ভালো থাকলে শরীর ভালো থাকে—এ বেশ জানা কথা; তাই পরিবারকে সময় দিন, পরিবারের সঙ্গে বসে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
 দীর্ঘ সময় গ্যাজেট ব্যবহার না করে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবহারের চেষ্টা করুন। বিশেষত, রাতে ঘুমানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত সেলফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
 খুব সকালে উঠলে ইয়োগা বা মেডিটেশন করতে পারেন। এ ছাড়া রাতে ঘুমানোর আগেও করা যেতে পারে এ ধরনের অনুশীলন।
 ক্লান্ত শরীরে অনেক সময় কোনো রকম ব্যায়াম করার ইচ্ছা জাগে না। সে ক্ষেত্রে সকালেই সেরে নিতে পারেন কিছুক্ষণের জন্য হালকা ওয়ার্কআউট; যেমন হাঁটাচলা করা। এতে সারা দিনে গুড স্ট্যামিনা পাবেন। তবে সময়ের অভাব থাকলে দিনের যেকোনো সময় অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার চর্চা করুন।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top