টেকসহি I বায়োটেক বুম
সৌন্দর্যশিল্পে উদ্ভাবন এবং সাসটেইনেবিলিটি চর্চায় অগ্রগতির পরবর্তী ধাপ। বিজ্ঞান ও প্রকৃতির এমন একটি মিলিত সূত্র; যা বিউটি ফর্মুলেশনের ধারণা, উৎপাদন ও বিতরণের ভোল পাল্টে দিয়েছে পুরোদস্তুর। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এমন এক ভবিষ্যতের, যেখানে কার্যকারিতার সঙ্গে সমান গুরুত্ব পাবে নৈতিক দায়িত্ববোধও
২০২৩ সালে সৌন্দর্যবিশ্বে দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘বায়োটেক বিউটি’। হয়ে উঠেছিল ট্রেন্ডি বাজওয়ার্ড। সৌন্দর্যশিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলতে শুরু করেন, এই ইন্ডাস্ট্রির ফেসলিফট করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারণ, সে বছর ৫৭১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের প্রত্যাশিত আয় এবং বিক্রয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও পার্সোনাল কেয়ার সেগমেন্টটি নিয়ে ভোক্তাদের চাওয়া-পাওয়ার পারদ বাড়তেই থাকে। আরও ইনক্লুসিভ প্র্যাকটিস, কঠোর সুরক্ষার পাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিরও দাবি বাড়তে থাকে সমানতালে। ‘ক্লিন বিউটি’ টার্ম দিয়ে আর দিলখুশ করা যাচ্ছিল না ভোক্তাদের। এগুলোর নিরাপত্তা আর কার্যকারিতা নিয়েও বিতর্ক বাড়ছিল। ফলাফল নতুন অন্তর্ভুক্তি—‘বিউটি বায়োটেক’।
পরিচয় সন্ধান
জীববিজ্ঞানের নীতিমালা ব্যবহার করে, এমন যেকোনো প্রযুক্তিকেই জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সৌন্দর্য খাতে সাধারণত ফার্মেন্টেশন, টিস্যু কালচার, জিএমও, সেল কালচার আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো কৌশল ব্যবহারে ফর্মুলেশন এর প্রধান উদ্দেশ্য। এরই মধ্যে নানা ধরনের লিভিং অরগানিজম আর মলিকিউলার বায়োলজি ব্যবহারে বিভিন্ন সৌন্দর্যপণ্যে ব্যবহৃত উপাদান আর থেরাপিউটিক; যেমন ল্যাকটিক অ্যাসিড, সোডিয়াম হায়ালুরনেট, সেরামাইউ, পেপটাইড, বিসাবোলোল আর বায়োস্যাকারাইড উৎপাদিত হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে অনেক উপাদান বহু আগে থেকে বিদ্যমান; কিন্তু বর্তমানে বাড়তি লাভের আশায় বড় বায়োটেক বিপ্লব হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত উদ্ভাবন হলো প্রক্রিয়াগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন ফরম্যাটে ব্যবহার করা। পাশাপাশি কেবল কাঁচামালের ক্ষেত্রেই নয়; প্যাকেজিং অথবা চূড়ান্ত পণ্যে জৈবপ্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি। আশার ব্যাপার হচ্ছে, সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে সৌন্দর্যশিল্প। ব্র্যান্ডগুলো আরও অভিনব ফর্মুলা ব্যবহারে তৈরি শুরু করেছে সাসটেইনেবল প্রোডাক্ট।
বায়োটেকনোলজি আর সাসটেইনেবিলিটি
মানুষমাত্রই পৃথিবীর জৈবিক উপাদানগুলো শনাক্তে পারদর্শী, যা জীবনকে সহজ করে তুলতে পারে। মানুষ যা দেখে, তার প্রতিলিপি তৈরি করার বদলে আসল উৎসেরটা তুলে আনতেই বরং বেশি স্বচ্ছন্দ। যেমন উল ফাইবার তৈরির চেষ্টা না করে, ভেড়ার লোম ছাঁটাই করে সোয়েটার তৈরির ব্যাপারটাই এই সত্যতা প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ। এই অ্যানিমেল বেসড সোর্সিং একদমই সাসটেইনেবল নয়। সে ক্ষেত্রে সোর্সিং ফরমেটে পরিবর্তন এসেছে। যোগ হচ্ছে প্ল্যান্ট বেসড সব বিকল্প। কিন্তু এ-ও তো যথেষ্ট নয়; কারণ, পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে সাসটেইনেবল বানাতে যে পরিমাণ গাছের প্রয়োজন, তা পূরণের সক্ষমতা পৃথিবীতে নেই। একটা ছোট্ট উদাহরণ। ধরা যাক, মাত্র কয়েক মিলিলিটার রোজ অয়েল তৈরির জন্য প্রয়োজন পড়ে দুই লাখের মতো গোলাপ পাপড়ির। সেকি চাট্টিখানি কথা! আর এ ক্ষেত্রে কাজ করে বায়োটেকনোলজি।
পৃথিবীর বুকে উৎপাদন করে নয়, ল্যাবরেটরি সেটিংয়ে বিকল্প উপাদান তৈরির মাধ্যমে। এতে করে জমি বাঁচে; বাঁচে প্রচুর পানি। সরাসরি প্রভাব পড়ে পরিবেশের ওপরও। নানা দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা করে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পাম অয়েল। এটি পার্সোনাল কেয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে বিপুল ব্যবহৃত একটি উপাদান। সারফেকটেন্ট (সাবান ও শ্যাম্পুতে ফেনা তৈরি করে) থেকে ইমালসিফায়ার (লোশন ও ক্রিমে টেক্সচার বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়)—সবেতেই ব্যবহৃত হয় এই উপাদান। কিন্তু এর চাষ খুব ঝামেলাপূর্ণ। পৃথিবীজুড়ে ডিফরেস্টেশনের অন্তত ৬০ শতাংশ এর ফলে হয়ে থাকে। শিশুশ্রম ও দাসপ্রথার জন্যও এটি দায়ী। এ ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জায়গাগুলোতে পামগাছ হয়। কার্বন-ঘন, জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট আর পিটল্যান্ডগুলোতে। এগুলোর সংরক্ষণ পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা জেনেও যুগের পর যুগ পাম অয়েল উৎপাদকদের এসব বন উজাড় করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পাম অয়েল প্ল্যান্টেশন তৈরির পরিকল্পনায়। কিন্তু সময় বদলেছে। C16 বায়োসায়েন্স অ্যান্ড পামলেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এমন এক ধরনের বায়োটেকনোলজি, যার মাধ্যমে গাছ নয়, ইস্টকে কাজে লাগিয়ে বানানো হচ্ছে পাম অয়েলের বিকল্প। প্রিসাইজ ফার্মেন্টেশন নাম দেওয়া হয়েছে এ প্রক্রিয়াকে। এর মাধ্যমে উৎপাদিত তেল দিয়ে ভোক্তার চাহিদা মেটানোও সহজ হচ্ছে।
এ ছাড়া বায়োটেকনোলজি ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে জেনেটিক্যালি মডিফাইড সব প্ল্যান্ট; যা দিয়ে সাসটেইনেবল সব সৌন্দর্য উপাদান তৈরির কাজ হচ্ছে সহজে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরীটির নাম হচ্ছে ইজিএফ (এপিডারমাল গ্রোথ ফ্যাক্টর); একটি শক্তিশালী ত্বকযত্নের উপাদান এবং যা সাধারণত প্রাণী থেকে সংগ্রহ করা হলেও এবারই হয়েছে ভিন্নভাবে। দুই মাসের দীর্ঘ নিরীক্ষার পর ফলও মেলে ইতিবাচক। ব্যবহারকারীদের ত্বকের পুরুত্ব ৬০ শতাংশ অবধি বাড়ে এবং ঘনত্ব বাড়ে ৩০ শতাংশের বেশি। এ বছর তো আরও শক্তিশালী ফর্মুলেশন তৈরি হয়েছে বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে; যা পুরো অ্যান্টি এজিং ইন্ডাস্ট্রির ভোল পাল্টে দিতে যথেষ্ট। ল্যাব, গ্রোন বোটানিক্যাল আর ফার্মেন্টেড অ্যাকটিভ ছাড়াও বায়োবেসড পলিমার তৈরি হচ্ছে বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে; যা দিয়ে হেয়ার কেয়ার, স্কিন কেয়ার আর কসমেটিক ফর্মুলেশনের সিনথেটিক কাউন্টারপার্টগুলো প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে সাসটেইনেবল সব বিকল্প দিয়ে।
বিউটি ডেস্ক
মডেল: তাসনিয়া ফারিণ
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল