টেকসহি I সার্কুলার রুল
ফাস্ট ফ্যাশনের সম্পূর্ণ উল্টো পিঠ। উদ্দেশ্য—পৃথিবীর সুস্থতা আর ক্রেতা সন্তুষ্টি। সম্পদ পুনর্ব্যবহারের প্রচেষ্টা
ফ্যাশন। আপাদমস্তক রঙিন, উজ্জ্বল, আধুনিকতায় ভরপুর এক শব্দ। যেখানে নেতিবাচকতার লেশমাত্র নেই। কিন্তু যখন ফ্যাশনের ব্যবহার-পরবর্তী অধ্যায় আলোচনায় আসে, হিসাব-নিকাশ বদলে যায় মুহূর্তে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৯২ মিলিয়ন টন টেক্সটাইল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা প্রতি সেকেন্ডে একটি ট্রাক ভর্তি বর্জ্য ফেলার সমান। আর এই ফ্যাশন বর্জ্যের দানব শেষমেশ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতির ওপর। ফলাফল—পরিবেশের চূড়ান্ত ক্ষতি হচ্ছে এখান থেকে, তা বলাই বাহুল্য। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ২০২৪ সাল ছিল রেকর্ড করা ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর, যেখানে গড় তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতির বেশ কিছুটা দায় যে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির আছে, তা সহজে অনুমেয়। তাই এ সময়ে সার্কুলার ফ্যাশন ভাবনা ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
সার্কুলার ফ্যাশন মডেল
বহু শ্রুত ফাস্ট ফ্যাশনের একদম বিপরীত ভাবনা সার্কুলার ফ্যাশন। অল্প সময় নয়, দীর্ঘ সময় টিকে থাকবে এমন ফ্যাশন প্রোডাক্ট তৈরি হয় এতে। ব্যবহার করা হয় পরিবেশের প্রতি ইতিবাচক উপাদান। সার্কুলার ফ্যাশন এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পাশাপাশি পণ্যের আয়ু বাড়ানোও সম্ভব। এই পদ্ধতি ফ্যাশন শিল্পের সম্পদ পুনর্ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে। ধারণা দেয় ব্যবহৃত উপাদান বারবার ব্যবহারের।
কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সার্কুলার ফ্যাশন মডেল মেনে কাজ করতে চায়, তাহলে যেকোনো একটি ধাপ মানলেই চলবে না; একদম শুরু থেকে শেষ অবধি পুরোটাই এই দর্শন মেনে নিলে তবেই ঠিকঠাকভাবে সার্কুলার ফ্যাশনের সূত্রে থাকা যাবে। লাইফ সাইকেলের সবেতেই থাকা চাই সচেতনতা। তার সঙ্গে নকশা, স্টোরেজ, পণ্য পরিবহনও থাকে। বাহুল্য বর্জন ধারণার বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় এখানে। কোনো পণ্য তৈরিতে দীর্ঘ উপাদান তালিকার নয়; বরং যত প্রয়োজন, ঠিক ততগুলো উপাদান ব্যবহারে পণ্য তৈরি করার পরামর্শ দেয় এই মডেল। পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য উৎপাদন করে। পরিবেশ দূষণকারী উপাদান ও রাসায়নিক ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করে। পুরোনোকে বদলে নতুন পণ্য তৈরির উপায় বাতলে দেয়। সেইফ, সাসটেইনেবল ও ইথিক্যাল প্রোডাকশন করে।
নীতি
সার্কুলার ফ্যাশন নীতি উপজীব্য করে যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা চালিয়ে থাকে, তারা প্রথমেই চেষ্টা করে বর্জ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে। পণ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার ক্ষেত্রেও তারা পরিকল্পনা রাখে। এতে বাজেট তৈরি করে সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান চালানো সহজ হয়। আর্থিক চাপের পরিমাণ কম থাকে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিশেষ দিক রয়েছে এই মডেলের—
ক্রেতা কোনো পণ্য কেনার পর প্রয়োজনে বদলে নেওয়ার অধিকার রাখেন।
প্রয়োজনে আপসাইকেলের পরিকল্পনা করতে পারে এই ব্র্যান্ড।
ক্লদিং আইটেম তৈরির ক্ষেত্র নিরাপদ ও আনঅ্যাডাল্টারেড উপাদান ব্যবহার করে থাকে।
ফাইবার ব্যবহারে পণ্য তৈরি করা হলে সেগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য হতেই হবে; নয়তো অনুমতি মিলবে না তৈরির।
প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরই নিজস্বতা থাকে। উদ্যোক্তা শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত নেন কীভাবে চলবে সবকিছু। ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সার্কুলার ফ্যাশন মডেল অনুসরণ করে পুরো কার্যক্রম চালাতে চায়, তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলা চাই। পরিকল্পনা করতে হবে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি মাথায় রেখে। এই ইন্ডাস্ট্রি কী কী ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখা চাই। ঝুঁকি সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে এবং কী কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানের পাশাপাশি সমাধান জানা থাকা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা থাকতে হবে। নকশায় সৃজনশীলতা ক্রেতা চাহিদা তৈরির পাশাপাশি নিজস্বতা নিশ্চিত করবে। পণ্য পরিবহনের জন্য রাখা চাই যথাযথ ব্যবস্থা।
উপকারী দিক
সার্কুলার ফ্যাশনে চালিত প্রতিষ্ঠানের পোশাক নিরাপদ এবং নন-টক্সিক হয়ে থাকে।
উৎপাদনের সময় অতিরিক্ত বর্জ্য তৈরি করে না।
পুনর্ব্যবহারের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা থাকে।
নিরাপদ ও উচ্চ মানসম্পন্ন উপাদান ব্যবহার করে।
টেকসই তত্ত্ব মেনে চলে।
উচ্চমানের ফ্যাব্রিক ও উপাদান ব্যবহার করে।
প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার থেকে দেশকে বাঁচায়।
পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেয় না।
গবেষণার মাধ্যমে অনেক রকমের নিরীক্ষার সুযোগ থাকে।
উপাদানের কারণে কোনো শ্রমিকের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না।
স্বাস্থ্য সমস্যা রোধ
সার্কুলার ফ্যাশন পদ্ধতি অনুসরণ করলে ব্র্যান্ডের খরচ বাড়ে, এমন ধারণা সঠিক নয়; বরং কমে আসে। বলা যেতে পারে, এটি লো-কস্ট এন্টারপ্রাইজ। বর্জ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনার কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার খরচও কমে। তাই সেখান থেকে কেনাকাটা করতে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় না ক্রেতাদের।
প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা
সার্কুলার ফ্যাশন মডেল বৈশ্বিক অর্থনীতি ইতিবাচক রাখে। গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে সহায়ক। পানিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে। ধরণীকে ভালোবেসে ক্ষতি কমাতে চেষ্টা করে। আবার ক্রেতাস্বার্থও যেহেতু সংরক্ষণের চেষ্টা করে; তাই বলা যায়, প্রকৃতি আর এর সন্তান—দুয়ের জন্যই ভাবে সার্কুলার ফ্যাশন।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট