কুন্তলকাহন I এয়ার ড্রায়িং VS ব্লো ড্রায়িং
অনেকাংশেই ব্যবহারকারীর ওপর নির্ভরশীল। তাই যাচাই-বাছাই না করে অন্ধবিশ্বাস চুলের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে
একজন নারীর সৌন্দর্য, আত্মবিশ্বাস ও স্টাইল স্টেটমেন্টের বড় অংশজুড়ে থাকে চুল। নানা রঙে রাঙানো, ঢেউখেলানো বা সোজা—প্রতিটি স্টাইলের মাঝেই লুকিয়ে থাকে যত্ন ও সচেতনতা। নিয়মিত যত্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চুল শুকানো। অনেকে মনে করেন, এয়ার ড্রাই বা স্বাভাবিক বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া চুলের জন্য বেশি উপকারী। আবার কেউ কেউ ব্লো ড্রাই ছাড়া স্টাইলিং ভাবতেই পারেন না। চুল কি স্বাভাবিকভাবে শুকানোই উত্তম, নাকি হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা উচিত? এই দ্বিধার উত্তর একরৈখিক নয়। কারণ, চুলের ধরন, রুটিন, আবহাওয়া এবং স্টাইলিংয়ের প্রয়োজন—সবকিছুই এ সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখে। দুই পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা, চুলের ধরন অনুযায়ী কোনটি উপযুক্ত—এগুলো জানার চেষ্টা তাই আগেভাগেই জরুরি।
এয়ার ড্রায়িং
কোনো ধরনের তাপ প্রয়োগ না করে স্বাভাবিকভাবে চুল শুকানো। অনেকে এ পদ্ধতিকে ‘নিরাপদ’ মনে করেন; যা একদমই ভুল নয়। কারণ, এতে হিট ড্যামেজের ভয় নেই। চুলের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা ও স্বাভাবিক গঠনও বজায় থাকে। কোনো যান্ত্রিক চাপ না থাকায় কিউটিকল ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না; বরং চুলের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা রয়ে যায় অক্ষুণ্ন। বিশেষ করে রং কিংবা কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট করা চুলের ক্ষেত্রে এয়ার ড্রাই তুলনামূলক নিরাপদ।
সুবিধা
তাপের ব্যবহার না থাকায় চুলের কিউটিকল ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
ঘরে বসে অল্প পরিশ্রমে সম্ভব।
সময় বাঁচে; বিদ্যুৎ বা যন্ত্রপাতির দরকার পড়ে না।
অসুবিধা
কোঁকড়া বা ঘন চুল হলে শুকাতে সময় লাগে।
বাতাসে শুকালে ফ্রিজ বা অগোছালোভাব দেখা দিতে পারে।
ভেজা অবস্থায় চুল সবচেয়ে নাজুক, যা ভাঙার শঙ্কা বাড়ায়।
কার্যকর কৌশল
মাইক্রোফাইবার তোয়ালে ব্যবহার করতে হবে; এটি দ্রুত পানি শোষণ করে এবং ফ্রিজ কমায়।
চুলে সেরাম বা লিভ-ইন কন্ডিশনার মাখা চাই; এতে মসৃণতা বাড়ে এবং স্টাইল বজায় থাকে।
চুল আঁচড়াতে ওয়াইড-টুথ কম্ব বেছে নেওয়া চাই; এতে ভাঙার শঙ্কা কমে।
হালকা বেণি বা বান করে রাখলে ঢেউখেলানো প্রাকৃতিক লুক পাওয়া যায়।
ব্লো ড্রায়িং
সময় সাশ্রয়, স্মুথ ফিনিশ কিংবা ভলিউম চাইলে অনেকে ব্লো ড্রায়িংয়ে ভরসা রাখেন। এটি স্টাইলিংয়ের ক্ষেত্রে একধরনের ম্যাজিকের মতো—কম সময়ে চুল শুকায় এবং কাঙ্ক্ষিত ফর্মও পাওয়া যায়। ব্লো ড্রাই মানেই তাপের সংস্পর্শ। ফলে সময় বাঁচে এবং স্টাইলিং সারা যায় দ্রুত। অফিস, পার্টি বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের আগে চুলে প্রয়োজন অনুযায়ী বাউন্সি, সোজা কিংবা ওয়েভি লুক তৈরি করা যায় এই পদ্ধতিতে। তবে নিয়মিত বা ভুল পদ্ধতিতে ব্যবহারে হিট ড্যামেজ, রুক্ষভাব, স্প্লিট এন্ডসহ স্থায়ী ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে।
সুবিধা
চুল শুকানোর সময় বাঁচে।
সোজা, ঢেউখেলানো বা ভলিউমনাস স্টাইল সহজ হয়।
অফিস, পার্টি বা অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় কার্যকর।
অসুবিধা
নিয়মিত ব্যবহার করলে চুল রুক্ষ ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
হিট প্রটেকশন না দিলে স্প্লিট এন্ড ও চুল ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
নিম্নমানের ড্রায়ার বা অতিরিক্ত তাপ চুলের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে।
কার্যকর কৌশল
হিট প্রটেক্ট্যান্ট স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার করতেই হবে; এটি চুলকে তাপের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
ড্রায়ার সেটিং মিডিয়াম হিটে রাখলে অতিরিক্ত গরম বাতাস এড়ানো যাবে সহজে।
নোজেল অ্যাটাচমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে; এতে ফোকাসড হিটে স্টাইলিং সহজ হয়।
চুল শেষ হলে ‘কুল শট’ ব্যবহার করুন; সেটিং ফিনিশ দেয় ও শাইন বাড়ায়।
কার্যকারিতার মাপকাঠিতে
এয়ার ড্রাই উপযুক্ত
চুলে রং করা বা কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট করা থাকলে।
চুল পাতলা বা ভঙ্গুর হলে।
প্রাকৃতিক ঢেউ বা কোঁকড়ানো স্টাইল বজায় রাখতে চাইলে।
ব্লো ড্রাই উপযুক্ত
চুল খুব ঘন বা ভারী হলে।
দ্রুত শুকানোর প্রয়োজন পড়লে নিয়মিত।
সুনির্দিষ্ট স্টাইল বা ফর্ম দরকার হলে।
তবে এ কথাও সত্য, একই ব্যক্তির জন্য সপ্তাহে এক দিন ব্লো ড্রাই ও পরের দিন এয়ার ড্রাই পদ্ধতি মিলিয়ে ব্যবহার করলেও ভারসাম্য বজায় থাকে।
থাকুক খেয়াল
সঠিকভাবে শুকানোর পাশাপাশি বাড়তি কিছু বিষয় খেয়াল রাখলে চুল আরও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেখাবে।
সপ্তাহে অন্তত একবার হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করা; এটি চুলের গভীরে পুষ্টি জোগায়।
৮-১২ সপ্তাহ পরপর চুল ট্রিম করা; যা স্প্লিট এন্ড রোধে কার্যকর।
সিল্ক বালিশের কভার ব্যবহার; এতে চুল কম ভাঙে।
সপ্তাহে অন্তত এক দিন ‘হিট-ফ্রি ডে’ রাখা; এতে চুল বিশ্রাম পায়।
ভেতর থেকে যত্ন নিতে পানি ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা।
এ ছাড়া অনেকে নিয়মিত ড্রায়ার ব্যবহার করলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর দেন না। ফলে ডিভাইসের কার্যকারিতা কমে যায়, চুলে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি হয়। সঠিক যত্নে একটি হেয়ার ড্রায়ার বছরের পর বছর নির্ভরযোগ্যভাবে কাজ করে যেতে পারে।
ফিল্টার পরিষ্কার রাখা
বেশির ভাগ ব্লো ড্রায়ারের পেছনে একটি ফিল্টার থাকে, যেখান দিয়ে বাতাস টানে। প্রতি ১ থেকে ২ সপ্তাহে একবার ফিল্টার খুলে ধুলা ও চুল পরিষ্কার করা উচিত। ব্লো ড্রায়ার গরম কিংবা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক সময় ফিল্টারে কিছু আটকে যাওয়ার কারণে ঘটে। প্রয়োজনে টুথব্রাশ বা কটন বাড দিয়ে ধুলা পরিষ্কার করা চাই।
ভেজা হাতে ব্যবহার না করা
পানি বা ভেজা হাতে ব্যবহার করলে শর্ট সার্কিট বা দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। ড্রায়ার শুকনো জায়গায় রেখে ব্যবহার করা জরুরি।
কর্ড বা তারের যত্ন
ড্রায়ারের তারে বেশি প্যাচ থাকলে ভেতরে সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবহার শেষে ঢিলে করে গোল করে গুটিয়ে রাখা উচিত। কর্ডে যদি ফাটল বা পোড়া দাগ দেখা যায়, দ্রুত বদলানো প্রয়োজন।
মাথার অ্যাটাচমেন্ট পরিষ্কার রাখা
কনসেন্ট্রেটর নোজেল বা ডিফিউজার ব্যবহারের পর মাসে অন্তত একবার সাবান-পানিতে ভিজিয়ে পরিষ্কার করা ভালো। স্টাইলিং প্রোডাক্ট বা চুলের তেল লেগে গেলে তাপ বাড়ে; যা পুড়ে ধোঁয়া তৈরি হতে পারে।
অন্যান্য ফিচার ব্যবহার
‘কুল শট’ ব্যবহার করলে শুধু চুলই নয়, ড্রায়ারও একটু ‘ব্রেক’ পায়। এটি মোটরের অতিরিক্ত গরম হওয়া রোধ করে ড্রায়ারের আয়ু বাড়ায়।
সঠিক জায়গায় সংরক্ষণ
বাথরুমে না রেখে শুষ্ক, ধুলাবিহীন জায়গায় রাখা ভালো। ড্রয়ারে বা কাপবোর্ডে একটি কভার দিয়ে রাখা হলে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
নিয়মিত সার্ভিসিং
ব্যয়বহুল বা প্রফেশনাল গ্রেডের ড্রায়ার হলে বছরে একবার সার্ভিসিং করানো যেতে পারে। এতে মোটর ও ফ্যানের কার্যকারিতা ঠিক থাকে।
বিকল্প সন্ধান
চুল শুকানোর পদ্ধতি শুধু এয়ার ড্রাই বা ব্লো ড্রাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক হেয়ার কেয়ার রুটিনে আরও কিছু বিকল্প ও সহায়ক উপায় রয়েছে, যেগুলো চুলের ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা যায়।
মাইক্রোফাইবার টাওয়েল ড্রাই
এটি এয়ার ড্রাইয়ের বিকল্প বা সহায়ক স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি।
তুলনামূলকভাবে দ্রুত পানি শোষণ করে।
সাধারণ তোয়ালের চেয়ে কম ঘর্ষণ তৈরি করে।
কোঁকড়ানো এবং পাতলা—দুই ধরনের চুলেই আদর্শ।
টার্বান র্যাপ ড্রাই
বিশেষ হেয়ার-টার্বান বা মাইক্রোফাইবার হুড দিয়ে চুল মোড়ানো হয়।
হ্যান্ডস-ফ্রি অপশন।
শাওয়ারের পরে মেকআপ বা কাজ করতে করতেই চুল আংশিক শুকিয়ে যায়।
ভলিউম তৈরি হয় চুলের গোড়ায়।
ডিফিউজার দিয়ে শুকানো
ব্লো ড্রায়ারের সঙ্গে একটি ডিফিউজার অ্যাটাচমেন্ট ব্যবহার করে কোঁকড়ানো বা ওয়েভি চুল শুকানো হয়।
এতে কার্ল বা ওয়েভের ডেফিনিশন ঠিক থাকে।
হিট ড্যামেজ কম হয়।
ভলিউম বাড়ে।
হুডেড ড্রায়ার ব্যবহারে
সেলুন বা ঘরে বড় হুড-টাইপ ড্রায়ারের নিচে বসে ব্যবহার করা হয়।
ঘন ও লম্বা চুলের জন্য কার্যকর।
ডিপ কন্ডিশনিং ট্রিটমেন্টের সময় আদর্শ।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় সহজে।
টাওয়েল প্রেস টেকনিক
তোয়ালে বা টি-শার্ট দিয়ে ভেজা চুলে হালকা চাপ দিয়ে পানি শুষে নেওয়া হয়।
চুলে অযথা ঘষাঘষি হয় না।
কোঁকড়ানো চুলের জন্য নিরাপদ।
ফ্রিজ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
প্লপিং (বিশেষ করে কার্লি হেয়ার প্র্যাকটিস)
তুলার টি-শার্ট বা মাইক্রোফাইবার কাপড়ে চুল মোড়ানো হয়।
কার্লের বাউন্স ও ডেফিনিশন বজায় থাকে।
হিট ছাড়া শুকানোর মেথড।
নাইট টাইম এয়ার ড্রাই
ঘুমের সময় চুল শুকানো হয়; সাধারণত সিল্ক পিলো কেস বা হেয়ার ক্যাপ পরে।
সময় বাঁচে।
ধীরে ধীরে প্রাকৃতিকভাবে শুকায়।
হিট-মুক্ত পদ্ধতি।
কম্বো মেথড
চুল আংশিকভাবে এয়ার ড্রাই করে তারপর ব্লো ড্রাই দিয়ে শেষ করা হয়।
হিট এক্সপোজার কমে।
স্টাইলিং সুবিধা পাওয়া যায়।
দ্রুত শুকানো যায়।
চুলের সৌন্দর্য বজায় রাখতে অতিরিক্ত স্টাইলিং নয়, প্রয়োজন ভারসাম্য ও সচেতনতা। এয়ার ড্রাইয়ের প্রাকৃতিক যত্ন এবং ব্লো ড্রায়িংয়ের শার্প স্টাইল—উভয়ের মাঝে রয়েছে নিজের জন্য উপযোগীটা বেছে নেওয়ার সুযোগ। সময়, চুলের ধরন এবং প্রয়োজন বিবেচনায় শুকানোর পদ্ধতিকে রূপ দিতে হবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী। তাপ ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে পরিহার না করেও চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করা যায়। শুধু প্রয়োজন সঠিক প্রোডাক্ট, উপযুক্ত প্রযুক্তি এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
স্বর্ণা রায়
মডেল: মাহি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস